মিয়ানমারে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি জান্তা, বছর শেষে সংঘাত তীব্র
মিয়ানমারে সামরিক জান্তা ২০২১ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। আগের দুই বছরের মতো ২০২৩ সালও ছিল সহিংসতাপূর্ণ ও অস্থিতিশীল। বছরজুড়েই জান্তা সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘাতের ঘটনা দেখা গেছে। বছরের শেষ প্রান্তভাগে চীনের সীমান্তবর্তী শান ও রাখাইন রাজ্যে জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে জান্তা বাহিনী। ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর জান্তা বাহিনী এত বড় চ্যালেঞ্জের মুখে আগে পড়েনি।
চলতি মাসের শুরুর দিকে চীনের মধ্যস্থতায় আলোচনার মধ্য দিয়ে জান্তা বাহিনী ও জাতিগত তিনটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে’ সম্মত হলেও বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ চলছেই। এতে অসংখ্য মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন।
জান্তা সরকার ২০২৩ সালে মিয়ানমারে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিলেও শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করেনি। গত আগস্টে তারা নির্বাচন আয়োজন করবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল।
কথা রাখেনি জান্তা
মিয়ানমারে সবশেষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০২০ সালের নভেম্বরে। ওই নির্বাচনে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিপুল ভোটে জয় পায়। তবে পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতেই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। জান্তার পক্ষ থেকে এনএলডির বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ আনা হয়। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে জান্তা সরকার চলতি বছরের আগস্টে মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গত জানুয়ারিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধনের জন্য ৬০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেয় জান্তা সরকার। তবে এ নির্বাচন স্বচ্ছ ও অবাধ হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে জান্তাবিরোধীরা। মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির দল এনএলডি নিবন্ধন করা থেকে বিরত থাকে।
জান্তা–নিয়ন্ত্রিত মিয়ানমারের নির্বাচন কমিশন গত মার্চে জানিয়ে দেয়, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন না করায় এনএলডিকে রাজনৈতিক দলের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তাই দলটি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।
তবে গত ৩১ জুলাই মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া ঘোষণায় জান্তার পক্ষ থেকে বলা হয়, দেশে জরুরি অবস্থার মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়বে এবং নির্বাচন কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। মিয়ানমারজুড়ে চলমান সহিংসতার জেরে নির্বাচন বিলম্বিত হচ্ছে। দেশের অবস্থা স্থিতিশীল হলেই কেবল নির্বাচন দেওয়া হবে।
বন্দিদশায় সু চি, কমেছে কারাবাসের মেয়াদ
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে। এর পর থেকে মিয়ানমারের নির্বাচিত এই নেত্রী সামরিক বাহিনীর হেফাজতে আছেন। এক বছর ধরে জান্তার আদালতে সু চির বিরুদ্ধে বিচারকাজ চলেছে। ২০২৩ সালের শুরুতে সেই বিচারকাজ শেষ হয়। সু চির বিরুদ্ধে করা বিভিন্ন মামলায় মোট ১৯টি অপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এসব অভিযোগের মধ্যে আছে নির্বাচনী প্রচারকালে কোভিড-১৯ বিধি ভঙ্গ করা, অবৈধভাবে বেতার সরঞ্জাম রাখা, উসকানি, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা আইন লঙ্ঘন এবং দেশের নির্বাচন কমিশনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা। এসব অভিযোগে তাঁর মোট ৩৩ বছরের কারাদণ্ড হয়।
গত ১ আগস্ট মিয়ানমারের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমে বলা হয়, বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের একটি ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে দেশটির জান্তা সরকার সাত হাজারের বেশি কারাবন্দীকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে। এর আওতায় সু চিও পড়েছেন। তাঁকে পাঁচ মামলায় সাধারণ ক্ষমা করা হয়। ফলে তাঁর কারাবাসের মেয়াদ ছয় বছর কমেছে। এর আগে জুলাইয়ের শেষের দিকে সু চিকে কারাগার থেকে সরিয়ে নেপিডোতে গৃহবন্দী অবস্থায় রাখা হয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়।
সংঘাত তীব্রতর
