সিনান ওগানের সমর্থনে কি ভোটে উতরাতে পারবেন এরদোয়ান
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দ্বিতীয় দফা ভোট আগামীকাল রোববার। প্রথম দফা ভোটে এগিয়ে থাকা রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, নাকি প্রধান বিরোধী দলের নেতা কেমাল কিলিচদারওলু কে ক্ষমতায় আসছেন তা নির্ধারণ হতে পারে এ ভোটের মধ্য দিয়ে। তবে এই দুই নেতার ভাগ্যে কী আছে, তা এখন অনেকটাই সিনান ওগান ও তাঁকে সমর্থন দেওয়া জোট এটিএ অ্যালায়েন্সের হাতে।
১৪ মে প্রথম দফা ভোটের আগে সিনান ওগান তেমন পরিচিত মুখ ছিলেন না। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন এটিএ অ্যালায়েন্সের সমর্থনে। এই জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছে ডানপন্থী নেতা উমিত ওজদাগের দল ভিক্টরি পার্টি। প্রথম দফায় জাতীয়তাবাদী ঘরানার সিনান ওগান পেয়েছিলেন ৫ দশমিক ২ শতাংশ ভোট। বেশি ভোট পাওয়ার দিক দিয়ে তিনি ছিলেন তৃতীয়।
প্রথম দফায় কেউই প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ৫০ শতাংশ ভোট পাননি। ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ের সবচেয়ে কাছাকাছি গিয়েছিলেন এরদোয়ান। এরপরই ছিলেন কিলিচদারওলু। তাঁর ভোট ছিল ৪৪ দশমিক ৮ শতাংশ। ফলে সিনান বা তাঁর পেছনে থাকা এটিএ জোটের সমর্থন পেলে প্রেসিডেন্ট পদে বসা অনেকটা নিশ্চিত হবে এরদোয়ান ও কিলিচদারওলুর জন্য।
সিনান ওগান একজন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ। ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টির (এমএইচপি) হয়ে ২০১১ সালে তুরস্কের পার্লামেন্টে পা রেখেছিলেন তিনি। ২০১৫ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়ান। তবে সফলতা পাননি।
বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, প্রথম দফা ভোটের কয়েক দিন আগে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন মুহাররম ইনসে নামের এক প্রার্থী। তাঁর সমর্থকদের অনেকের ভোট গিয়েছিল ওগানের দখলে। এ ছাড়া তুরস্কে অনেক তরুণ ভোটার রয়েছেন, যাঁরা এরদোয়ান বা কিলিচদারওলুকে পছন্দ করেন না। তাঁরাও ভোট দিয়েছিলেন ওগান ও এটিএ জোটকে।
ইস্তাম্বুলের সেহির বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক মেসুত ইয়েজেনের ভাষ্যমতে, তুরস্কে ভোটারদের একটি অংশ রয়েছেন, যাঁরা এরদোয়ানকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চান না। দেশটিতে আজকের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিও আগ্রহ নেই তাঁদের। এই ভোটারদের মধ্যে অনেকের আবার ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাব রয়েছে। ফলে তাঁরা এরদোয়ান ও তাঁর জোট পিপলস অ্যালায়েন্সের ধর্মভিত্তিক রক্ষণশীল রাজনীতিবিরোধী।
এদিকে কেমাল কিলিচদারওলুর পেছনে সমর্থন রয়েছে কুর্দিপন্থী রাজনৈতিক দল পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির। তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও রয়েছে। তুরস্কের ভোটারদের ওই অংশ পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতিও বিরক্ত বলে জানান অধ্যাপক মেসুত ইয়েজেন। ফলে তাঁরা কিলিচদারওলুর পক্ষে ভোট দিতে চাইবেন না।
এবারের নির্বাচনের আগে প্রচার-প্রচারণার সময় এরদোয়ান ও তাঁর দল ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একে পার্টি) বিরোধিতা করেছিলেন সিনান ওগান ও উমিত ওজদাগ দুজনেই। তবে হঠাৎ করে ২২ মে ওগান জানান, দ্বিতীয় দফা ভোটে তিনি এরদোয়ানকে সমর্থন দেবেন।
সিনান ওগান একজন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ। ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টির (এমএইচপি) হয়ে ২০১১ সালে তুরস্কের পার্লামেন্টে পা রেখেছিলেন তিনি। ২০১৫ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়ান। তবে সফলতা পাননি। এর পর থেকেই রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন ওগান। ভিক্টরি পার্টির উমিত ওজদাগের সঙ্গে এক চুক্তি করে এবার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়ে আবার রাজনীতির মাঠে সরব হন তিনি।
অপরদিকে উমিত ওজদাগ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক। একসময় ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টির উপপ্রধান ছিলেন তিনি। পরে আইওয়াইআই পার্টিতে একই পদ পান। আইওয়াইআই পার্টি বর্তমানে কিলিচদারওলুর জোটে রয়েছে। দলটি থেকে বহিষ্কারের পর ২০২১ সালে তিনি ভিক্টরি পার্টি গঠন করেন। জাতীয়তাবাদী তৎপরতার কারণে এই দল বেশ সমর্থন কুড়িয়েছে।
