জীবন বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা, তবু অসহায় উদ্ধারকারী ও আটকে পড়ারা
তুরস্কের আদিয়ামান শহরের বাসিন্দা আলী উনলু। গতকাল সোমবার ভোরে ভূমিকম্পের পরপরই মায়ের বাসার দিকে ছুটেছিলেন তিনি। গিয়ে দেখতে পান, বাসাটি ধসে পড়েছে। আর তাঁর মা চাপা পড়েছেন এর নিচে। এরপর ২৪ ঘণ্টা পেরিয়েছে। মা এখনো সেখানেই আটকা পড়ে আছেন। আলী জানেন না, তিনি আদৌ বেঁচে আছেন কি না।
আদিয়ামান শহরটি ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল কাহরামানমারাস শহরের খুবই কাছে। ফলে সেখানে ক্ষয়ক্ষতিটা বেশি হয়েছে। একে তো এই অঞ্চলে পড়েছে তীব্র শীত, ভূমিকম্পের পর আবার দেখা দিয়েছে খাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অভাব। ইন্টারনেট ও টেলিফোনে ঠিকমতো যোগাযোগও করা যাচ্ছে না। এরপর মড়ার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে উদ্ধারকাজ ঘিরে নানা সমস্যা।
যেমন বলা যায় আলী উনলুর কথাই। যখন দেখলেন, মা ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছেন, তখন তিনি উদ্ধাকারী দলের জন্য অপেক্ষা শুরু করেন। তবে অনেকটা সময় কেটে গেলেও তাদের দেখা মেলেনি। উদ্ধার-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ফোন দিলেও সংযোগ পাননি। পরে নিজেরাই উদ্ধারকাজে নামেন। এক আত্মীয়কে উদ্ধারও করেছেন। তবে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে মাকে এখনো বের করতে পারেননি।
তুরস্ক ও সিরিয়ায় এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৫ হাজার ২১ জনের। সংখ্যাটা দ্রুত বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ভূমিকম্পের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়াতে পারে।
আলী উনলুর ঘটনা তুরস্কের উপদ্রুত এলাকার মানুষের দুর্ভোগের ছোট একটি চিত্রমাত্র। তুরস্কের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে প্রায় ৬৫০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এখন ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞ। এসব এলাকায় ৫ হাজার ৭৭৫টি ভবন ধসে পড়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির সরকার। তুরস্ক ও সিরিয়ায় এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৫ হাজার ২১ জনের। সংখ্যাটা দ্রুত বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ভূমিকম্পের কারণে মৃত্যু ২০ হাজার ছাড়াতে পারে।
সোমবার ভোরে তুরস্ক ও সিরিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে আঘাত হানা ভূমিকম্পটি ছিল ৭ দশমিক ৮ মাত্রার। এর পর থেকে আরও কয়েকটি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। আজ মঙ্গলবার সকালে তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতে বলেছেন, দেশটিতে এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ৪১৯ জন মারা গেছেন, আহত হয়েছেন আরও ২০ হাজার ৫৩৪ জন। অন্যদিকে সিরিয়া জানিয়েছে, দেশটিতে ১ হাজার ৬০২ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে।
গতকালের ভূমিকম্পে সিরিয়ায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা দেশটিতে ১১ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধের চেয়ে বেশি। সেখানেও শীত উদ্ধারকাজ চালাতে এবং সহায়তা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটি বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
সব মিলিয়ে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এত বেশি আর আবহাওয়া এতটাই প্রতিকূল যে উদ্ধারকাজে নেমে হিমশিম খাচ্ছে উদ্ধারকারী দলগুলো। যেমন তুরস্কের বেসরকারি উদ্ধারকারী সংস্থা একেইউটি। গতকালের ভূমিকম্পকে একটি ‘বিপর্যয়’ বলে উল্লেখ করছেন সংস্থাটির সমন্বয়কারী মুরাত হারুন অনগোরেন। তিনি বলেন, তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলের বিশাল অংশজুড়ে ধ্বংসলীলা চলেছে, রাস্তাঘাটের অবস্থা খারাপ, তারপর আবার আবহাওয়া এত ঠান্ডা যে জমে যাওয়ার মতো। এতে উদ্ধারকারীদের সেখানে পৌঁছাতে বড় সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে।
প্রতি ঘণ্টা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া লোকজনের ঝুঁকি বাড়ছে বলে মনে করেন মুরাত হারুন। তবে তিনি এ-ও বলেছেন, এত বিপর্যয়কর একটি ভূমিকম্পের পর প্রথম ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মানুষের কাছে পুরো সাহায্য পৌঁছানো সহজ বিষয় নয়। এই সময়ের মধ্যে উদ্ধারকারী দলগুলোর মধ্যে সমন্বয় আনা, তাদের ঘটনাস্থলে পৌঁছানো এবং লজিস্টিক-সংক্রান্ত বিষয়গুলো সাজানো বেশ কঠিন একটি কাজ।
