দক্ষিণ কোরিয়া কেন পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে চাইছে

উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা টেলিভিশনে দেখছেন দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষ। এতে দেশটিতে পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রতি সমর্থন বাড়ছে
ছবি: এএফপি

দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের ভূগর্ভের একটি রেস্তোরাঁর গোপন কক্ষে বৈঠক চলছে। দক্ষিণ কোরিয়ার একদল শীর্ষ নেতা সেখানে গোপন মধ্যাহ্নভোজের ফাঁকে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সারছেন। তাঁদের মধ্যে রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানী, সামরিক বাহিনীর সদস্য থেকে শুরু করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকের পরিচয় প্রকাশ করা যাচ্ছে না। কারণ, বিষয়টি খুব স্পর্শকাতর। দেশটির পারমাণবিক নীতিনির্ধারণী ফোরামের প্রথম বৈঠক এটি। মধ্যাহ্নভোজের এই আলোচনাতেই তাঁরা উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করছেন। তাঁদের পরিকল্পনায় রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির বিষয়টি।

বেশ কিছুদিন ধরেই দক্ষিণ কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে গুঞ্জন চলছিল। গত মাস থেকেই এ খবর মূলধারায় আসতে শুরু করে। সম্প্রতি দেশটির প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইউল এক প্রতিরক্ষা সম্মেলনে পারমাণবিক কর্মসূচির পথে হাঁটার সম্ভাবনার বিষয়টি তুলে ধরেন। বিশ্বে সাম্প্রতিক সময়ে তিনিই প্রথম কোনো প্রেসিডেন্ট, যিনি বিষয়টি আলোচনার টেবিলে আনলেন। এখন প্রতিদিনই সংবাদপত্রগুলোয় এ নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। দেশটির এক–তৃতীয়াংশ মানুষ তাঁর এই প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণ প্রতিবেশী উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে উদ্বেগে রয়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট ইউন আগামী বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে সাহায্যের অনুরোধ নিয়ে হোয়াইট হাউস সফরে যাচ্ছেন।

এর আগে ১৯৭০ সালে একবার পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ধারণা নিয়ে এগিয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া। ওই সময় গোপনে কর্মসূচি শুরু করেছিল দেশটি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি টের পাওয়ার পর তাদের সতর্ক করে দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দিয়ে বলা হয়, সিউলকে সুরক্ষায় তারা এগিয়ে আসবে। সিউলকে তাদের কর্মসূচি ত্যাগ করতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়া মার্কিন সমর্থন বেছে নেয়। তখন থেকেই দেশটিতে হাজারো মার্কিন সেনার উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে।

এর পর থেকে বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে নাটকীয় বদল এসেছে। উত্তর কোরিয়া আরও উন্নত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করেছে। তাদের অস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো শহরে আঘাত হানতে সক্ষম। মানুষের মনে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, দক্ষিণ কোরিয়ার সুরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র কি এখনো এগিয়ে আসবে?

দক্ষিণ কোরিয়ার নেতারা বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছেন। তাঁদের আশঙ্কা, উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং–উন দক্ষিণ কোরিয়ায় হামলা চালালে যুক্তরাষ্ট্রকে মাথা ঘামাতে হবে। তখন কিম যুক্তরাষ্ট্রকে পারমাণবিক হামলার হুমকি দিতে পারেন। এ পরিস্থিতিতে ওয়াশিংটন কী করবে? তারা কি সিউলকে রক্ষায় নিজেদের ঝুঁকিতে ফেলবে? দক্ষিণ কোরিয়ার নেতারা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র এ ঝুঁকি নেবে না। তাই তাঁরা বাধ্য হয়ে মধ্যাহ্নভোজের আলোচনায় নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কথা আলোচনা করছেন।

দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষমতাসীন পিপল পাওয়ার পার্টি ও দেশটির পরমাণুনীতি ফোরামের সদস্য চই-জি ইয়াং বলেন, ‘অন্য দেশ আমাদের সুরক্ষা দেবে, এটা ভাবা অযৌক্তিক। এটা আমাদের সমস্যা ও সমাধানের দায়িত্ব আমাদের।’

ফোরামের চেয়ারম্যান ও গবেষক চিওং সং-চ্যাং তাঁদের পরিকল্পনার বিষয়টি উপস্থাপন করেন। তাঁদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এরপর যদি উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালায়, তবে সিউল পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) থেকে বেরিয়ে যাবে। পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে কিম যদি নিরস্ত্রীকরণ চুক্তির বিষয়ে আলোচনায় না বসেন, তবে দক্ষিণ কোরিয়া নিজেদের অস্ত্র তৈরির কর্মসূচি শুরু করবে। এতে কোরিয়া উপদ্বীপে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা কমবে। দক্ষিণ কোরিয়া পাল্টা আক্রমণ করবে জানলে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম আর হামলা করার সাহস পাবেন না।

