সিরিয়া ও তুরস্কে ভূমিকম্পে ভবনধসে চাপা পড়া মানুষদের জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা কমে আসছে। এই পরিস্থিতিতে উদ্ধার অভিযানের চেয়ে বেঁচে থাকা আশ্রয়হীন মানুষদের প্রতি বেশি নজর দিতে আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। কেননা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকায় গৃহহীনদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।
এদিকে সিরিয়ায় বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোয় ত্রাণ সরবরাহ বাড়াতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে।
সিরিয়া ও তুরস্কের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ভূমিকম্প আঘাত হানে ৬ ফেব্রুয়ারি। এতে তুরস্কের ১০টি ও সিরিয়ার ৪টি প্রদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুই দেশে গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত মৃত মানুষের সংখ্যা ৩৬ হাজার ছাড়িয়েছে। সরকারের দেওয়া তথ্য অনুসারে, তুরস্কে মারা গেছেন ৩১ হাজার ৬৪৩ জন; আর সিরিয়ায় মারা গেছেন ৪ হাজার ৫৭৪ জন। জাতিসংঘ জানিয়েছে, এই দুই দেশে ৮ লাখ ৭০ হাজার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মুখে যত দ্রুত সম্ভব গরম খাবার তুলে দেওয়া দরকার।
এ ভূমিকম্পে সিরিয়ায় এখনো ৫৩ লাখ মানুষ গৃহহীন। তবে তুরস্কে এই সংখ্যা কত, তা জানা যায়নি। দেশটিতে এ পর্যন্ত ১০ লাখের বেশি মানুষকে সাময়িক আশ্রয় দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া হাসপাতালে রয়েছেন ৮০ হাজারের মতো আহত মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে চার লাখ মানুষকে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে।
তুরস্কে উদ্ধার অভিযানের গতি শ্লথ হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় মানুষেরা। এ ছাড়া যাঁদের ঘরবাড়ি ধসে গেছে, তাঁদের সবার জন্য সাময়িক আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা যায়নি। আবার ভবন ধসে যাওয়ায় পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সেই সঙ্গে সুপেয় ও নিত্যকাজে ব্যবহৃত পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খোলা আকাশের নিচে থাকতে হচ্ছে অনেককে। এতে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ ছড়াতে শুরু করেছে।
এ ছাড়া শীত থেকে বাঁচতে গৃহহীনেরা প্লাস্টিক পোড়াচ্ছেন। এতে বায়ুদূষণ বাড়ছে। একই সঙ্গে এমন দূষিত বাতাসে শ্বাস গ্রহণ করছেন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা। আবার যাঁদের ঘরে থাকার সুযোগ রয়েছে, তাঁদের অনেকে ভূমিকম্পের ভয়ে বাইরে থাকছেন। তাঁরাও উষ্ণ থাকতে কাঠ ও প্লাস্টিক পোড়াচ্ছেন।
এদিকে অনেক মৃতদেহের সৎকার সম্পন্ন হয়নি। সময় যত গড়াচ্ছে, তত বেশিসংখ্যক লাশ গলতে শুরু করেছে। এতে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, ছড়াচ্ছে সংক্রমণও।
সংক্রমণ ছড়ানোর কথা স্বীকার করে তুরস্কের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফাহরেত্তিন কোচা বলেন, উপদ্রুত এলাকায় জলাতঙ্ক ও ধনুষ্টঙ্কারের টিকা পাঠানো হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ওষুধের ভ্রাম্যমাণ দোকান বসানো হচ্ছে।
সুযোগে লুটপাট
এদিকে মানবিক সংকটময় পরিস্থিতিতে নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সুযোগ নিচ্ছে দুষ্কৃতকারীরা। সেখানে লুটপাটের ঘটনা ঘটছে। তুরস্কের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত শহর আনতাকিয়ায় এমন ঘটনা ঘটছে। সেখানকার একটি এলাকায় উদ্ধারকাজ শেষের পর ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে নেওয়া শুরু হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অনেক বাড়ি ও দোকানে লুটপাটের ঘটনা ঘটছে। সেখানকার এক ব্যবসায়ী বলেন, চুরির ভয়ে তিনি দোকান থেকে জিনিসপত্র সরিয়ে নিয়েছেন।
আবার ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি ও দোকানে যাতে লুটপাট না হয়, সেই জন্য পাহারা বসিয়েছেন অনেকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে টহল জোরদার করেছে পুলিশ ও সেনাবাহিনী।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান লুটপাটকারীদের আইনের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর এ ঘোষণার পর বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তারও হয়েছেন। তবে এর পরেও লুটপাটের ঘটনা ঘটছে।
এ ছাড়া নিরাপত্তাঘাটতির কারণে তুরস্ক থেকে দেশে ফিরে গেছে ইসরায়েলের উদ্ধারকারী দল। জার্মানির দলও চলে যাচ্ছে।
তুরস্কের ৮০০০ কোটি ডলার
এএফপি জানায়, এর আগে বলা হয়েছিল তুরস্কে ৬ হাজার ভবন ধসে পড়েছে। এখন তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতায় জানাচ্ছেন, দেশটির এক লাখ আট হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া দেশটির আর্থিক ক্ষতির একটি হিসাব দিয়েছে ব্যবসায়ীদের সংগঠন এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড বিজনেস কনফেডারেশন। তারা বলছে, ভূমিকম্পের কারণে ক্ষতির মূল্যমান ৮ হাজার ৪১০ কোটি মার্কিন ডলার। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই ক্ষতির পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি ডলার।
কনফেডারেশন জানিয়েছে, ভূমিকম্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি পুননি৴র্মাণে খরচ হবে ৭০ হাজার কোটি ডলার।
তুরস্কে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ১ কোটি ৩৪ লাখ মানুষের বসবাস, যা মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ।
নিরাপত্তা পরিষদের উদ্যোগ চায় যুক্তরাষ্ট্র
তুরস্কে ত্রাণ সরবরাহে তেমন বাধা না থাকলেও সিরিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোয় বাধা দিচ্ছেন বিদ্রোহীরা। সেখানকার ইদলিব প্রদেশের একটি বড় অংশ প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এসব এলাকায় ত্রাণ ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এ ছাড়া নিরাপত্তার কারণে এসব এলাকায় সীমান্ত বন্ধ রেখেছে তুরস্ক। ফলে চাইলেও অনেক এলাকায় প্রবেশ করতে পারছেন না ত্রাণ সরবরাহকারীরা।
এ অবস্থার বদল চেয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাসের আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা চাইছে, পরিষদে এমন প্রস্তাব পাস করা হোক, যাতে তুরস্ক ওই সব এলাকার আরও সীমান্ত খুলে দেয় এবং বিদ্রোহীনিয়ন্ত্রিত এলাকায় ঢোকার অনুমোদন পায় ত্রাণ সবরাহকারীরা।
এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের দূত লিন্ডা থমাস–গ্রিনফিল্ড বলেন, ‘এখন প্রতিটি ঘণ্টা গুরুত্বপূর্ণ। সেখানকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। আমরা তাঁদের হতাশ করতে পারি না।’
তবে এতে বাগড়া দিচ্ছেন বিদ্রোহীরা। তাঁরা বলছেন, ভূমিকম্পকে ব্যবহার করে আসাদ সরকারকে কোনো রাজনৈতিক সুযোগ নিতে তাঁরা দেবেন না।
গতকাল জাতিসংঘের পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হয়েছে, বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার জন্য তারা সাহায্য করবে। এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের জরুরি ত্রাণসহায়তা প্রধান মার্টিন গ্রিফিথস বলেন, ‘সিরিয়ার উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলে ত্রাণ পৌঁছাতে আমরা সাহায্য করব।’
এখনো জীবিত উদ্ধার
এদিকে তুরস্ক থেকে গতকালও বেশ কয়েকজনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল হাতায় প্রদেশে ভূমিকম্পের ১৭৫ ঘণ্টার পর এক নারীকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া হাতায়ের আনতাকিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে থেকে ১৬৭ ঘণ্টা পর এক পুরুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। ১৭৮ ঘণ্টা পর ৭০ বছর বয়সী এক নারীকে উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া রোববারও বেশ কয়েজনকে উদ্ধার করা হয়।
তবে মাঝেমধ্যে এমন জীবিত উদ্ধারের খবর পাওয়া গেলেও উদ্ধার অভিযানে অধিকাংশ সময় মিলছে মৃতদেহ। এ প্রসঙ্গে মার্টিন গ্রিফিথস বলেন, উদ্ধার অভিযান শেষ করার সময় চলে এসেছে। এর বদলে যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের খাবার ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করার প্রতি নজর দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। এ ছাড়া শিশুদের পড়াশোনার ব্যবস্থা ও যাঁরা দুর্বিষহ ঘটনার মধ্য দিয়ে গেছেন, তাঁদের মনঃসামাজিক অবস্থার উন্নতির লক্ষে৵ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন মার্টিন।