উদ্ধারকাজ নিয়ে অভিযোগের বিষয়ে কথা বলেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানও। তাঁর ভাষায়, প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়েছে, তারপর ভূমিকম্পটা হয়েছে রাতে। এতে সবকিছু আরও জটিল হয়ে গেছে। এরপরও সবাই সবকিছু উজাড় করে দিয়ে মানুষকে সাহায্য করছেন।
আমি খুবই ক্ষুব্ধ। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে মানুষ ভালোবাসার ব্যক্তিদের বের করার চেষ্টা করছেন। এদিকে শীতও পড়েছে, বৃষ্টি হচ্ছে। আবার বিদ্যুৎ নেই। এরই মধ্যে পরিবারের সদস্যের উদ্ধারের জন্য লোকজন ঘণ্টার পর ঘণ্টা উদ্ধারকারীদের জন্য অপেক্ষা করছেন
উদ্ধার তৎপরতায় ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করছেন ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ গোনুল তোল। তিনি বলেন, ‘আমি খুবই ক্ষুব্ধ। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে মানুষ ভালোবাসার ব্যক্তিদের বের করার চেষ্টা করছেন। এদিকে শীতও পড়েছে, বৃষ্টি হচ্ছে। আবার বিদ্যুৎ নেই। এরই মধ্যে পরিবারের সদস্যদের উদ্ধার করতে লোকজন ঘণ্টার পর ঘণ্টা উদ্ধারকারীদের জন্য অপেক্ষা করছেন।’
গতকালের ভূমিকম্পে সিরিয়ায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা দেশটিতে ১১ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধের চেয়ে বেশি। সেখানেও শীতে উদ্ধারকাজ এবং সহায়তা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটি বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কর্মকর্তা এল মোস্তাফা বেনলামলিহ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘অবকাঠামোগুলো ভেঙে গেছে। যে রাস্তা ব্যবহার করে আমরা আগে সহায়তা চালাতাম, সেগুলোর অবস্থা খারাপ। তবে সাহায্য পৌঁছে দিতে আমরা কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছি।’
এদিকে বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত উত্তর সিরিয়ায় গতকাল সারা রাত ধরে উদ্ধারকাজ চালিয়েছেন উদ্ধাকারীরা। তাঁদের একদল ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে হতাহতদের বের করতে হাত লাগিয়েছে। আরেক দল বৃষ্টির মধ্যে লোকজনের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছে।
পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, তা তুলে ধরতে গিয়ে সিরিয়ার উদ্ধারকারী দল হোয়াইট হেলমেটসের মুখপাত্র ওবাদাহ আলওয়ান বলেন, ‘ভূমিকম্পটা হলো সবচেয়ে খারাপ এক সময়ে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে আশ্রয় নেওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। এখন বৃষ্টি হচ্ছে। আর আমাদের সহকর্মীরা হাড়কাঁপানো শীতের মধ্যে উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।’
হোয়াইট হেলমেটসের কাছে উদ্ধারকাজের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সরঞ্জাম এবং সেগুলো চালাতে জ্বালানি তেলের ঘাটতি রয়েছে বলে জানালেন ওবাদাহ আলওয়ান। এতে পুরোদমে উদ্ধারকাজ চালানো যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় জরুরি অবস্থায় এগিয়ে আসার মতো বলতে গেলে শুধু হোয়াইট হেলমেটসই রয়েছে। আর আমরা একটি বেসরকারি সংস্থা। তাই এই পর্যায়ের বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য অবশ্যই আমাদের কাছে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম থাকার কথা নয়।’
ভূমিকম্পের পর তুরস্ক ও সিরিয়াকে সহায়তায় এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন দেশের সরকার। মানবিক সহায়তার পাশাপাশি উদ্ধারকাজের জন্য দরকারি সরঞ্জাম পাঠাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা। প্রতিশ্রুতি এসেছে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে। তুরস্ক বলছে, ৪৫টি দেশ থেকে তারা সহায়তার আশ্বাস পেয়েছে। আর সিরিয়া সরকারের ভাষ্য, বিদেশ থেকে আসা সাহায্য দেশের সব মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে তারা। তবে এ ক্ষেত্রে সমস্যার বিষয়টি হলো, সিরিয়া সরকারের দেশের সব অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই।
তবে সব প্রতিকূলতার মধ্যে উদ্ধারকাজ চলছে। মাঠে নামছেন তুরস্কের অনেক সাধারণ মানুষও। যেমন ২৫ বছর বয়সী নার্স নিহাল আতাসয়। উদ্ধারকাজে যোগ দিতে দেশটির আদানা শহরে যাওয়ার আগে বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। তুরস্কের ওসমানিয়ার বাসিন্দা এই নারী বলেন, ‘ভূমিকম্পের পর আমি বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত যখন পেলাম, তারা বলল, তাদের বাসা ধ্বংস হয়ে গেছে। এরপর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, উদ্ধারকাজে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার।
সত্যি বলতে কি, আমি জানি না, যখন আদানায় পৌঁছাব, আমি কী করব। সেখানে গিয়ে উদ্ধারকাজে হাত লাগাতে পারি, আবার নার্স হিসেবে হাসপাতালেও কাজ করতে পারি।’