আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের ২ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ ১৫ আগস্ট। তবে এ পর্যন্ত কোনো দেশই তাদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। এমনকি তালেবান সরকারের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসা নিয়েও রয়েছে তীব্র মতবিরোধ। কেউ কেউ মনে করেন, আলোচনার মাধ্যমে তালেবানকে বদল করা সম্ভব হতে পারে। এর বিপরীতে অন্যদের ভাষ্য, তালেবান কখনো বদলাবে না, সুতরাং তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে কোনো লাভ হবে না।
আফগানিস্তানের নতুন শাসকদের সঙ্গে কীভাবে, কেমন আচরণ করা উচিত কিংবা তাদের একঘরে করে রাখা নিয়ে যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ দ্বিধায় ভুগছে, তখন ঘুরেফিরেই সামনে আসছে আফগানিস্তানে নারী অধিকারের বিষয়টি—এমনকি নারীদের রূপচর্চাকেন্দ্রও (বিউটি পারলার)।
তবে আফগান রূপবিশেষজ্ঞ সাকিনা মনে করেন, তাঁদের দেশের নারীরা তালেবান ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব—এ দুই পক্ষের দর-কষাকষির ‘বিষয়ে’ পরিণত হয়েছে। তাঁর অভিযোগ, তালেবান নারীদের চাপে রেখে মূলত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে নিজেদের স্বীকৃতি আদায় করতে চায়।
২০২১ সালের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করে তালেবান। এরপর তারা নারীদের বিরুদ্ধে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিতে শুরু করে। সম্প্রতি আফগানিস্তানে নারীদের বিউটি পারলার বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে তালেবান সরকার। এ অবস্থায় রূপবিশেষজ্ঞ সাকিনা রাজধানী কাবুলে দুই সপ্তাহ ধরে গোপনে তাঁর পারলার চালাচ্ছেন। পারলারের কক্ষটিতে হালকা করে আলো জ্বালানো। জানালার পর্দাগুলো খুব শক্ত করে টেনে রাখা হয়েছে, যাতে বাইরে থেকে বোঝা না যায়।
তবে তালেবানকে স্বীকৃতি দেওয়া বা না দেওয়ার পরিণতি কী হতে পারে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত নন সাকিনা। তাঁর ভাষায়, ‘তালেবানকে সরকার হিসেবে মেনে নিলে তারা আমাদের ওপর জারি করা বিধিনিষেধগুলো তুলে নিতে পারে, আবার না–ও নিতে পারে। এমনকি তারা আরও বেশি করে বিধিনিষেধ চাপিয়ে দিতে পারে।’
যদিও তালেবানের দাবি, নারী অধিকারের বিষয়টি নিয়ে বিশ্বের কোনো দেশেরই ‘মাথাব্যথা’ নেই। তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেন, এই একটি ইস্যুকে প্রাধান্য দেওয়াটা নিতান্তই অজুহাতমাত্র।
তালেবানের শীর্ষ নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার বাড়ি আফগানিস্তানের কান্দাহারে। সেখান থেকে বিবিসির সঙ্গে কথা বলেন তিনি। হাইবাতুল্লাহ বলেন, ‘বর্তমান সরকারকে আরও অনেক আগেই স্বীকৃতি দেওয়া উচিত ছিল। কিছু ক্ষেত্রে আমরা এগোতে পেরেছি। এ বিষয়টিকেও আমরা বিবেচনায় রাখব।’
আলোচনা নিয়ে মতভেদ
তালেবান সরকারের সঙ্গে আলোচনা হওয়া উচিত কি না, তা নিয়ে আফগানদের মধ্যেও মতভিন্নতা রয়েছে।
আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে তাদের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছেন ফাতিমা গাইলানি। আফগানিস্তানের চার সদস্যদের একটি নারী প্রতিনিধি দলের সদস্য তিনি। ফাতিমা গাইলানি বলেন, ‘আলোচনা করব না বলাটা সহজ ব্যাপার। আলোচনা করবে না তো কী করবে?’
