জি-২০ সম্মেলনে ‘রাশিয়া–ইউক্রেন’ যুদ্ধই আলোচনার কেন্দ্রে

জি–২০ সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ হাত মেলান।
গতকাল নুসা দুয়ায়। ছবি : রয়টার্স

ইন্দোনেশিয়ার বালিতে বিশ্বের ২০টি বৃহৎ অর্থনীতির দেশের জোট জি-২০ সম্মেলনের শুরুতেই দেখা গেল বিভক্তি। মঙ্গলবার শুরু হওয়া সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইউক্রেনে আক্রমণের জন্য রাশিয়ার নিন্দা প্রস্তাব সমর্থন করেছে। তবে একে অযৌক্তিক রাজনীতিকরণ হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেছেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ। ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর হামলা শুরুর পর জি–২০ নেতারা এই প্রথম বৈঠকে বসেছেন।

ইউক্রেন যুদ্ধকে রাশিয়ার পক্ষ থেকে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এবারের জি–২০ সম্মেলনের আয়োজক দেশ ইন্দোনেশিয়ার পক্ষ থেকে ঐক্যের আহ্বান জানানো হয়েছে। এ ছাড়া বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানের ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। তা সত্ত্বেও ইউক্রেনে যুদ্ধের বিষয়টি নিয়ে শুরুতেই দেশগুলোর মধ্যে বিভক্তি দেখা গেল। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্য ও জ্বালানিনিরাপত্তায় ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

সম্মেলনে ১৬ পাতার একটি খসড়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ সদস্য ইউক্রেনের যুদ্ধের তীব্র নিন্দা করেছে। এ ছাড়া জোর দিয়ে বলা হয়েছে, এ যুদ্ধ অপরিমেয় মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে এবং বিশ্ব অর্থনীতিকে দুর্দশাগ্রস্ত করে তুলেছে। তবে খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, পরিস্থিতি ও নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ভিন্নমত ও মূল্যায়ন আছে।

জি–২০ সম্মেলনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতিনিধিত্ব করছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ। তিনি বলেন, রাশিয়াকে নিন্দা জানানোর প্রচেষ্টা পশ্চিমা দেশগুলোর রাজনীতিকরণ। এটি তারা খসড়ায় যুক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে। লাভরভ আরও বলেন, বিকল্প আরেকটি প্রস্তাব দেবে রাশিয়া, যা আজ বুধবার সম্পন্ন হবে। এর আগে একজন মার্কিন কর্মকর্তা বলেছিলেন, জি–২০ সম্মেলনে ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ ও বিশ্ব অর্থনীতিতে এর প্রভাবের নিন্দা জানাতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।

জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ বলেছেন, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার অগ্রহণযোগ্য যুদ্ধ নিয়ে ঐক্যমত সৃষ্টির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এর আগে জি–২০–এর মন্ত্রীদের বৈঠকে রাশিয়াসহ অন্য দেশগুলো একমত না হওয়ায় রাশিয়াকে নিন্দা জানানোর বিষয়ে যৌথ ঘোষণা দেওয়া সম্ভব হয়নি।

গতকাল জি–২০ সম্মেলনে ভার্চ্যুয়ালি বক্তব্য দেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি বলেন, জাতিসংঘের সনদ এবং আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে তাঁর প্রস্তাবিত পরিকল্পনা অনুযায়ী এখন ইউক্রেনে যুদ্ধ সমাপ্ত করার উপযুক্ত সময়। তিনি জাপোরিঝঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পুনরুদ্ধার করে বিকিরণ নিরাপত্তা পরিমাপ, রাশিয়ার জ্বালানি উৎসে বিধিনিষেধ আরোপ ও ইউক্রেনের শস্য রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগের আহ্বান জানান। একই সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধে সহযোগিতা চান তিনি। জেলেনস্কি বলেন, ‘আমরা একত্রে নিশ্চিত শান্তির সূত্র বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হব।’

রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাভরভ বলেন, তিনি জেলেনস্কির বক্তব্য শুনেছেন। তবে অভিযোগ করেন, এ সংঘর্ষ বাধানোর মূলে জেলেনস্কিই। তিনি পশ্চিমাদের কোনো পরামর্শ শোনেননি।

বিশ্বকে রক্ষা করুন

ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো ইউদোদোর ঐক্যের আহ্বানে বালিতে সম্মেলন শুরু হয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের আর কোনো পথ নেই। বিশ্বকে রক্ষায় সহযোগিতা প্রয়োজন। বি-২০–কে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারে অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে হবে। আমাদের বিশ্বকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা ঠিক হবে না। আমরা আরেকটি স্নায়ুযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পথে হাঁটতে পারি না।’

যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রাজিল, ভারত, সৌদি আরব ও জার্মানির মতো দেশ জি-২০ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে। সম্মেলন শুরুর একদিন আগে বৈঠক করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। এ বৈঠকে মতপার্থক্য থাকলেও দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষার কথা বলেছেন দুই নেতা।

চীনের গণমাধ্যমগুলোতে বলা হয়, গতকাল সি চিন পিং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। মাখোঁর কাছে সি বলেছেন, তিনি ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি আলোচনার পক্ষে কথা বলেছেন। তিনি চীন ও ফ্রান্সের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানো নিয়েও কথা বলেছেন। দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা নিরসনে কাজ করার কথা বলেছেন তাঁরা।

যুদ্ধবিরতির আহ্বান মোদির

নয়াদিল্লি প্রতিনিধি জানান, ইন্দোনেশিয়ার বালিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের আসরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির উপায় সবাইকেই খুঁজতে হবে। সেই দায়িত্ব আজ আমাদের প্রত্যেকের ওপর বর্তেছে। এটা যুদ্ধের সময় নয়। কূটনীতির রাস্তায় কী করে ফেরা যায়, তার খোঁজে সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে।’

মোদি আরও বলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে গিয়েছিল। সেই সময় তৎকালীন বিশ্বনেতৃত্ব শান্তির পথে প্রত্যাবর্তনে প্রচণ্ডভাবে এগিয়ে এসেছিলেন। আজ সেই দায়িত্ব চেপেছে আমাদের ওপর। পৃথিবীকে শান্ত, সমৃদ্ধিশালী ও নিরাপদ করে তুলতে আমাদের সবাইকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। এটাই এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।’ প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, ‘আগামী বছর জি-২০ নেতারা যখন ভারতে আসবেন, আমি নিশ্চিত, তখন আমরা সবাই বিশ্ববাসীকে শান্তির বার্তা দিতে পারব।’

ভারত আগামী ১ ডিসেম্বর জি-২০ গোষ্ঠীর সভাপতিত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করবে। আগামী বছর অনুষ্ঠিত হবে শীর্ষ সম্মেলন। প্রধানমন্ত্রী মোদি তাঁর ভাষণে ইউক্রেনের সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন ও কোভিড মহামারির বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের উল্লেখ করে বলেন, ‘এর ফলে গোটা বিশ্বে সরবরাহব্যবস্থা ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বজুড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব দেখা দিয়েছে। চারদিকে হাহাকার। প্রতিটি দেশের দরিদ্রদের অবস্থা দুর্বিষহ। দৈনন্দিন জীবন অতিবাহিত করা তাদের কাছে কঠিন হয়ে উঠেছে।’ মোদি বলেন, ‘বলতে দ্বিধা নেই, জাতিসংঘের মতো বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠান এই সংকটের মোকাবিলায় ব্যর্থ। আমরাও প্রয়োজনীয় সংস্কারে ব্যর্থ হয়েছি। আর তাই, জি-২০ নেতৃত্বের কাছে বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা বেড়ে গেছে। এই গোষ্ঠীর প্রাসঙ্গিকতাও বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ।’

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন