মালদ্বীপে চীনা জাহাজ, ভারত কেন উদ্বিগ্ন

চীনের জাহাজ জিয়ান ইয়াং হং ০৩ছবি: সংগৃহীত

মালদ্বীপের রাজধানী মালের বন্দরে চীনের সামরিক ‘নজরদারি’ জাহাজকে ভিড়তে দেওয়ার অনুমতি নিয়ে ভারত তার উদ্বেগের কথা জানাবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুযায়ী, কূটনৈতিক স্তরে ভারত সেই উদ্বেগের কথা মালদ্বীপকে জানাবে বলে ঠিক করেছে। চীনের ওই জাহাজ ‘শিয়াং ইয়াং হং-৩’-এর গতিবিধি ও আচরণের ওপর নজর রাখতে সে দেশে থাকা ভারতীয় সরকারি সব মহলকে সজাগ করে দেওয়া হয়েছে।

মালদ্বীপ অবশ্য বলছে, ওই জাহাজের কাজ সামুদ্রিক গবেষণা করা, সামরিক নজরদারি নয়। গতকাল মঙ্গলবার সেই দেশের পক্ষে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, চীনের কূটনৈতিক অনুরোধ মেনেই ওই সিদ্ধান্ত। জাহাজটিকে ভিড়তে দেওয়া হচ্ছে কর্মী বদল, খাবারদাবার তোলা ও জ্বালানি ভরার জন্য। মালদ্বীপ বলেছে, সে দেশের সমুদ্রসীমায় নোঙর করে থাকার সময় ওই জাহাজ কোনো নজরদারি চালাবে না।

ভারত অবশ্য মালদ্বীপের ওই সাফাইকে আমল দিতে প্রস্তুত নয়। ভারত মনে করছে, ওটি আদ্যন্ত সামরিক নজরদারির জাহাজ।

আরও পড়ুন

মালদ্বীপের সমুদ্রসীমায় অবস্থিত মাকুনুধুতে চীন একটা পর্যবেক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করতে চাইছে। সেই প্রচেষ্টা দীর্ঘদিনের। ২০১৭ সালে মালদ্বীপের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুম চীনের সেই প্রস্তাবে রাজিও হয়েছিলেন। পর্যবেক্ষণকেন্দ্র স্থাপনে চীনের রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে অনুমতিও দিয়েছিলেন। ভারত সেই সময় তীব্র আপত্তি জানিয়েছিল। নিরাপত্তার বিষয়টি তুলে ধরেছিল।
সেই সময়ের বিরোধী দল মালদ্বীপ ডেমোক্রেটিক পার্টিও (এমডিপি) ওই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিল।

সরকারকে তারাও বলেছিল, ওই কাজ সম্পন্ন হলে মালদ্বীপের সার্বভৌমত্ব বিপজ্জনক অবস্থায় পড়ে যাবে। পরবর্তী নির্বাচনে গাইয়ুম সরকার হেরে গেলে এমডিপি ক্ষমতায় আসে। নতুন প্রেসিডেন্ট ভারতপন্থী ইব্রাহিম মোহাম্মদ সোলিহ্ চীনের সেই প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছিলেন। ভারতও স্বস্তির শ্বাস ফেলেছিল।

পুরোনো সেই অস্বস্তি নতুন করে ফিরে এসেছে চীনপন্থী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু নির্বাচনে জিতে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে। মুইজ্জু নির্বাচনে জেতেন তীব্র ভারত–বিরোধিতা করে। তাঁর নির্বাচনী স্লোগানই ছিল—‘আউট ইন্ডিয়া’। প্রেসিডেন্ট হয়ে পুরোনো প্রথা ভেঙে প্রথম সফরে ভারতে না এসে তিনি যান তুরস্কে, যে দেশটি ভারতের তীব্র সমালোচক। এরপর তিনি যান চীন সফরে। ক্ষমতা গ্রহণের আগেই তিনি জানিয়ে দেন, সে দেশে অবস্থিতি ৮৮ ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দেশে ফিরে যেতে হবে। ১৫ মার্চ তার সময়সীমাও তিনি ধার্য করে দিয়েছেন।

নতুন করে চীনা ‘নজরদারি’ জাহাজকে নোঙর করতে দেওয়ার মতো গুরুতর সিদ্ধান্ত নিলেন মুইজ্জু। ভারতের ধারণা, সিদ্ধান্তের পরিবর্তন না হলে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই ‘শিয়াং ইয়াং হং-৩’ মালে বন্দরে নোঙর করবে।

আরও পড়ুন

চীনের এ ধরনের ‘আগ্রাসী’ মনোভাবের বিরুদ্ধে আগেও বহু দেশ প্রতিবাদ জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছিল, প্রশান্ত মহাসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগরে চীন ‘আগ্রাসী’ হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের নজরে রয়েছে ভারত মহাসাগরও। ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়াও অভিযোগ করেছিল, তাদের সমুদ্রসীমায় অবস্থিত ‘একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলে’ (ইইজেড) চীনা নজরদারি জাহাজ ঢুকেছে।

ভারত মহাসাগরের ওপর চীনের নজর দীর্ঘদিনের। ২০২২ সালের আগস্ট ও ২০২৩ সালে অক্টোবরে শ্রীলঙ্কা সরকারও চলে এসেছিল বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। সে সময় তারা চীনের দুটি জাহাজ ‘ইউয়ান ওয়াং ৫’ ও ‘শি ইয়ান ৬’–কে যথাক্রমে হাম্বানটোটা ও কলম্বো বন্দরে ভেড়ার অনুমতি দিয়েছিল। তখনো সেগুলোকে ‘গবেষণা’ জাহাজ বলা হয়েছিল।

চীন চেয়েছিল, ‘ইয়াং হং ৩’-কেও সমুদ্রগবেষণার জন্য কলম্বোতে এক বছর থাকতে দেওয়া হোক। সে জন্য তারা শ্রীলঙ্কার সঙ্গে কথাও বলেছিল। কিন্তু ভারত আপত্তি জানায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কথা বলেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের সঙ্গে। এরপরই এ বছরের গোড়ায় শ্রীলঙ্কা জানিয়ে দেয়, কোনো চীনা গুপ্তচর জাহাজকে আগামী এক বছর তাদের দেশে ভিড়তে দেওয়া হবে না। এরপরেই ওই জাহাজ মালদ্বীপমুখী হয়।

মালদ্বীপ সরকার তাদের বিবৃতিতে বলেছে, উপলক্ষ ও উদ্দেশ্য শান্তিপূর্ণ হলে বন্ধুদেশের যেকোনো সামরিক বা বেসামরিক জাহাজ তাদের দেশে স্বাগত। স্পষ্টতই, মালদ্বীপের কাছে চীনের উদ্দেশ্য অশান্তি সৃষ্টি করা নয়। অতএব ভারত আপত্তি জানালেও মুইজ্জু সরকার নিশ্চিতই তা উপেক্ষা করবে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ধারণা।

আরও পড়ুন