আফগান নারীদের গোপন কথা
আফগানিস্তানে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তালেবান দেশটির মেয়েশিক্ষার্থীদের বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। নারীদের পার্ক ও জিমনেশিয়ামে যাওয়ার ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। নারী ও মেয়েশিক্ষার্থীদের ওপর তালেবানের এ আচরণ মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল বলে মন্তব্য করেছে জাতিসংঘ।
বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তালেবানের এমন নিয়মনীতির বিরুদ্ধে জেগে উঠছেন আফগান নারীরা। মাঝেমধ্যে কাবুলের রাস্তায় আফগান নারীদের দৃঢ় কণ্ঠও শোনা যায়। কখনো নিচু স্বরে আবার কখনো উচ্চ স্বরে নারীদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর জেগে উঠছে। প্রায় সময়ই তাঁরা আফগানিস্তানের বাইরে গিয়ে বক্তব্য রাখছেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীরা নিরাপদ জায়গায় গিয়ে তাঁদের চিন্তাভাবনা প্রকাশ করছেন। আফগানিস্তানে নারীরা কী পরবেন, কী করবেন বা জীবনে কী কী করতে পারবেন না, তার সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছে তালেবান সরকার। এ কারণে তালেবান সরকারের কঠোর নিয়মের মধ্যে নিজেদের জীবনকে মানিয়ে নিতে গিয়ে ধীরে হলেও ফুঁসে উঠছেন তাঁরা।
২০২১ সালের আগস্টে তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসার কয়েক মাস আগে ১৮ জন আফগান নারী লেখক গল্প লিখেছিলেন। তাঁদের বাস্তব জীবন থেকে রসদ নিয়ে লেখা গল্পগুলো চলতি বছরের শুরুর দিকে ‘মাই পেন ইজ দ্য উইং অব আ বার্ড’ নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কারণে অনেক আফগান নারী-ই হতাশ হয়েছেন। এই লেখকেরা তাঁদের কলম আর ফোন ব্যবহার করে ওই হতাশ নারীদের পাশে থাকছেন। পারানদা ও সাদাফ (ছদ্মনাম) নামে কাবুলের দুই নারী লেখক তাঁদের প্রতিবাদী গোপন চিন্তাভাবনা একে অপরের কাছে জানিয়েছেন। তাঁদের সেই গোপন চিন্তাভাবনা নিয়েই এই প্রতিবেদন।
গোলাপি স্কার্ফ অন্ধকারে এক বিন্দু আলো
পারানদা লেখেন, ‘আজ আমি দৃঢ় সংকল্প নিয়ে জেগে উঠলাম। যখন আমি পোশাক দেখছিলাম, তখন রোজ যে কালো স্কার্ফ পরি, তার সঙ্গে লড়াই করতে গোলাপি স্কার্ফ পরার সিদ্ধান্ত নিই...গোলাপি স্কার্ফ পরা কি কোনো পাপ?’
