জলবায়ু সম্মেলন: বিশ্বনেতারা চলে যাওয়ার পর পরিবেশকর্মীদের বিক্ষোভের অনুমতি দিল আজারবাইজান সরকার

আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে জলবায়ু সম্মেলনস্থলের পাশে বিক্ষোভ করছেন পরিবেশকর্মীরা। ১৫ নভেম্বরছবি: এএফপি

আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ ‘স্বৈরাচারী, অত্যাচারী ও নিপীড়ক’ বলে বাকুতে জলবায়ু সম্মেলনে আসতে চাননি সুইডিশ পরিবেশ আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ। তিনি এ কথাও বলেছিলেন, আজারবাইজানকে এই সম্মেলনের আয়োজন করতে দেওয়াই ঠিক হয়নি।

গ্রেটা থুনবার্গের ওই ভূমিকায় বেজায় চটেছিলেন আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট। তাতে ভ্রুক্ষেপ না করে থুনবার্গ জর্জিয়া থেকে চলে গেছেন আর্মেনিয়া, যে দেশের সঙ্গে আজারবাইজানের সাপে–নেউলে সম্পর্ক।

আলিয়েভকে যে যে বিশেষণে থুনবার্গ ভূষিত করেছেন, তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ খুব একটা যে নেই, সেই প্রমাণ পাওয়া গেল আজ শুক্রবার। কেননা, সম্মেলনের পঞ্চম দিনে পরিবেশ আন্দোলনকর্মীদের বিক্ষোভ দেখানোর অনুমতি তিনি দিয়েছেন। এত দিন ধরে গণ্ডা গণ্ডা সংগঠন বিক্ষোভ কর্মসূচির অনুমতি পেতে মাথা কুটে মরলেও প্রেসিডেন্ট ছিলেন অনড়।

বিক্ষোভকারীরা সেই অনুমতি পেলেন তখন, যখন আগত বিশ্বনেতারা ভাষণ পেশ করে আজারবাইজান ছেড়ে ফিরে গেছেন যে যাঁর দেশে। দূষণ রোধে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে দর–কষাকষি চালাচ্ছেন পরিবেশের জন্য নিবেদিত মানুষ। প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়নে কত অর্থ পাওয়া যাবে, সে বিষয়ে নিশ্চয়তা পাওয়ার কোনো ইতিবাচক লক্ষণ এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। মনে করা হচ্ছে, ২২ নভেম্বরের পরও হয়তো আরও দু–এক দিন এই দর–কষাকষি চলবে। এই অবসরে বিক্ষোভকারীদের একটু সুযোগ দেওয়া তাঁর ভাবমূর্তির কারণে জরুরি বলে হয়তো মনে করেছেন প্রেসিডেন্ট আলিয়েভ। নইলে তাঁর ‘না’ কে ‘হ্যাঁ’ করানোর সাধ্য কারও নেই।

সেই অবসরে বিভিন্ন সংগঠন তাদের মতো করে বাকু অলিম্পিক স্টেডিয়ামে বিক্ষোভ দেখাল। নাম অলিম্পিক স্টেডিয়াম হলেও বাকুতে কোনো দিন অলিম্পিক গেমস হয়নি, অদূর ভবিষ্যতে হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। এই স্টেডিয়াম চত্বরের ধারেকাছে এত দিন ভিড়তে দেওয়া হয়নি কোনো পরিবেশকর্মীকে। ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ কসাইখানা বন্ধ করে দেওয়া ও মিথেন গ্যাস উৎপাদনকারী বলে গরু–মোষ খাওয়া নিষিদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা লেখা ব্যানার নিয়ে কাছাকাছি রাস্তা বা মেট্রো স্টেশনে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। পুলিশ এসে তাঁদের সরিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু আজ শুক্রবার সরকারিভাবে অনুমতি মেলায় বহুবর্ণে সজ্জিত পরিবেশকর্মীরা ব্যানার, পোস্টার, প্ল্যাকার্ড নিয়ে সম্মেলনের মূল জায়গায় নেচেগেয়ে বিক্ষোভ দেখালেন। কেউবা নিয়ে এসেছিলেন কাগজের তৈরি প্রকাণ্ড সাপ, প্রকৃতিকে রক্ষা করা কেন দরকার তা বোঝাতে। কেউ কেউ বড় বড় পোস্টার সাজিয়ে নীরবে বসে থেকেছেন। সেই সব পোস্টারে জীবাশ্ম জ্বালানির ক্ষতিকর প্রভাবের কাহিনি বিধৃত।