২০২১ সালে সু চির দলকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসার পর থেকে সামরিক জান্তা মিয়ানমারের বিদ্রোহীদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। গত অক্টোবরে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একজোট হয় সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) ও তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ)। জোটটি পরিচিতি পেয়েছে ‘থ্রি ব্রাদার্স অ্যালায়েন্স’ নামে। অপারেশন ১০২৭ নামের এ অভিযান শুরু হয় গত ২৭ অক্টোবর। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত সশস্ত্র এই গোষ্ঠী দ্রুত মিয়ানমারের উত্তর দিককার রাজ্য শানের সামরিক ঘাঁটি এবং মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যপথের উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে নেয়। ইতিমধ্যে এ অভিযানের দুই মাস পেরিয়েছে।
এ ছাড়া গত মাসে রাখাইনে সামরিক ফাঁড়ি ও নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থান নিশানা করে হামলা শুরু করে আরাকান আর্মি। এরপর জান্তা সেনারা পাল্টা হামলা শুরু করলে সেখানেও দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘাত শুরু হয়।
গত মাসে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের প্রেসিডেন্ট মিয়ন্ত সুয়ে বলেছেন, চীনের সঙ্গে সীমান্ত অঞ্চলে সহিংসতা দমনে অকার্যকর ব্যবস্থাপনার কারণে মিয়ানমার রাষ্ট্র হিসেবে ভেঙে যেতে পারে।
২৯ ডিসেম্বর চীনের দূতাবাস তাদের উইচ্যাট অ্যাকাউন্টে বলেছে, শান রাজ্যের লাউক্কাই জেলায় সংঘর্ষ চলছেই। সেখানে থাকা লোকজনের নিরাপত্তাঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় দূতাবাস আবারও তার নাগরিকদের যত দ্রুত সম্ভব লাউক্কাই জেলা থেকে সরে যেতে বলছে।
মিয়ানমারে সামরিক জান্তা এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও গণতন্ত্রপন্থী বিদ্রোহীদের মধ্যে লড়াইয়ের প্রভাব পড়ছে উত্তর-পূর্ব ভারতেও। মিয়ানমারে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অন্যদের লড়াইয়ের জেরে সাধারণ মানুষ ও সেনাবাহিনীর অনেকেই সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের জঙ্গলে আশ্রয় নিচ্ছেন। সেখান থেকে তাঁদের মণিপুরে এনে ফেরত পাঠাচ্ছে ভারত।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক চাপ
২০২৩ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। প্রস্তাবটি যৌথভাবে উত্থাপন করে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এবারের প্রস্তাবে ১১৪টি দেশ সহপৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে, যা এযাবৎ সর্বোচ্চ। মিয়ানমারের অবনতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে প্রস্তাবে রোহিঙ্গা সংকটের মূল কারণগুলো উদ্ঘাটন করতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের স্বপ্রণোদিত, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইনে অনুকূল পরিবেশ তৈরিরও আহ্বান জানানো হয়।
চলতি বছরের নভেম্বরে কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাজ্য যৌথভাবে এবং মালদ্বীপ এককভাবে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা গণহত্যার মামলায় পক্ষভুক্ত হতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) আবেদন করেছে। আইসিজে জানিয়েছে, এসব দেশ ১৯৪৮ সালের গণহত্যার অপরাধ প্রতিরোধ ও সাজাবিষয়ক সনদের স্বাক্ষরকারী হিসেবে এ মামলায় পক্ষভুক্ত হওয়ার অধিকার রাখে।
এর আগে ২০২৩ সালের জুনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আদালতে প্রথমবারের মতো সশরীর সাক্ষ্য দিয়েছেন সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ের কয়েক প্রতিনিধি। মিয়ানমারের জান্তার বিরুদ্ধে রোহিঙ্গানিধনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আর্জেন্টিনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের অংশ হিসেবে বুয়েনস এইরেসের একটি আদালতে এ সাক্ষ্য নেওয়া হয়। আর্জেন্টিনা তাদের সংবিধানের সর্বজনীন নীতির আওতায় এ বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর উদ্যোগ নেয়।
বেড়েছে বাস্তুচ্যুতদের সংখ্যা
মিয়ানমারে ২০২৩ সালে সংঘাতের জেরে নতুন করে আরও অনেক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বিশেষ করে গত অক্টোবরের শেষ থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয় দপ্তরের (ওসিএইচএ) প্রতিবেদনে বলা হয়, অক্টোবরের শেষ থেকে নতুন করে ৬ লাখ ৬০ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এতে মোট বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ২৬ লাখ ছাড়িয়েছে। ওসিএইচএর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আগামী বছর মিয়ানমারের জনগণের এক-তৃতীয়াংশের জন্য, অর্থাৎ ১ কোটি ৮৬ লাখ মানুষের জন্য মানবিক সহায়তার দরকার হবে। এ জন্য খরচ হবে ৯৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার। চলতি বছর সহায়তা বাবদ যে পরিমাণ তহবিল পাওয়া গেছে, তা ৯৯ কোটি ৪০ লাখ ডলারের মাত্র ২৯ শতাংশ।
সম্প্রতি এক বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটির বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নির্বিচার হামলা চালাচ্ছে। একই সঙ্গে জাতিগত সংখ্যালঘু বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ক্লাস্টার বোমাও ব্যবহার করছে তারা। তাই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠনটি।
তথ্যসূত্র: এএফপি, রয়টার্স, আল–জাজিরা, ইরাবতী, নিক্কেই, সিএনএন