সিডনির ইহুদি-অধ্যুষিত এলাকায় কেন হামলা চালানো হলো
অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বাংলাদেশি-অধ্যুষিত লাকেম্বা এলাকায় রয়েছে এ দেশের সবচেয়ে বড় মসজিদ ‘লাকেম্বা মসজিদ’। এখানে নামাজ পড়তে গিয়ে বাড়তি নিরাপত্তার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বাংলাদেশিসহ অন্যান্য দেশের মুসলমানদের। একই দৃশ্য সিডনির ছোট-বড় গির্জা আর অন্য ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়েও। পুলিশের কড়া নিরাপত্তা সত্ত্বেও এসব উপাসনালয়ে প্রার্থনাকারীদের সমাগম কম।
সিডনিতে ঘটে যাওয়া পরপর দুটি সন্ত্রাসী হামলার পর এমন পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। একটি গির্জায় উপাসনা চলাকালে একটি হামলার ঘটনা ঘটে। এর আগে ছুটির দিনে সিডনির জনপ্রিয় শপিং মলে ছুরিকাঘাতে ছয়জন নিহত হন। পুলিশের তথ্যমতে, ইতিমধ্যে লাকেম্বা মসজিদে বোমা হামলার হুমকিও পাওয়া গেছে।
গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় সিডনির ওয়াকলি এলাকার একটি গির্জায় প্রার্থনা চলাকালে গির্জার বিশপের ওপর ছুরি নিয়ে হামলা চালায় ১৬ বছর বয়সী এক কিশোর। এ সময় বিশপকে বাঁচাতে গিয়ে আরও চারজন আহত হন।
এর আগে শনিবার সিডনির বন্ডাইয়ের ওয়েস্টফিল্ড শপিং সেন্টারে ৪০ বছর বয়সী এক ব্যক্তির এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে ছয়জন নিহত হন। গুরুতর আহত হন আরও ১২ জন। এ সময় পুলিশের গুলিতে হামলাকারী নিহত হন। পরপর এই দুই হামলায় শোক আর আতঙ্কে আছেন সিডনির মানুষ।
গির্জায় হামলা
সিডনির শহরতলি ওয়েকলির ‘খ্রিস্ট দ্য গুড শেফার্ড চার্চ’ গির্জায় গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় প্রার্থনা চলছিল। এ সময় গির্জার বিশপ মার মারি ইমানুয়েল উপস্থিত প্রার্থনাকারীদের উদ্দেশে ধর্মীয় বক্তৃতা করছিলেন। উপাসনালয় থেকে সেই প্রার্থনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছিল। সন্ধ্যা সাতটার দিকে কালো মোটা জ্যাকেট পরিহিত এক কিশোর বিশপের দিকে স্বাভাবিকভাবে হেঁটে যায়। বিশপের কাছে পৌঁছেই পকেট থেকে ছুরি বের করে এলোপাতাড়ি তাঁকে আঘাত করতে থাকে।
এ সময় গির্জায় উপস্থিত ব্যক্তিরা এদিক-ওদিক ছোটাছুটি শুরু করেন। সামনের সারিতে বিশপের কাছাকাছি থাকা কয়েকজন তাঁকে বাঁচাতে এগিয়ে যান। এ সময় কিশোরের ছুরিকাঘাতে চার প্রার্থনাকারী আহত হন। তবে বিশপসহ আহত ব্যক্তিরা ঝুঁকিমুক্ত। হামলাকারী কিশোরকে আটকে তার দুই আঙুল কেটে দেন ক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা। পরে তাকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। এই হামলার এক সপ্তাহ আগে বিশপ মার মারি ইমানুয়েল হামলার হুমকি পেয়েছিলেন।
এই হামলার ঘটনায় ক্ষুব্ধ আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা গির্জার সামনে বিক্ষোভ করেন। তাঁরা পুলিশের ওপর হামলা চালান, পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করেন। পরে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করে বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।
পুলিশ হামলাকারীকে সরিয়ে নিয়েছে। তার পরিচয় গোপন রেখেছে পুলিশ। পরে রাজ্যের পুলিশ কমিশনার ক্যারেন ওয়েব জানিয়েছেন, এটি ‘সন্ত্রাসী’ হামলা। এর আগেও ওই হামলাকারীর অপরাধের রেকর্ড পুলিশের কাছে রয়েছে। ভালো ব্যবহারের শর্তে সে জামিনে ছিল।
শপিং মলে হামলা
সিডনির জনপ্রিয় সমুদ্রসৈকত বন্ডাই। স্থানীয় সময় শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সৈকতে বেশ ভিড় ছিল। ৩টা ২০ মিনিটের দিকে সমুদ্রসৈকতের কাছে ওয়েস্টফিল্ড বন্ডাই শপিং সেন্টারে তখন প্রায় এক ফুট লম্বা ছুরি নিয়ে ঢোকেন এক ব্যক্তি। এরপরই ওই ব্যক্তি এলোপাতাড়ি নয়জনকে ছুরিকাঘাত করেন। শপিং মলের ভেতর তখন মানুষের ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়। হামলাকারী ছুরিকাঘাত করে আরও ৯ জনকে আহত করেন।
ওই হামলায় ঘটনাস্থলে পাঁচজন ও হাসপাতালে নেওয়ার পর আরেকজন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে পাঁচজনই নারী। আর পুরুষ ব্যক্তি হচ্ছেন শপিং মলের নিরাপত্তাকর্মী। নিহতদের মধ্যে একজন চীনের শিক্ষার্থীও রয়েছেন। আহত ১২ জনের মধ্যে ৯ মাস বয়সী মেয়েশিশু থেকে ৫৫ বছর বয়সী নারীও রয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৮ জনের অবস্থা গুরুতর।
হামলাকারীকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। বন্ডাই ইহুদি-অধ্যুষিত এলাকা। ছুরিকাঘাতে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ইহুদি ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিও রয়েছেন। এই হামলার পেছনে ইহুদি-বিদ্বেষ থাকতে পারে বলে দাবি করছেন দেশটির ইহুদি সংঘের প্রধান ডেভিড অ্যাডলার।
হামলাকারী সিডনির রাজ্য নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের পার্শ্ববর্তী কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের বাসিন্দা। নাম জোল কাওচি (৪০)। জোল ‘ব্যাগপ্যাকার’ ভ্রমণকারী ছিলেন। অর্থাৎ তাঁর নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা নেই। তিনি একটি গাড়িতে বসবাস করতেন। এক মাস আগে জোল সিডনিতে ঘোরাঘুরি শুরু করেন। তিনি বেকার ও অবিবাহিত। তাঁর মায়ের সঙ্গে গত মার্চে তিনি শেষবার কথা বলেছিলেন।
পুলিশ বলছে, ১৭ বছর বয়স থেকে মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন জোল। হামলার এক ঘণ্টা আগেও ঘটনাস্থলের কাছে তিনি মুরগির তরকারি আর ভাত দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে রাজ্য পুলিশের কাছে কোনো অপরাধের রেকর্ড নেই। জোল নিয়মিত কোনো ধর্ম পালন করতেন কি না, সেটা নিশ্চিত নয় পুলিশ।
বন্ডাই এলাকায় বাংলাদেশিদের ব্যবসা ও বাংলাদেশি কর্মী রয়েছেন। শপিং মলের ভেতরে লবস্টার টেইল সি ফুড রেস্টুরেন্টের শেফ হিসেবে কাজ করেন প্রবাসী বাংলাদেশি সিডনির রকডেলের বাসিন্দা সুমন আহমেদ। হামলার সময়ের বর্ণনায় দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি একটু বিরতি নিয়ে রেস্টুরেন্টের বাইরে হাঁটাহাঁটি করছিলাম। হঠাৎ দেখি প্রচুর মানুষ ছোটাছুটি করছেন। কয়েকজন ভয়ার্ত মানুষ চিৎকার বলছিলেন, ওদিক যেয়ো না, ও সবাইকে মেরে ফেলছে, ভাগো ভাগো। পরে আমিও দৌড়ে বাইরে চলে যাই। এর মিনিট দশেক পর পুলিশ আসে।’
এই দুই ঘটনার পর সিডনির সার্বিক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বাড়তি পুলিশি পাহারা বসানো হয়েছে। বলা হচ্ছে, গত এক দশকের মধ্যে সিডনিতে এটিই সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনা। কিন্তু এত মানুষের মৃত্যুর পরও বন্ডাই শপিং মলের হামলাকে ‘জঙ্গিবাদী’ হামলা বলা হচ্ছে না। অথচ মাত্র ১৬ বছর বয়সী কিশোরের হামলায় চারজন আহত হওয়ার ঘটনাকে ‘জঙ্গিবাদী’ হামলা বলা হচ্ছে।
সাধারণ অর্থে কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মতাদর্শের কারণে ঘটানো বিশৃঙ্খলাকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এমন উদ্দেশ্য সরাসরি হতে হবে তা-ও নয়। যেমন ২০১৫ সালে ১৫ বছর বয়সী এক কিশোর এক পুলিশ কর্মকর্তাকে গুলি করে হত্যা করে। পরে তদন্তে পাওয়া যায়, তাকে তিন ব্যক্তি বন্দুক দিয়েছিলেন। তাঁরা ওই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেছিলেন। ফলে ওই কিশোরকে ‘জঙ্গি’ বলা হয়।
সিডনির গির্জায় হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রাজ্য পুলিশ এটিকে জঙ্গি হামলা হিসেবে দাবি করে। পুলিশি তদন্তে হয়তো এই তরুণের সঙ্গে এমন কোনো মতাদর্শের যুক্ততা পাওয়া গেছে, যা জঙ্গিবাদের দিকে ইঙ্গিত করে। অবশ্য এই হামলার পেছনে হামলাকারীর কী উদ্দেশ্য ছিল, সে সম্পর্কে পুলিশ এখনো কিছু বলেনি।
বন্ডাই শপিং মলে হামলাকারীর মানসিক সমস্যা ছিল। পুলিশি তদন্তে তাঁর এই হামলার সঙ্গে অন্য কারও যুক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই এই হামলাকে ‘জঙ্গিবাদ’ নয় মনে করছে পুলিশ। তবে শপিং মলে জোলের হামলায় নিহত বেশির ভাগই নারী। তাহলে যেখানে একটা বিশেষ জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে, তা কেন জঙ্গিবাদের আওতায় পড়ে না-এ নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় চলছে সমালোচনা। পারিবারিক সহিংসতার কারণে এ ধরনের হামলা কি না, তা-ও খতিয়ে দেখার দাবি উঠেছে। নইলে অস্ট্রেলিয়ায় জঙ্গিবাদের চেয়ে পারিবারিক সহিংসতা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।