নিজেকে মেয়ে ভাবতে পারানদা গোলাপি স্কার্ফ পরতে পছন্দ করেন। তবে নারীরা যা পরতে পছন্দ করেন, তা পরা আফগানিস্তানে এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। এ নিয়ে এখন যুদ্ধ চলছে। শালীনতার ওপর তালেবানরা জোর করে কঠোর বিধিনিষেধ জারি করেছে। এই ঐহিত্যবাহী সমাজে মাথা ঢেকে রাখার বিষয় নিয়ে কেউ কোনো কথা বলছে না। কেউ কেউ কেবল নিজেদের পছন্দের অধিকারটুকু চান। মাঝেমধ্যে রাস্তা বা জনসমাগমস্থলে যেন অন্ধকারে একটু আলোর মতো গোলাপি স্কার্ফ দেখতে পাওয়া যায়।
ফেরার কোনো পথ নেই
কবি হাফিজুল্লাহ হামিম লিখেছেন, ‘পেছনে যাওয়া সহজ নয়। সামনে যাওয়া আরও কঠিন, আমার কি আশাবাদী হওয়া উচিত নয়? আমরা পেছনে যেতে পারব না।’
আফগান নারীরা এখন প্রকাশ্যে গণবিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ছোট পরিসরে হলেও সাহসী জনতা এখন কাবুলসহ অন্যান্য শহরের রাস্তায় নেমে আসছেন। ‘রুটি, রুজি ও স্বাধীনতার’ দাবি সংবলিত ব্যানার নিয়ে তাঁরা রাস্তায় নামছেন। তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে আটক করা হচ্ছে। আটক থাকাবস্থায় অনেকে নিখোঁজও হয়েছেন। আফগান সীমান্তের ওপারে ইরানে ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ নিয়ে আন্দোলন চলছে। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারীরা। তাঁদের দাবি, হিজাব পরার বাধ্যবাধকতা বন্ধ করা হোক। ঠিক একইভাবে আফগান নারীদের কাজ করা ও মেয়েদের শিক্ষিত হওয়ার অধিকার থাকা উচিত।
ভয় রাগে পরিণত হয়
‘তালেবান প্রহরীরা আমাদের গাড়ি থামিয়ে দিলেন। আমাকে ইশারা করলেন...। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল, শরীর কেঁপে উঠল। মনে হচ্ছিল যেন একটা বাতাস আমার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে...। আমাদের গাড়ি যখন চলতে শুরু করল, তখন মনে হলো বাতাস অন্য দিকে সরে যাচ্ছে। আমার ভয় ততক্ষণে রাগে পরিণত হয়েছে।’
এটা অপ্রত্যাশিতভাবে একটা কঠিন ব্যাপার। কারণ, কোনো কোনো তালেবানরক্ষী খুব আক্রমণাত্মক হন। আর কেউ একটু সহজ। আফগানিস্তানে নারীদের একা একা ভ্রমণ করাটা এখন অনেক কঠিন। নারীরা দূরে ৭২ কিলোমিটারের বেশি ভ্রমণ করলে মাহরাম নামে পুরুষ সঙ্গী থাকা বাধ্যতামূলক। নারীদের ঘরে রাখার উদ্দেশ্যে তালেবানরা ইচ্ছেমতো এই নিয়ম চালু করেছে।
আইসক্রিম নিয়ে উচ্ছ্বাস
‘শৈশবে আইসক্রিম খাওয়ার উচ্ছ্বাস বয়স্কদের মহাকাশে ভ্রমণের উচ্ছ্বাসের মতোই সমান।’
আফগানিস্তানে আইসক্রিমের দোকান বা ক্যাফের সামনে খুব কম সময়ই নারী ও শিশুদের ভিড় দেখা যায়। এখানে তাদের ভিড় মোটামুটি বিরল ঘটনা। একইভাবে পার্ক ও নারীদের ব্যায়ামাগার ও গণস্নানাগারেও নারীদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। যে কারণে সেসব স্থানে নারীরা হিজাব বা পোশাকের কঠোর বিধিনিষেধ অমান্য করতে পারেন।
তেরোতেই বড়
‘গণস্নানাগারের মালিকের ১৩ বছর বয়সী মেয়ের বাগ্দান হয়ে গেছে। এটা আশ্চর্যজনক। তাঁর মা বলেন, তালেবানরা আর কখনোই স্কুল খুলে দেবে না। ভাগ্যের দোষে তাঁকে এখন তাঁর বাড়িতেই যেতে হবে...মনে হচ্ছে ওই ছোট্ট মেয়েটি আমি নিজে...তালেবানরা আসার শুরুর দিকে আমি হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। জোরপূর্বক বিয়েও মেনে নিতে হয়েছিল...সেই ক্ষত এখনো সারেনি...কিন্তু আমি এখন উঠে দাঁড়িয়েছি।’
