নেপালে কেন আবার রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবি বাড়ছে

রাজতন্ত্রের দাবিতে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করছে দাঙ্গা পুলিশ। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে, ২৮ মার্চ ২০২৫ছবি: রয়টার্স

নেপালে আজ থেকে প্রায় দুই দশক আগে রাজতন্ত্র আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। প্রতিষ্ঠা করা হয় ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নতির যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, তা জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। এই পরিস্থিতিতে ‘হিমালয়কন্যা’ হিসেবে পরিচিত দেশটিতে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবিতে বিক্ষোভ বাড়ছে।

গত মাসে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবিতে রাজধানী কাঠমান্ডুসহ নেপালের বিভিন্ন স্থানে হাজারো মানুষ বিক্ষোভ করেছেন। পুলিশ এতে বাধা দেয়। ফলে বিক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নেয়। এতে দুজন নিহত হন। ১০০ জনের বেশি বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবিতে নেপালে এবারই প্রথমবারের মতো বিক্ষোভ হয়েছে, তা কিন্তু নয়। গত দুই দশকে এই দাবিতে অনেকবার বিক্ষোভ হয়েছে। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধীরগতি দেশটির মানুষের মধ্যে বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি হতাশা বাড়াচ্ছে। প্রজাতন্ত্র নিয়ে আগ্রহ কমছে। অন্যদিকে রাজতন্ত্রের সমর্থনে সাম্প্রতিক বিক্ষোভগুলোতে মানুষের অংশগ্রহণ বেড়েছে।

হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ নেপালের পার্লামেন্টে ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত করে ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন দেশটিতে এক দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধ শেষ করার জন্য একটি শান্তিচুক্তি হয়, যে গৃহযুদ্ধে ১৬ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। মূলত সেই শান্তিচুক্তির ধারাবাহিকতায় রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।

নেপালের রাজতন্ত্রপন্থী রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টির (আরপিপি) চেয়ারপারসন রাজেন্দ্র লিংডেন মনে করেন, রাজা নেপালিদের জাতীয় পরিচয় এবং গর্বের সঙ্গে যুক্ত। বার্তা সংস্থা এএফপিকে তিনি বলেন, ‘শাসন করার ইনস্টিটিউশন হিসেবে আমরা রাজতন্ত্র চাই না। তবে দেশের অভিভাবক হিসেবে আমরা রাজতন্ত্র চাই, যেটি দেশের স্বার্থ রক্ষা করবে এবং বিদেশি হস্তক্ষেপ প্রতিহত করবে।’

আরপিপি ২০১৭ সালের নির্বাচনে পার্লামেন্টে আসন পেয়েছিল একটি। সর্বশেষ ২০২২ সালের নির্বাচনে রাজতন্ত্র ও হিন্দুপন্থী কর্মসূচি নিয়ে দলটি ১৪টি আসন পায়। আরপিপি বর্তমানে নেপালের পঞ্চম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল।  

৪৩ বছর বয়সী শিক্ষক রাজিন্দ্র কুনওয়ার গত মাসে রাজতন্ত্রের সমর্থনে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভে অংশ নেন। এএফপিকে তিনি বলেন, ‘দেশ অস্থিতিশীলতার মধ্যে রয়েছে। দ্রব্যের দাম বাড়ছে, মানুষের চাকরি নেই। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ-সুবিধারও অভাব রয়েছে। এ কারণেই আমাদের রাজাকে ফেরানো দরকার।’

‘পুরোনো ধারণা’

সিংহাসনচ্যুত রাজা জ্ঞানেন্দ্র বীর বিক্রম শাহকে স্বাগত জানান রাজতন্ত্রের সমর্থকেরা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

নেপালের সর্বশেষ রাজা ছিলেন জ্ঞানেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ (৭৭)। তাঁর বড় ভাই রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ ২০০১ সালে রাজপ্রাসাদে সপরিবারে নিহত হওয়ার পর তাঁর অভিষেক হয়েছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডে রাজপরিবারের অধিকাংশ সদস্য নিহত হয়েছিলেন।

এমন এক সময়ে জ্ঞানেন্দ্র বীর বিক্রম শাহের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল, যখন নেপালের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাওবাদীদের বিদ্রোহ চলছিল।