উগ্র জাতীয়তাবাদী মঞ্চ
তুরস্কের এবারের নির্বাচনের আগে সিনান ওগানের তেমন ভোটার সমর্থন ছিল না বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক ইতিয়েন মাহকুপিয়ান। তাঁর মতে, ওজদাগের নেতৃত্বে থাকা এটিএ অ্যালায়েন্সের সমর্থনের পরই মানুষ ওগানকে ভোট দিয়েছেন। আর তাঁকে না পেলে ওজদাগ হয়তো প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে অন্য কাউকে বেছে নিতেন।
আল-জাজিরাকে ইতিয়েন মাহকুপিয়ান বলেন, ওগান একা ভোটে দাঁড়ালে তিনি গুটিকয়েক জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ও অ্যাকাডেমিক গোষ্ঠীর সমর্থন পেতেন। তাঁকে ভোটারদের সমর্থন এনে দিয়েছে ওজদাগ ও তাঁর দল ভিক্টরি পার্টি।
এবারের নির্বাচনের আগে প্রচার-প্রচারণার সময় এরদোয়ান ও তাঁর দল ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একে পার্টি) বিরোধিতা করেছিলেন সিনান ওগান ও উমিত ওজদাগ—দুজনেই। তবে হঠাৎ করে ২২ মে ওগান জানান, দ্বিতীয় দফা ভোটে তিনি এরদোয়ানকে সমর্থন দেবেন। এর জেরে সেদিনই ভেঙে যায় ওজদাগের ভিক্টরি পার্টির নেতৃত্বাধীন এটিএ অ্যালায়েন্স।
এ নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন সিনান ওগান। নির্বাচনের প্রথম দফায় তাঁকে যেসব ভোটার সমর্থন দিয়েছিলেন, দ্বিতীয় দফায় তাঁদের এরদোয়ানকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দেশে স্থিতিশীলতা ধরে রাখতেই তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে এর বিনিময়ে এরদোয়ান তাঁকে কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কি না, তা সামনে আনেননি।
সিনান ওগানের সমর্থকেরা তিন ভাগে ভাগ হয়ে যেতে পারেন। তাঁদের একাংশ হয়তো ভোট দেবেন এরদোয়ানকে। আরেক অংশের ভোট যাবে কিলিচদারওলুর পক্ষে। আর কিছু সমর্থক ভোট দিতেই যাবেন নামেসুত ইয়েজেন, সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক, সেহির ইউনিভার্সিটি
ওগানের ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন ওজদাগ। তিনি বলেন, ওগান যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটা তাঁর নিজস্ব। এর দুই দিন পরে কেমাল কিলিচদারওলুর সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন ওজদাগ। তাঁরা একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন। ওই সমঝোতা স্মারকে তাঁরা শরণার্থীদের তুরস্ক থেকে প্রত্যাবর্তন করা এবং দুর্নীতি, পরিবারতন্ত্র ও সন্ত্রাসবাদ রুখে দেওয়ার মতো নানা বিষয়ে একমত হন।
পথটা আলাদা
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইতিয়েন মাহকুপিয়ানের মতে, এটিএ অ্যালায়েন্স এবারের নির্বাচনে বড় ভূমিকা পালন করতে পারত। তবে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে মাত্র দুই মাসের মাথায় জোটটির পতন হয়েছে। তিনি বলেন, ওগানকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি শুধু নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নিয়েই ভেবেছেন। এরদোয়ানকে সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্তের সময় ভবিষ্যতে ভোটারদের সমর্থন পাওয়ার বিষয়টি তাঁর মধ্যে শঙ্কা জাগায়নি।
এদিকে ওজদাগের ভিক্টরি পার্টির ভালো ভোটার সমর্থন রয়েছে বলে মনে করেন ইতিয়েন মাহকুপিয়ান। তাঁর ভাষ্যমতে, ওজদাগের তাঁর নিজ দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন। তিনি নির্বাচনের পরও দলের অবস্থান ধরে রাখতে চান। এরদোয়ানকে সমর্থন দেওয়া নিয়ে ওগানের সিদ্ধান্তের পর তাই তিনি প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়েছেন।
এখন বড় প্রশ্ন হচ্ছে, এটিএ অ্যালায়েন্সে এই বিভক্তি আগামীকালের দ্বিতীয় দফা ভোটে কী প্রভাব ফেলতে পারে? সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক মেসুত ইয়েজেনের ভাষ্যমতে, ওজদাগের সঙ্গে চুক্তির কারণে, ভিক্টরি পার্টির সমর্থকদের বড় একটি অংশ কিলিচদারওলুকে ভোট দেবেন। আর সিনান ওগানের সমর্থকেরা তিন ভাগে ভাগ হয়ে যেতে পারেন। তাঁদের একাংশ হয়তো ভোট দেবেন এরদোয়ানকে। আরেকাংশের ভোট যাবে কিলিচদারওলুর পক্ষে। আর কিছু সমর্থক ভোট দিতেই যাবেন না।
কেন ওগানের ভোটাররা বিভক্ত হয়ে যেতে পারেন, তার একটি জবাব পাওয়া গেছে ইতিয়েন মাহকুপিয়ানের বক্তব্যে। তাঁর জবানিতে, ‘ওগানকে তাঁর বেশির ভাগ সমর্থক আবেগ থেকে ভোট দেননি। তাঁরা ভোট দিয়েছিলেন এরদোয়ান ও কিলিচদারওলুর বিকল্প কাউকে না পেয়ে।’