আফগানিস্তানে তালেবানের দ্বিতীয় দফা ক্ষমতা গ্রহণের এক বছর আজ ১৫ আগস্ট। এ সময় দেশটিতে নারীদের জীবনে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসেনি। বরং সব দিক থেকে তাঁদের জীবন নিষ্পেষিত। তাঁদের অধিকার ও স্বাধীনতা আরও সীমিত হয়েছে। শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। কর্মক্ষেত্র থেকে সরিয়ে দেওয়া ও বোরকা পরতে বাধ্য করার মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে তালেবান প্রশাসন।
তালেবানের শাসনামলে নারীরা কেমন রয়েছেন, তা উঠে এসেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান–এর প্রতিবেদনে। এতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অভিজ্ঞতার কথা উঠে এসেছে।
হিজাব পরার বাধ্যবাধকতার বিষয়ে কাবুলের সামনা নামের এক নারী বলেন, ‘একদিন আমি একা বাড়িতে হেঁটে যাচ্ছিলাম। তখন নির্জন এলাকায় দুই তালেবান সদস্য আমার ওপর বন্দুক তাক করেন। গালি দেন। হিজাব না পরার কারণ জানতে চান। বন্দুকের নল মুখের ওপর ধরে গুলি করতে যান। এমন আর হবে না বলে ক্ষমা চাই। বাড়ি ফেরার পর এক ঘণ্টা ধরে কেঁদেছিলাম আমি।’
সামানার মতোই অভিজ্ঞতা পশ্চিম কাবুলের জাহরার। তিনি বলেন, ‘তালেবান সদস্যরা বন্দুক তাক করে হিজাব না পরার কারণ আমার কাছে জানতে চান। আমি মাপ চেয়ে পার পাই। কিন্তু এরপর থেকে আমার বাবা আর আমাদের বাড়ির বাইরে যেতে দেন না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া হবে না।’
কাবুলের আরেক নারী জারলাশত বলেন, ‘গত জুন মাসে ভাইয়ের সঙ্গে যাওয়ার সময় পরিচয়পত্র সঙ্গে না থাকায় তাঁকে হেনস্তার মুখে পড়তে হয়। তাঁদের মারধর করে কয়েক ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয়। এরপর থেকে আমি আর বাড়ির বাইরে যেতে পারি না।’
আফগানিস্তানের বামিয়ান প্রদেশের সাবিরা নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বলেন, ‘বাধ্য হয়ে কালো বোরকা পরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার পর নজরদারিতে থাকতে হয়। কখনো ভাবি না সব নারী শিক্ষার্থীকে এ রকম বাধ্য করা হবে।’
তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) হামলা বেড়ছে। এতে সাধারণ মানুষের জীবনও ঝুঁকিতে পড়েছে। পশ্চিম কাবুলের বাসিন্দা আব্বাসি বলেন, ‘তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের পর নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আইএসের হামলা বাড়ছে। একবার হামলায় আহত হওয়ার পর সব সময় তা নিয়ে ভয়ে থাকি।’
তালেবানের শাসনকালে নারীরা কাজ করার স্বাধীনতা হারিয়েছেন। সাকিনা খন্দকার নামের এক নারী বলেন, তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার আগে বিমান হামলায় তাঁর স্বামী প্রাণ হারান। এরপর শিশুদের বাঁচাতে রাস্তায় খাবার বিক্রি করতেন। কিন্তু তালেবান সদস্যরা তাঁকে কাজ করতে দেন না। এতে তাঁদের খেয়ে না–খেয়ে কাটাতে হচ্ছে।
পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন মারিয়াম। তিনি বলেন, ‘তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের আগে আমি পুলিশে কাজ করতাম। বিধবা হওয়ায় পুলিশের চাকরির বেতনে দুই মেয়েকে নিয়ে চলতে পারতাম। কিন্তু তালেবান ক্ষমতায় আসার পর চাকরি হারিয়েছি। আগে যাঁরা নিরাপত্তা বাহিনীতে কাজ করেছেন, তাঁদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন তালেবান সদস্যরা। আমি এখনো ভয়ে আছি। সাত মাস ধরে মেয়েদের বাঁচাতে রাস্তায় ভিক্ষা করতে নামতে হয়েছে। আমি বোরকা পরে সারা দিন রাস্তায় বসে থাকি, যাতে কেউ আমাকে চিনতে না পারে।’
মাহ লিকা (১৪) ও সামিরা (১৮) এখন ঘরবন্দী। তাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে তালেবান। সেখানে ভালো নেই শিল্প-সাহিত্য নিয়ে কাজ করা নারীরাও। হেরাতের চিত্রশিল্পী খাতেরা বলেন, ‘আমার এলাকায় আমিই একমাত্র নারী শিল্পী। তালেবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে আমার কাজ বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্ধুরা আমাকে দেশ ছাড়তে বলছেন।’
বার্তা সংস্থা এএফপি বলছে, তালেবানের ক্ষমতায় ফেরার এক বছর পূর্তির আগে গত শনিবার কাবুলের এক বিক্ষোভে প্রায় ৪০ নারী অংশ নেন। তাঁদের ‘রুটি, রুজি ও স্বাধীনতা’ স্লোগান দিতে শোনা যায়। তালেবান সদস্যরা ফাঁকা গুলি ছুড়ে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেন। এ সময় কয়েকজন নারী দৌড়ে পার্শ্ববর্তী দোকানে আশ্রয় নিলে তাঁদের ধাওয়া করে বন্দুকের বাঁট দিয়ে আঘাত করা হয়। মারধর করা হয় সাংবাদিকদেরও। এ ঘটনায় গতকাল উদ্বেগ জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।