তুরস্কে ভূমিকম্প: ধসে পড়া ভবনে আগুন, হাড় ছাড়া পাওয়া গেল না কিছুই

ভূমিকম্পের ধসে পড়া ভবনের পাশে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন একজন
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ভূমিকম্পের পর ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েও বেঁচে ছিলেন তাঁরা। বিপর্যয়ের পরপরই যাঁরা উদ্ধারকাজে নেমেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগও করছিলেন। আশা ছিল জীবন নিয়ে ফিরতে পারবেন। তবে এক দিন গড়াতে না গড়াতেই সেই আশাটুকুও মিইয়ে গেল। ওই ভবনে লাগল ভয়াবহ আগুন। তার পর থেকে সবকিছু নিস্তব্ধ। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে আসেনি আর কোনো সাড়া।

ঘটনাটি তুরস্কের ভূমিকম্পকবলিত আনতাকিয়া শহরের। ওই শহরের বাসিন্দা এরদেম আভসারোগলু। ওপরে যাঁদের কথা বলা হয়েছে, তাঁরা আভসারোগলুর বোন, তাঁর স্বামী ও দুই শিশুসন্তান। তাঁদের ভবনটিতে আগুন লেগেছিল ভূমিকম্পের পরদিন, অর্থাৎ ৭ ফেব্রুয়ারি। এর পাঁচ দিন পর গতকাল রোববার ওই ভবনের ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করেছেন উদ্ধারকর্মীরা।

তবে সেখানে প্রিয় মানুষগুলোকে খুঁজে পাবেন, এমন আশা আগেই হারিয়েছেন আভসারোগলু। তিনি বলেন, ‘আজ ভূমিকম্পের পর সপ্তম দিন। উদ্ধারকাজে নামা সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। এখন আমাদের চাওয়াটা হলো যেন মরদেহগুলো অক্ষত অবস্থায় পাই। তবে তেমন কিছুই খুঁজে পাইনি। মনে হয় সবাই আগুনে পুড়ে গেছে।’

ওই ভবনে ৮০ জন বাস করতেন। আগুন লাগার আগে সেখান থেকে ২১ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছিল, পাওয়া গিয়েছিল ১২টি মরদেহ। নিখোঁজ ছিলেন ৪৭ জন। পরে উদ্ধার করা মরদেহগুলোর অবস্থা দেখে ক্ষোভ সামলাতে পারছেন না পরিবারের সদস্যরা। কেমন অবস্থা? আভসারোগলুর ভাষায়, ‘আগুনে পুড়ে যাওয়ার কারণে কাছের মানুষগুলোর শুধু হাড় খুঁজে পেয়েছে অনেক পরিবার।’

সমস্যা কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ভূমিকম্পের পর আনতাকিয়া শহরে দেখা দিয়েছে খাদ্যসহ নানা জরুরি পণ্যের তীব্র সংকট। ফলে লুটপাটের ঘটনা বেড়েছে।

মৃত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের মতোই ক্ষুব্ধ উদ্ধারকারীরাও। তাঁদের প্রশ্ন, কীভাবে মাত্র ১০ বছর আগে নির্মাণ করা একটি ভবন ধসে পড়তে পারে, যেখানে আশপাশের অনেক পুরোনো ভবন এখনো টিকে আছে। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা পাঠানো নিয়েও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এমনই একজন উদ্ধারকারী সেরহাত দেদে। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উদ্ধার করা তাঁর বাবার মরদেহের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে শুধু দাঁত দেখে শনাক্ত করতে পেরেছেন তিনি। দেদে বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছ থেকে এক সপ্তাহ ধরে কোনো সহায়তা (উদ্ধার সরঞ্জাম) পাইনি। যদি সহয়তা পেতাম, তাহলে আরও ৪০ থেকে ৫০ জনকে জীবিত উদ্ধার করতে পারতাম।’

তুরস্ক ও সিরিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ৬ ফেব্রুয়ারি দুটি শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়। প্রথমটি ছিল ৭ দশমিক ৮ মাত্রার, পরেরটি ৭ দশমিক ৫ মাত্রার। ভূমিকম্পে শুধু তুরস্কে এখন পর্যন্ত ৩০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সিরিয়ায় মারা গেছেন সাড়ে চার হাজারের বেশি মানুষ। দুই দেশেই হাজার হাজার ভবন ধসে পড়েছে। টিকে থাকা অনেক ভবনের অবস্থাও খুবই নাজুক।

২৭ বছরের রাবিয়া অফকেলিকে উদ্ধার করে আনছেন উদ্ধারকারীরা। নিখোঁজ অনেককে এভাবে ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে আনছেন উদ্ধারকর্মীরা। হাতায়, তুরস্ক, ১০ ফেব্রুয়ারি
ছবি: রয়টার্স
আরও পড়ুন

