দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে জাপান কাজ করবে। এই সহযোগিতার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য বঙ্গোপসাগরীয় এলাকার অপার সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে গোটা অঞ্চলকে স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধিশালী করে তোলা। বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা, যা ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি রূপায়ণে সহায়ক হয়ে উঠবে। ভারত সফরে এসে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা সোমবার এক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন।
নয়াদিল্লির সপ্রু হাউসে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্সে এই ভাষণে প্রধানমন্ত্রী কিশিদা বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ শিগগিরই মধ্যম আয়ের দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নীত হবে। বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিতে রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তির সম্ভাবনা কতখানি, তা খতিয়ে দেখতে আমরা ইতিমধ্যে এক যুগ্ম স্টাডি গ্রুপ গঠন করেছি।’
জাপানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার স্বার্থে জাপান ও ভারত ঘনিষ্ঠ সহযোগী। বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে সহযোগিতার মধ্য দিয়ে জাপান বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চল ও উত্তর-পূর্ব ভারতের শিল্পোন্নয়নে জোর দেবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে জাপান অর্থনৈতিক পার্টনারশিপ গড়ে তুলতে আগ্রহী।
ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে মুক্ত, অবাধ ও উত্তেজনাহীন রাখার স্বার্থে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার কথা জানিয়ে কিশিদা বলেন, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারত অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে তার অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ। প্রশান্ত মহাসাগরকে মুক্ত ও অবাধ (চীনের প্রভাব ও আগ্রাসনমুক্ত) রাখার কথা ২০১৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে বলেছিলেন। জাপান সেই সহযোগিতার ক্ষেত্র বিস্তৃত করবে। তিনি বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শান্তি রক্ষার এই মৌলিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়াতে আমাদের বাধ্য করেছে।
কিশিদা এই সফরে বলেছেন, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে মুক্ত ও অবাধ রাখতে চারটি বিষয়ের ওপর জোর দিতে হবে। শান্তি রক্ষা, এই অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে বৈশ্বিক সমস্যার সমাধানে সহযোগিতা বৃদ্ধি, বিভিন্ন মহলের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো এবং সমুদ্র ও আকাশপথ মুক্ত ও অবাধ রাখা। এই লক্ষ্যে জাপান ২০৩০ সালের মধ্যে ৭৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করবে।
ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে মুক্ত ও অবাধ রাখতে গেলে বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের প্রতিটি দেশের দিকে যে দৃষ্টি দিতে হবে, সে কথাই কিশিদা মনে করিয়ে দিয়েছেন ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশের সঙ্গেও সহযোগিতার ক্ষেত্র বিস্তারের কথা বলে। ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট নীতি রূপায়ণে তাই তাঁর ভাষণে সংগত কারণেই চলে এসেছে বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সহযোগিতার বিষয়টি। বাংলাদেশের চমকপ্রদ অর্থনৈতিক উন্নয়ন তাঁর নজর এড়ায়নি। মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে সেই সম্ভাবনার মধ্য দিয়ে তিনি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে বাংলাদেশের সহযোগী হওয়ার ইচ্ছার কথাটিও জানিয়ে রাখেন।
ভূরাজনৈতিক দিক থেকেও বাংলাদেশকে কাছে টানার প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য। ভারত, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার চতুর্দেশীয় অক্ষ ‘কোয়াড’ নিয়ে চীন যথেষ্টই শঙ্কিত। চতুর্দেশীয় অক্ষের বিস্তার ঘটবে না এবং এই অক্ষ অরাজনৈতিক, এই দাবি জানানো সত্ত্বেও চীন সন্দিগ্ধ। বাংলাদেশের প্রতি চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব সুপরিচিত। ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল চীনের প্রভাবমুক্ত রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। কিশিদার এই ভাষণ সেই গুরুত্বই অনুধাবন করেছে বলে কূটনৈতিক ধারণা।
কিশিদার সফর নিয়ে সোমবার ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রা সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা, বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলের উন্নয়ন প্রসঙ্গে কিশিদার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি নতুন নয়। ভারত ও জাপান অ্যাক্ট ইস্ট নীতি রূপায়ণ নিয়ে অনেক দিন ধরেই সক্রিয়। আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে কাজ হচ্ছে, যা অ্যাক্ট ইস্ট নীতিকেই শক্তিশালী ও রূপায়ণ করছে। সেই লক্ষ্যের একটি হলো যোগাযোগব্যবস্থা, যা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও অন্যদের জুড়বে। এর মধ্যে কালাদানসহ বেশ কিছু সড়ক ও সেতু প্রকল্প রয়েছে, যা ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও অন্যদের সঙ্গে করে এই নীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কোয়াত্রা বলেন, এ বিষয়ে জাপানের সঙ্গে আলোচনার অগ্রগতি ইতিবাচক ও ফলপ্রসূ। এই বিষয়ে পরবর্তী ভারত-জাপান বৈঠক হবে আগামী মাসে দিল্লিতে।