এ পরিস্থিতি নিপীড়নের পুনরাবৃত্তি। নব্বইয়ের দশকে তালেবান শাসনের সময় আফগান নারীদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেই ঘটনা এখনো দুঃখের সঙ্গে স্মরণ করেন দেশটির নারীরা। অন্য নারীদের মতো পারানদাও ২০০১ সালে তালেবানের পতনের পর স্কুলে যাওয়া, বিয়ে-বিচ্ছেদের মতো পুরোনো সুযোগগুলো ফিরে পান। এরপর নতুন প্রজন্মের স্কুলছাত্রীরা আরও বড় স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকে। কিন্তু আবারও স্কুল বন্ধ করে দিল তালেবানরা। এটা ওই সব স্কুলছাত্রীদের জন্য অনেক কষ্টের বিষয়।
নারীর বিরুদ্ধে অশালীন শব্দ ব্যবহার করে পুরুষ
‘আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতাম। কিন্তু এখন আমি মুখ বন্ধ করে রেখেছি। আমি এই সমাজ নিয়ে বিরক্ত। কারণ, নারীদের বিরুদ্ধে পুরুষেরা অশালীন শব্দ ব্যবহার করছে। আমার ধারণা, আফগান নারীদের সমস্যার মূল কারণ নিয়মনীতির পরিবর্তনকারী সরকার নয়...নারীর প্রতি এটা খুব খারাপ ভাবনা।’
আফগান শাসন পরিবর্তন হয়, আবার আসে। কিন্তু এই দেশে পিতৃতন্ত্র বজায় থাকে। আফগান নারীরা দীর্ঘকাল থেকে পুরুষদের বেঁধে দেওয়া সীমার মধ্যে জীবন যাপন করছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এর উন্নতির ধারা বিপরীতমুখী দেখা যাচ্ছে। যেটাকে জাতিসংঘ ‘বিস্ময়কর দমন’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। এর একটি নেতিবাচক প্রভাব আছে। রক্ষণশীল পারিবারিক নিয়মকানুনকে আরও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী করে তোলে। যাতে মেয়ে ও নারীরা সব সময় আড়ালে থেকে যান।
দেশের পরিস্থিতি একদিন ভালো হবে
পারানদা আরও লেখেন, ‘যা ঘটছে, তা অবশ্যই আমাকে লিখতে হবে। এখানে গণমাধ্যম অনেক কম...আমি বিশ্বাস করি, একদিন আফগানিস্তান নারী ও মেয়েদের জন্য খুব ভালো দেশ হবে। কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু এটা হবেই।’
পারানদা ছদ্মনাম। এর অর্থ পাখি। পারানদার মতো নারীরা, বিশেষ করে শহুরে শিক্ষিত নারীরা খাঁচায় বন্দী হয়ে থাকতে চান না। তাই অনেকেই পালিয়ে গেছেন। অনেকে এখনো আশায় বুক বেঁধে আছেন। ছোট ছোট দলে হলেও অনেকেই সাহসের সঙ্গে প্রতিবাদ করছেন। দেশটির প্রত্যন্ত অঞ্চলের অশিক্ষিত নারীরাও এমন বন্দী জীবন নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করছেন।
শান্তির জন্য লেখা
সাদাফ লেখেন, ‘লিখুন! ভয় পাচ্ছেন কেন? কাকে ভয় করছেন?...হয়তো আপনার লেখা কারও আত্মার প্রশান্তি জোগাতে পারে...আপনার কলম কারও ভাঙা হাতের নির্ভরতা ও আশাহীন মানুষের মনে আশার সঞ্চার করতে পারে।’
একজন লেখকের জীবন যেকোনো স্থানে সন্দেহপ্রবণ ও ভীত হতে পারে। আফগান নারীদের জন্য, বিশেষ করে যাঁরা লেখার জন্য নিরাপদ ও নির্জন জায়গা খোঁজেন, তাঁদের জন্য বিষয়টা আরও প্রকট। ‘মাই পেন ইজ দ্য উইং অব আ বার্ড’ বইটি প্রকাশিত হওয়ায় তাঁদের শব্দে নতুন প্রাণ এসেছে।
সাদাফ আরও লেখেন, ‘একজন ছাত্র চমৎকারভাবে বইটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। যখন বইয়ে থাকা আমার নাম উল্লেখ করেছিল, তখন খুব ভালো লেগেছিল। এসব আমি জীবনের সবচেয়ে আনন্দদায়ক স্মৃতি হিসেবে লিখি।’
