বিদেশ থেকে নেওয়া ঋণের সংকট শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জনরোষ জন্ম দিয়েছে। কয়েক মাস ধরে চলা সরকারবিরোধী বিক্ষোভ গত ৯ জুলাই নাটকীয় মোড় নেয়। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের রুখতে ব্যর্থ হয়। বিক্ষোভকারীরা দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে ও প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের বাসভবনে ঢুকে পড়েন। গোতাবায়া ইতিমধ্যে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন। পদত্যাগ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেও। এতে সর্বদলীয় সরকার গঠনের পথ খুলেছে। এ ধরনের সরকার গঠিত হলে তাদের প্রধান কাজ হবে দেশটির অর্থনীতির শৃঙ্খলা ফেরানো, ঋণদাতাদের সঙ্গে ঋণ পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনা করা এবং আর্থিক সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা এগিয়ে নেওয়া।
আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক থেকে যেকোনো সাহায্য দেওয়ার আগে তা যেন অব্যবস্থাপনার মধ্যে না পড়ে, সে বিষয়ে কঠোর শর্ত দিতে হবে।
গত বুধবার শ্রীলঙ্কা ছেড়ে পালিয়েছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে রয়েছেন। তাঁর নতুন দায়িত্ব পাওয়ার পর দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণার পাশাপাশি রাজধানী কলম্বো ও আশপাশের এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়েছে। পার্লামেন্টের স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেবর্ধনে বলেছেন, ২০ জুলাই নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে পারে। এ পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কায় সামনে কী ঘটতে পারে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
শ্রীলঙ্কার জনগণ কেন বিক্ষোভ করছেন
শ্রীলঙ্কার বেহাল অর্থনীতির কারণেই সরকারের প্রতি জনগণের ক্ষোভ ক্রমাগত বেড়েছে। খাদ্যের দাম ক্রমাগত বেড়েছে। বিদ্যুৎ না থাকা, তেল–গ্যাসের জন্য লাইনে দাঁড়ানো মানুষের দৈনন্দিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রান্তিক মানুষের জন্য এ পরিস্থিতি অসহনীয় পর্যায়ে ঠেকেছে। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, ক্ষমতাধর রাজাপক্ষে পরিবারের স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির কারণেই এই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে।
অর্থনৈতিক সংকটের নেপথ্যে কী
করোনা মহামারির কারণে দেশটির পর্যটন খাত থেকে আসা আয় কমে গেছে। এ ছাড়া বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে বড় ধাক্কা দিয়েছে। তবে দেশটির এই আর্থিক সংকটের পরিস্থিতি আগে থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল। বিশেষ করে অবকাঠামোগত ব্যয়ের জন্য করা ঋণ ও সরকারি রাজস্ব আসে, এমন খাতে কর কমানোর ফলে আর্থিক ব্যবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। এ ছাড়া গত বছর অকস্মাৎ রাসায়নিক সার নিষিদ্ধ করার কারণে কৃষি খাত বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। শীর্ষ অর্থনীতিবিদেরা কয়েক মাস ধরেই শ্রীলঙ্কাকে ঋণ খেলাপি হওয়ার বিষয়ে সতর্ক করে আসছিলেন।
সরকার কী করছে
এ নিয়ে ষষ্ঠবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন বিক্রমাসিংহে। বিক্ষোভকারীদের রাজাপক্ষে সাম্রাজ্যের অবসানের দাবির মুখে সরকারের পক্ষে আস্থা ফেরাতে ও অর্থনীতি উদ্ধারে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে একটি হচ্ছে বিক্রমাসিংহের নিয়োগ। এখন পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার এই দুরবস্থার মধ্যে ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দিয়েছে ভারত। আরও ভারতীয় সহায়তা নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে বিক্রমাসিংহে সতর্ক করেছেন, ভারত দীর্ঘদিন শ্রীলঙ্কাকে চালিয়ে নিতে পারবে না। জুনের শুরুতে জাতিসংঘে সহায়তার জন্য আবেদন শুরু করা হয়।
গত ১২ জুন বিক্রমাসিংহে এক সাক্ষাৎকারে বার্তা সংস্থা এপিকে বলেন, তিনি রাশিয়ার কাছ থেকে আরও বেশি ছাড়ের তেল কেনার কথা বিবেচনা করবেন, যাতে দেশটির সংকট কাটিয়ে ওঠা যায়।
দেশটির অর্থনীতিতে বড় ক্ষতি করেছে, এমন নীতিগুলো বাতিল করে আগের নীতিতে ফিরেছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে কর কমানোর বিষয়টি বাতিল করা ও রাসায়নিক সার আমদানি নিষিদ্ধ করার বিষয়গুলো রয়েছে। তবে এর প্রভাব পড়তে আরও সময় লাগবে।
সামনে কী
সংবাদপত্র কলম্বো টাইমস–এর সাম্প্রতিক একটি শিরোনাম ছিল ‘শ্রীলঙ্কার শেষ আশা টিকে রয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সহায়তার ওপর’। অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে সহায়তার জন্য সরকার আইএমএফের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করছে। গত ২২ জুন বিক্রমাসিংহে বলেন, চলতি মাসের শেষ দিকে প্রাথমিক চুক্তির বিষয়ে আশা করছেন তিনি। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে বিষয়টি নির্ভর করছে বিক্রমাসিংহের স্থলাভিষিক্ত কে হবেন এবং নতুন সরকার কেমন হবে, তার ওপর।
দেশটিতে রাজনৈতিক দুর্নীতিও একটি বড় সমস্যা। এটি কেবল রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট করার ক্ষেত্রেই ভূমিকা রাখে না, এটি শ্রীলঙ্কার জন্য যেকোনো আর্থিক উদ্ধারের পথকেও জটিল করে তোলে। শ্রীলঙ্কার নেতারা ২০ জুলাই নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিষয়ে সম্মত হয়েছেন। কিন্তু এখনো নতুন সরকারের বিষয়ে তাঁরা একমত হতে পারেননি।
ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের পলিসি ফেলো ও অর্থনীতিবিদ অনিত মুখার্জি বলেন, আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক থেকে যেকোনো সাহায্য দেওয়ার আগে তা যেন অব্যবস্থাপনার মধ্যে না পড়ে, সে বিষয়ে কঠোর শর্ত দিতে হবে।