রাজা হওয়ার পর ২০০৫ সালে সংবিধান স্থগিত করে তৎকালীন পার্লামেন্ট বিলুপ্ত ঘোষণা করেছিলেন জ্ঞানেন্দ্র। এরপর সেখানে গণতান্ত্রিক বিক্ষোভ শুরু হয়। এ সময় মাওবাদীরা মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মিলে বড় ধরনের বিক্ষোভ শুরু করেন।

আরও পড়ুন

উদ্ভূত সহিংসতা বন্ধে রাজতন্ত্রের ইতি টানার ঘোষণা আসে। ২০০৮ সালে পার্লামেন্টে ভোটের মাধ্যমে তা বাতিল করা হয়। ফলশ্রুতিতে দেশটির ২৪০ বছরের পুরোনো হিন্দু রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে।

রাজপ্রাসাদ ছাড়ার আগে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে জ্ঞানেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ বলেছিলেন, ‘রাজতন্ত্র অবসানের প্রক্রিয়াকে আমি সহযোগিতা করেছি এবং জনগণের রায়ের প্রতি সম্মান দেখিয়েছি।’ তবে দেশ ছাড়বেন না বলে জানালেও নির্বাসনে গিয়েছিলেন তিনি।

জ্ঞানেন্দ্রর বিদেশে চলে যাওয়া উদ্‌যাপন করতে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। তবে তখন রাজতন্ত্রের প্রতি অনুগত কিছু ব্যক্তিকে অশ্রুপাত করতেও দেখা গিয়েছিল।

মূলধারার রাজনীতিবিদেরা মনে করেন, রাজতন্ত্রে ফেরার সুযোগ নেই। কারণ, এতে করে দেশ আবার পেছনে হাঁটতে শুরু করবে।

নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির (একীভূত মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) প্রধান হুইপ রাজারাম বরতৌলা বলেন, ‘রাজতন্ত্র একটি ব্যর্থ ও পুরোনো ধারণা। সচেতন নেপালিরা একবিংশ শতাব্দীতে রাজতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন মেনে নেবে না।’

টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন রাজতন্ত্রের সমর্থকেরা
ছবি: রয়টার্স

বিশ্বব্যাংকের মতে, দরিদ্র নেপাল একাধিক সমস্যার মুখে রয়েছে। তবে চলতি মাসের এক প্রতিবেদনে ব্যাংকটি বলেছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথমার্ধে নেপালের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বেড়েছে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে বেশি। গত অর্থবছরের প্রথমার্ধে দেশটির জিডিপি ছিল ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। প্রধানত কৃষি ও শিল্প খাত চাঙা হওয়ায় চলতি অর্থবছরে অর্থনীতি ভালো করেছে।

‘দেশ বাঁচাও’

ক্ষমতাচ্যুত জ্ঞানেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ নেপালের বিভক্ত রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিন তেমন কোনো কথা বলেননি। তবে গত কয়েক মাসে তিনি কয়েকবার জনসমক্ষে এসেছেন। এ সময় তিনি প্রধানত বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনা পরিদর্শন করেছেন। সঙ্গে তাঁর সমর্থকেরা ছিলেন।

গত ফেব্রুয়ারিতে কয়েক জেলায় সফর শুরুর প্রাক্কালে এক বিবৃতিতে জ্ঞানেন্দ্র বলেছিলেন, ‘এখন সময় এসেছে। আমরা যদি আমাদের জাতিকে বাঁচাতে চাই, জাতীয় ঐক্য বজায় রাখতে চাই, এখনই কাজ শুরু করতে হবে। আমি দেশবাসীকে নেপালের সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি সমর্থন করার আহ্বান জানাচ্ছি।’

গত মাসে দেশে ফেরা জ্ঞানেন্দ্রকে স্বাগত জানাতে কাঠমান্ডুর বিমানবন্দরে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমিয়েছিলেন। তাঁদের অধিকাংশের হাতে ছিল দেশটির জাতীয় পতাকা। তাঁদের স্লোগান ছিল, ‘ফিরে এসো রাজা, জাতিকে বাঁচাও’।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক হরি শর্মা বলেন, সাধারণ নেপালির মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। এটাকে সুযোগ হিসেবে দেখছেন রাজতন্ত্রের অনুগতরা। এই মওকায় তাঁরা নিজেদের দাবি ও হতাশাকে এক করতে চাইছেন। বিশেষ করে বিশ্বের দেশে দেশে ডানপন্থী রক্ষণশীল দলগুলো সফল হওয়ার চলমান আবহাওয়াকে নিজেদের অনুকূলে তাঁরা কাজে লাগাতে চাইছেন।’