তবে মার্কিন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ৩৮ নর্থের বিশ্লেষক জেনি টাউন দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্লেষকদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, দক্ষিণ কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করলেই উত্তর কোরিয়া চুপ থাকবে, এমন ধারণা ঠিক নয়। বেশি বেশি পারমাণবিক অস্ত্র বিশ্বকে পারমাণবিক লড়াই থেকে সুরক্ষিত রাখবে না। তিনি উদাহরণ দিতে গিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের কথা বলেন।

দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে পারমাণবিক সক্ষমতার অস্ত্র থাকুক, যুক্তরাষ্ট্র তা চায় না। তবে দক্ষিণ কোরিয়াকে উচ্চাভিলাষী হতে বাধ্য করেছে যুক্তরাষ্ট্রই। ২০১৬ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দক্ষিণ কোরিয়াকে নিজের মতো করে ছুটতে দেন। তিনি সিউলকে হুমকি দিয়ে বলেন, যে মার্কিন সেনারা তাদের সুরক্ষা দিচ্ছেন, সে জন্য তাদের অর্থ পরিশোধ করা উচিত। তা না হলে যুক্তরাষ্ট্র সেনাদের সরিয়ে নেবে। দেশটির জনগণের মধ্যে এর পর থেকেই উদ্বেগ বেড়েছে। মার্কিন প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে তাদের মধ্যে সন্দেহ–সংশয় বাড়তে শুরু করেছে।

সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে ৩১ বছর বয়সী কু সুং-উক নামের এক তরুণ বলেন, ‘আমাদের প্রতিরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র তার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে না। আমাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আমাদেরই ঠিক করতে হবে। এটা এখন জরুরি পরিস্থিতির মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন চিন্তার বিষয় কেবল উত্তর কোরিয়া নয়, সঙ্গে চীনও রয়েছে। তাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োজন।’

যুক্তরাষ্ট্র এখন আর তার মিত্রদের সুরক্ষা দিতে কঠোর প্রতিশ্রুতি রক্ষার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। এ মাসের শুরুতে বুসানে বিশাল পারমাণবিক সক্ষমতার একটি যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু মার্কিন নীতিনির্ধারকদের মধ্যে হতাশা বাড়তে থাকায় এ ধরনের উদ্যোগ খুব বেশি কাজে আসছে না। সিউলের রাজনীতিবিদেরাও অন্ধকারে পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের সবকিছু জানানো হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র তাঁদের কত দূর পর্যন্ত সুরক্ষা দেবে, তা নিশ্চিত হতে চান তাঁরা।

সিউলভিত্তিক আসান ইনস্টিটিউটের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ইয়াং ইউক দাবি করেন, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মূলত যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র তাদের পারমাণবিক অস্ত্রের নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করতে অনিচ্ছুক। এ অঞ্চলে পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হলে কোরিয়া উপদ্বীপ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সিউল মূলত পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে আরও জড়িত হতে যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দিচ্ছে। ইউরোপে যেমন পারমাণবিক অস্ত্র বিনিময়ের চুক্তি রয়েছে, তেমন কোনো বন্দোবস্ত করা বা দক্ষিণ কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের মতো বিষয়টি ঠিক করে নিতে চায় তারা। দক্ষিণ কোরিয়ার সর্বনিম্ন চাওয়া হতে পারে, যৌথ পারমাণবিক পরিকল্পনা গ্রুপ তৈরি করা।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র হয়তো এত কিছুতে রাজি হবে না। কিন্তু তাদের এমন কিছু দিতে হবে, যাতে প্রেসিডেন্ট ইউন মনে করতে পারেন, তিনি জয়ী হয়েছেন এবং কোরিয়ার জনগণকে আশ্বস্ত করতে পারবেন। কিন্তু পরিস্থিতি দেখে যা মনে হচ্ছে, তাতে অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষের মনে যে ধারণা গেঁথে গেছে, তা শিগগির সরিয়ে ফেলা সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না।

পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন করা বিশাল সিদ্ধান্তের বিষয়। বিশ্ব বর্তমানে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধের পক্ষে। যাঁরা এ নীতির বাইরে, যেমন ইরান ও উত্তর কোরিয়ার মতো দেশকে ব্যাপক মূল্য চুকাতে হচ্ছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, দক্ষিণ কোরিয়া সম্ভবত ফলাফল খতিয়ে দেখেনি। তারা এ পথে হাঁটলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রতিরক্ষা প্রতিশ্রুতি তুলে নেবে, চীন দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেবে। এতে দক্ষিণ কোরিয়া বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। দেশটির আন্তর্জাতিক সুনাম নষ্ট হবে।