আনতাকিয়া শহরে ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলাটা বেশি হয়েছে। কারণ, শহরটি বহু পুরোনো। ঐতিহাসিকভাবে শহরটি আন্তিওচ নামে পরিচিত। শহরে যে দিকেই চোখ যায়, শুধু ধসে পড়া ভবনের স্তূপ। ফলে ক্ষয়ক্ষতিটা আদতে কতটা হয়েছে, তা পরিমাণ করা কঠিন। আর টিকে থাকা অনেক ভবনে ফাটল ধরেছে, আংশিক ধ্বংস হয়েছে, নাহয় হেলে পড়েছে।

সহায়তাকর্মীরা মানুষের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করছিলেন। অনুদান হিসেবে পাওয়া খাবার, পোশাক, ওষুধ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী সামলাচ্ছিলেন। অনেকে আবার মোটরসাইকেল নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন জরুরি এই সামগ্রী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।

ভবন ধসে পড়ায় শহরটিতে অনেকে এখন পুরোপুরি বাস্তুহীন। অনেকে আবার টিকে থাকা বাড়িগুলোতে ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছেন, আশঙ্কা, যদি সেগুলো ভেঙে পড়ে। ফলে বহু বাসিন্দা শহরটি ছেড়ে চলে গেছেন। আর যাঁরা রয়ে গেছেন, তাঁরা বসবাস করছেন গাড়িতে, অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে অথবা সহায়তা হিসেবে পাওয়া তাঁবুতে।

সমস্যা এখানেই শেষ নয়। ভূমিকম্পের পর আনতাকিয়া শহরে দেখা দিয়েছে খাদ্যসহ নানা জরুরি পণ্যের তীব্র সংকট। ফলে লুটপাটের ঘটনা বেড়েছে। বলা যায় আভসারোগলু ও তাঁর মতো বেশ কয়েকজনের কথা। যে ভবনে আভসারোগলুর বোন থাকতেন, সেখানে আগুন লাগার পর থেকে পাহারা দিতে হয়েছে তাঁদের। তবে রোববার থেকে সেনাবাহিনী রাস্তাঘাটে টহল দেওয়ায় নিরাপত্তাব্যবস্থা অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে।

আরও পড়ুন

‘নিজেদের সবকিছু সামলাতে হচ্ছে’

তুরস্কের আরেকটি ভূমিকম্পকবলিত শহর ইসকেনদেরুন, অবস্থান আনতাকিয়ার কাছেই। ওই শহরের বাসিন্দা সেরিজান আগবাস। তাঁর একটি কাপড়ের ছোট দোকান ছিল। ওই দোকানের আয় থেকে পরিবারের পেট চালাতেন তিনি। দোকানটি এখন ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়েছে। আগবাস যে ভবনে বসবার করতেন, সেটি টিকে আছে, তা-ও খারাপ অবস্থায়।

তুরস্কে যেসব অঞ্চলে ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে, সেগুলোর মোট আয়তন ব্রিটেনের সমান। এসব অঞ্চলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আনুমানিক ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ। তুরস্ক সরকার বলছে, বিপর্যয়ের মাত্রা অনুযায়ী তারা সর্বোচ্চ সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করছে। আর দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ঘোষণা দিয়েছেন, এক বছরের মধ্যে তিনি উপদ্রুত এলাকাগুলো আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনবেন।

তবে সরকারি সহায়তা নিয়ে তেমন কোনো আশা নেই ইসকেনদেরুন শহরের বাসিন্দাদের। এ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে আগবাস বলছিলেন, ‘আমাদের পুরো জাতির কাছ থেকে মানসিক সহায়তা দরকার। সরকারের কাছ থেকে কেউ কিছু আশা করছে না। নিজেদের সমস্যা নিজেদেরই সামলাতে হচ্ছে।’

ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় শত শত ভবনধস হয়েছে। আর এসব ভবনের নিচে আটকা পড়ে আছে মানুষ
ছবি: এএফপি
আরও পড়ুন

তবে গতকাল আনতাকিয়া শহরে ভূমিকম্পকবলিত লোকজনকে সহায়তায় তৎপর থাকতে দেখা গেছে সরকারি বিভিন্ন দলকে। পাশাপাশি কাজ করছিলেন সাধারণ মানুষদের নিয়ে গড়ে তোলা বিভিন্ন দলও। তাঁরা আশ্রয়ের ব্যবস্থা করছিলেন। অনুদান হিসেবে পাওয়া খাবার, পোশাক, ওষুধ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী সামলাচ্ছিলেন। অনেকে আবার মোটরসাইকেল নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন জরুরি এই সামগ্রী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।

এই সহায়তাকাজে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে হাত লাগিয়েছেন হালিল উনসাল। তিনি আইনের একজন ছাত্র। হালিল উনসাল বলেন, ‘সহায়তাকারী বিভিন্ন দলের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবকদের সমন্বয় করাটা বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। তবে পরিস্থিতি দিন দিন ভালো হচ্ছে। আসল কথাটা হলো, এখানে আর বেশি স্বেচ্ছাসেবকের দরকার নেই। যা দরকার, তা হলো সহায়তার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, এমন লোকজন। তাঁরা তুরস্কের বাইরের মানুষও হতে পারেন। এটা দরকার; কারণ, দুর্যোগটা খুবই বিশাল।’

আরও পড়ুন