দেশটির সাবেক সামরিক কমান্ডার ও প্রবীণ যোদ্ধারা এখনো আশা করছেন, শক্তি প্রয়োগ করে তালেবান সরকারকে উৎখাত করা যাবে। তবে তাঁদের সঙ্গে একমত নন ফাতিমা। তিনি বলেন, ‘আমাদের আরেকটি যুদ্ধের দরকার নেই।’
ফাতিমা তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় সমাধান খুঁজলেও কেউ কেউ মনে করেন, তালেবানকে আরও বেশি করে চাপ দিতে হবে, তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে।
নারীদের নেতৃত্বে পরিচালিত অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম জেন টাইমসের সম্পাদক ও প্রতিষ্ঠাতা জাহরা নাদের বলেন, ‘আলোচনা করে কী হবে? তারা কেমন মানুষ আর তারা কী ধরনের সমাজ গঠন করতে চায়, তা তারা দেখিয়ে দিয়েছে।’
তালেবানোর সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেওয়া কূটনীতিকেরা বলছেন, আলোচনার টেবিলে বসা মানেই স্বীকৃতি নয়।
তালেবানের মধ্যম পর্যায়ের কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গে সম্প্রতি পশ্চিমা কূটনীতিকদের বৈঠক হয়েছে। একজন কূটনীতিক বলেন, আগ্রহী আফগানদের যদি আলোচনার সুযোগ না দেওয়া হয়, তাহলে শাসনক্ষমতা এমন মানুষদের কাছে জিম্মি হয়ে থাকবে, যারা জনগণের একটা বড় অংশকে কার্যত বন্দী করে রাখতে চায়।
সম্প্রতি তালেবানের শীর্ষ নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার সঙ্গে কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুলরহমান আল থানির বৈঠক হয়। এটি কোনো বিদেশি কর্মকর্তার সঙ্গে আখুন্দজাদার প্রথম বৈঠক। এ আলোচনা সম্পর্কে কূটনীতিকেরা বলেছেন, আলোচনায় অনেকখানি ব্যবধান থেকে গেছে, বিশেষ করে শিক্ষা ও নারী অধিকার বিষয়ে। তবে ধীরে হলেও সামনে একটি সমাধানে পৌঁছার ইঙ্গিত দিয়েছেন তাঁরা।
আফগানিস্তান অ্যানালিস্ট নেটওয়ার্কের বিশ্লেষক কেট ক্লার্ক বলেন, বছরের পর বছর ধরে লড়াইকারী পক্ষগুলোর একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস ও ঘৃণা রয়েছে। তালেবান মনে করে পশ্চিমারা এখনো তাদের দেশকে নীতিভ্রষ্ট করতে চাইছে। নারী অধিকার ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের ক্ষেত্রে তালেবানের যে নীতিমালা রয়েছে, তা পশ্চিমা বিশ্ব সমর্থন করে না।
তালেবান ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভেদ চিহ্নিত করেছেন ক্লার্ক। তিনি বলেন, পশ্চিমারা হয়তো মনে করছে স্বীকৃতির মতো বিষয় তালেবানকে সুবিধা দেবে। আর তালেবান স্বীকৃতিকে তাদের অধিকার মনে করে। তারা মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তিকে পরাস্ত করে দ্বিতীয়বার তাদের হাতে আফগানিস্তানের শাসনক্ষমতা তুলে দিয়েছে স্বয়ং ঈশ্বর।
তালেবান ক্ষমতায় আসার পর নারীদের বিরুদ্ধে নানা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যাচ্ছে। পার্কে যাওয়া, জিমে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সর্বশেষ পারলারে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জাতিসংঘ একে ‘লৈঙ্গিক বর্ণবাদ’ বলে উল্লেখ করেছে। তালেবানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ারও প্রস্তুতি চলছে।
তালেবান সরকার এখনো কোনো স্বীকৃতি না পেলেও তাদের প্রতিনিধিরা বিভিন্ন দেশ সফরে যাচ্ছেন, সেসব দেশের সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। আবার তালেবান সরকারের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি প্রায় প্রতিদিনই কাবুলে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দলকে স্বাগত জানাচ্ছেন। এসব অতিথিকে নিয়মিত প্রটোকলও দেওয়া হচ্ছে। বৈঠকের ছবিও প্রকাশ করা হচ্ছে।
কাবুলে পশ্চিমা দূতাবাসগুলো বন্ধ রয়েছে। শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং জাপানি দূতাবাস খোলা আছে। প্রভাব বিস্তার করতে চাইলে কূটনীতিকদের কাতারে না থেকে কাবুলে যাওয়া প্রয়োজন কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে।
চার দশকের যুদ্ধে আরেকটি রক্তক্ষয়ী অধ্যায় যুক্ত করার ইচ্ছে বিশ্বের কোনো দেশেরই নেই। আবার তালেবান নেতাদের মতভেদ যতই থাকুক না কেন, নিজেদের লক্ষ্য অর্জনের ব্যাপারে তাঁরা সব সময়ই ঐক্যবদ্ধ। রাতারাতি কিংবা সহজে হওয়ার মতো কোনো সমাধানও সামনে নেই।
রূপবিশেষজ্ঞ সাকিনা আক্ষেপ করে বলেন, ‘মন খুলে একমাত্র যে কথাটি বলতে পারি, তা হলো, সত্যিই আমরা খুব দুর্দশার মধ্যে আছি। আমরা ছাড়া অন্য কেউ হয়তো কষ্টটা বুঝবেন না। তবে এটা সত্যিই যন্ত্রণার।’