আজারবাইজানের শাসকের অবশ্য এতে কিছুই যায়–আসে না। ৬৩ বছরের ইলহাম আলিয়েভ বাবা হায়দর আলিয়েভের মৃত্যুর পর ২০০৩ সালে প্রেসিডেন্ট হন। পাঁচ বছর পর ২০০৮ সালে দ্বিতীয় দফায় ভোটে জেতার পর তিনি সংবিধানটাই পাল্টে দেন, যাতে অনন্তকাল তিনি প্রেসিডেন্ট থাকতে পারেন। দেশে কোনো চ্যালেঞ্জার তাঁর নেই, কাজেই ছাত্রসমাজ হুট করে একটা জুলাই–আগস্ট বিপ্লব এনে দেবে, সেই সম্ভাবনাও এখন ক্ষীণ। ফলে বেপরোয়া হওয়ার অসুবিধেও তাঁর নেই। নেই বলেই এই সম্মেলনের শুরুতে জাতিসংঘের প্রেসিডেন্ট আন্তোনিও গুতেরেসের সামনেই বিরুদ্ধপক্ষদের সতর্ক করে শুনিয়ে দিয়েছেন, তাঁকে তেলের দেশের বাদশাহ বলে গালমন্দ করার কিছু নেই। কেননা, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি তেল যে দেশ উৎপন্ন করে (আমেরিকা), আজারবাইজানের উৎপাদন তার ৩০ ভাগের কম। কানাডার তেল উৎপাদনও তাঁর দেশের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। তা ছাড়া তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস তিনি সৃষ্টি করেননি। সেটা ঈশ্বরের দান।

বিতর্ক এখানেই থেমে থাকেনি। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ আগেই বলেছিলেন ‘কপ২৯’–এ তিনি যোগ দেবেন না। তবে তাঁর দেশের পরিবেশমন্ত্রী অ্যাগনেস প্যানিয়ার রুনাশের আসবেন ঠিক ছিল। অথচ সম্মেলন চলাকালে ইলহাম আলিয়েভ ফ্রান্সকে একহাত নেন এই বলে যে বিশ্বের বিভিন্ন অংশে তাদের যে উপনিবেশগুলো রয়েছে, সেখানকার পরিবেশ আন্দোলনকর্মীদের গলা তারা টিপে চুপ করিয়ে রেখেছে। ফ্রান্সের ওপর আলিয়েভের রাগের কারণ যুদ্ধের সময় আর্মেনিয়াকে সমর্থন করা।

সম্মেলন চলাকালে এমন মন্তব্য আলিয়েভ কেন করলেন, তা নিয়ে চলছে জল্পনা। কেননা, ওই মন্তব্যের পরেই ফ্রান্স এই সম্মেলন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। পরিবেশমন্ত্রী জানিয়ে দেন, বাকু যাবেন না। তাতে ইলহাম আলিয়েভের কিছু যায় আসেনি। কেননা, তিনি জানেন, সম্মেলন করাটাই ছিল তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য। সে ক্ষেত্রে তিনি সফল।

প্রশ্ন এটাই। সম্মেলন যেমন চলার তেমন চলছে। দাবিদাওয়া যার যা জানানোর কথা, তা–ও জানানো হচ্ছে। কিন্তু আদৌ কি অর্থায়নের কোনো সুরাহা হবে? সম্মেলনের মাঝপথে এখনো তার কোনো ইঙ্গিত নেই। পরিবেশ নিয়ে বিক্ষোভকারীরা তাঁদের মতপ্রকাশের সুযোগ পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সেই সুযোগ কারও টনক নড়াতে পারেনি। আগেও নয়, এবারও না।

উষ্ণতা রোধে বিশ্বের বৃহত্তম দুই হাজার পাবলিক লিস্টেড কোম্পানির মধ্যে ১ হাজার ১৪৫টি গত বছর স্বেচ্ছায় ‘নেট জিরো’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। অথচ ২০২৩ সালের জুন থেকে এ পর্যন্ত কার্বন নির্গমনের পরিমাণ শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই হারে তাপমান বাড়তে থাকলে আগামী ৫০ থেকে ৭৫ বছরের মধ্যে গোটা মালদ্বীপ ও সুন্দরবন সমুদ্রের তলায় চলে যাবে। ঢাকা জেগে থাকবে দ্বীপের মতো।

দূষণ ছড়ানোর যারা ওস্তাদ, সেই যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, চীন, ফ্রান্স বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাকুকে কেন গুরুত্ব দিল না, বোঝা যাচ্ছে না। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্ত্র শিষ্য আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট জাভিয়ের মিলেই গুরুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার কথা শুনিয়ে রেখেছেন। বিস্ময় এখানেও। আর্জেন্টিনার তো দূষণ রোধে টাকা পাওয়ার কথা। যেমন টাকা পাওয়ার কথা ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ারও। দাতাদের অনাগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু গ্রহীতাদের মধ্যে কেন এত অনাগ্রহ? ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার সরকারপ্রধানেরা কেন অনুপস্থিত?

বাকুতে জড়ো হওয়া পরিবেশ আন্দোলনকর্মীদের কাছে এখনো এই হেঁয়ালির উত্তর নেই। কিন্তু তাই বলে তাঁরা হতোদ্যম নন। অভিনব সব বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে ভয় ও আতঙ্কের অনাগত ভবিষ্যতের ছবি তাঁরা এঁকে চলেছেন।