যেন আমি রুটিওয়ালা
‘আমার বিশ্বাস, অর্থ নিয়ে চিন্তা করা আমার উচিত নয়। সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার জন্য এর চেয়েও ভালো কিছু থাকতে পারে। কিন্তু কেন আমি চিন্তিত, তা সৃষ্টিকর্তা ভালো জানেন। আমাদের ১০ সদস্যের পরিবার। এই পরিবারে একমাত্র আমিই উপার্জন করি। আয়ও খুব একটা ভালো নয়।’
আফগানিস্তানে নারীদের কাজ একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়নি। কিছু নারী চিকিৎসক, নার্স, শিক্ষক, পুলিশ এখনো তাঁদের কাজ করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে তাঁরা নারী ও অল্প বয়সী মেয়েদের জন্য কাজ করছেন। ব্যবসায়ী হিসেবে কিছু নারী এখনো ব্যবসা করছেন। তবে সরকারের বেশির ভাগ মন্ত্রণালয়ের দরজা নারীদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মেয়েদের হাইস্কুল বন্ধ করে দেওয়ায় নারী ও কাজের মধ্যে যোগাযোগ ব্যাহত হচ্ছে।
তুমি শক্তিশালী
সাদাফ লেখেন, ‘আমি বললাম, না না! আত্মহত্যা করতে পারব না। নিজেকে আশ্বাস দিয়ে বললাম, তুমি হয়তো বাঁচতে চাও না। তবুও তোমার আত্মহত্যা আরও অনেক মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলবে। তাঁদের প্রতি সদয় হও, তুমি শক্তিশালী, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তুমিই তা ঠিক করতে পারবে। এই অন্ধকার কেটে যাবে।’
এমন ফিসফিসানি সুর সবখানেই শুনতে পাওয়া যায়। অল্প বয়সী নারীদের আত্মহত্যা করার চেষ্টা বেড়ে যাচ্ছে। তবে এটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। কারণ, ওই সব পরিবারও বিষয়গুলো গোপন রাখে। এ ধরনের নথি গোপন করতে সরকারি হাসপাতালগুলোকেও নির্দেশ দেওয়া আছে।
সাদাফ বলেন, জাতিসংঘের একটি সংস্থা তাঁকে জানিয়েছে, যখন সংস্থাটি বিভিন্ন প্রদেশে নারীদের সঙ্গে কথা বলেছে, তখন এই আত্মহত্যার বিষয়টি উঠে এসেছে। স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কম বয়সী মেয়েদের জোর করে বিয়ে দেওয়ার কারণে এমনটি ঘটছে।
এর শেষ কোথায়?
‘আমরা কীভাবে স্বাভাবিক হতে পারব? আর যন্ত্রণা আমরা সহ্য করব? শেষমেশ মেনে নিয়েছি যে এই দেশ যত অমানবিকতা ও নিষ্ঠুরতা আছে, তার সবকিছুর মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু এমন পর্যায়ের শেষ কোথায়?’
চার দশকের বেশি সময় ধরে একাধিক প্রজন্ম শুধু যুদ্ধের কথা জানে। দেশটি কেবল এক সংঘাত থেকে আরেক সংঘাতের দিকে যাচ্ছে। তারপরও আফগানরা স্বপ্ন দেখে পরের পর্বটি হয়তো এর চেয়ে ভালো হবে। এটি এমন এক গল্প, যে গল্পের কোনো শেষ আছে বলে মনে হয় না।
আশার আলো
সাদাফ আরও লেখেন, ‘আমি হৃদয়ে আশার আলো ছড়িয়ে দিই...আমার ভেতর আগুন আছে। ভেতরের আমি আমাকে লড়াই করতে বলে। আমি আশায় আশায় থাকি, একদিন প্রকৃতির নিয়মে এই অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনের পরিবর্তন আসবে।’
আফগানরা প্রায়ই বলে যে আশাই মূলত শেষ কথা। তালেবানরা ক্ষমতা নেওয়ার আগের বছরগুলোতে প্রতিদিন সহিংস ঘটনা ঘটত। তখন অনেকেই বলেছিল, তাঁদের ভেতর আশাটুকুও আর বেঁচে নেই। কিন্তু এত কিছুর মধ্য দিয়ে এখনো যাঁরা বেঁচে আছে, তাঁরা আশা করেই বেঁচে আছে।