জাপানের রাজনীতিতে নতুন বাঁক
জাপানের সাধারণ নির্বাচনের রোববারের ফলাফল অনেকটা আগে থেকেই আঁচ করা যাচ্ছিল। তবে দেশের ক্ষমতাসীন উদার গণতন্ত্রী দলের (এলডিপি) জন্য এই ফলাফল কেবল অবাক করে দেওয়ার মতোই ছিল না, দলীয় নেতৃত্বের সামনে তা ‘মর্মান্তিক’ হয়েও দেখা দিয়েছে। ফলে ক্ষমতাসীন শিবিরে বইছে হতাশার হাওয়া। আগামী দিনে দলকে কোন পথে ঠেলে দেবে, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে একধরনের অনিশ্চয়তা। আর অনিশ্চিত পরিবেশে একমাত্র যিনি লাভবান হচ্ছেন, তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরু।
১৫ বছর পর পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর পর অনেকেই মনে করেছিলেন, সম্ভবত পরাজয়ের প্রথম শিকার হবেন প্রধানমন্ত্রী। সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রচলিত থাকা দেশে সাধারণত নির্বাচনী ফলাফলে দলের পরাজয়ের দায়ভার দলীয় নেতার ওপর বর্তায়। যেহেতু দলনেতা প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন, ফলে সে রকম অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে দেখা যায়।
গত দুদিনে জাপানে সে রকম কিছু ঘটেনি। উল্টো নতুন উদ্দীপনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাসীন জোটের জন্য নতুন অংশীদার খুঁজে এনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ফিরে পাওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা গেছে। এ কারণেই ইশিবা এখন বলছেন, তিনি এখন দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন না; বরং দলের এই দুর্দিনে শক্ত হাতে ক্ষমতা ধরে রেখে বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে দলকে সাহায্য করবেন। সেই লক্ষ্য অর্জনে তিনি কতটা সফল হবেন, তা অনিশ্চিত। কারণ, দলের ভেতরে ইশিবার অবস্থান শক্ত সমর্থনের ওপর দাঁড়িয়ে নেই। নির্বাচনের আগে থেকে যাঁরা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন, তাঁরা হয়তো আবারও সরব হওয়ার আগে দেখার অপেক্ষায় আছেন তাঁর নতুন জোট কতটা সফল উদ্যোগ নিয়ে আসতে পারে।
গত রোববারের নির্বাচনে এলডিপি পেয়েছে ১৯১টি আসন। আগের চেয়ে ৫৬টি কম আসন পেয়েছে দলটি। অন্যদিকে এলডিপির জোটের অংশীদার কোমেই পার্টি পেয়েছে ২৪টি আসন। তারাও আগের চেয়ে ৮টি কম আসন পেয়েছে। দুই দল সমন্বিতভাবে পেয়েছে ২১৫টি আসন।
জাপানের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ৪৬৫ আসনবিশিষ্ট। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ২৩৩টি আসন। সেই হিসাবে এলিডিপি প্রয়োজনের তুলনায় ১৮টি আসন কম পেয়েছে। ফলে ক্ষমতাসীনকে নতুন মিত্রের সন্ধান করতে হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, মিত্রের দেখা পাওয়া খুব বেশি কঠিন হবে না। এর কারণ, দ্বিতীয় স্থানে থাকা প্রধানবিরোধী সাংবিধানিক গণতন্ত্রী দলের (সিপিডি) আসন। নির্বাচনের ফলাফলকে সিপিডির জন্য বড় ধরনের বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে ১৪৮টি আসন নিয়ে অন্যদের সঙ্গে দর–কষাকষি করে সরকার গঠন করা তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। কারণ, বিরোধী সব কটি দলের সম্মিলিত আসনসংখ্যা ক্ষমতাসীন জোটের চেয়ে সামান্য বেশি হলেও দলগুলোর মধ্যে নীতিসংক্রান্ত বিভাজন একত্র হওয়ার সুযোগ এনে দেবে না। ফলে ইশিবা এখন ডানপন্থী দুটি বিরোধী দলকে তাঁর পক্ষে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছেন।
ইশিবার এই লক্ষ্য অর্জন খুব বেশি কঠিন নয়। রোববারের ভোটের ফলাফলে আসনসংখ্যার দিক থেকে তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে যথাক্রমে রয়েছে জাপান ইনোভেশন পার্টি (নিপ্পন ইশিন) এবং ডেমোক্রেটিক পার্টি ফর দ্য পিপল (ডিপিপি)। তাদের আসনসংখ্যা যথাক্রমে ৩৮ ও ২৮। এর যেকোনো একটিকে নতুন জোটে নিয়ে আসতে পারলে এলডিপির নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জোট নিশ্চিতভাবেই আপাতত টিকে যাবে। কেননা, এর বাইরে ১২ জন নির্দলীয় বিজয়ী প্রার্থীর মধ্যে ছয়জন এলডিপির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
এলডিপি অবশ্য নিপ্পন ইশিনের চেয়ে চতুর্থ স্থানে অবস্থানরত ডিপিপিকে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করছে। কারণ, অতীতে নিপ্পন ইশিন সিডিপির সঙ্গে একমত হয়ে সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছে। অপর দিকে ডিপিপির নেতা তামাকি ইয়োইচিরো ভোটের ফলাফল ঘোষিত হয়ে যাওয়ার পর সাংবাদিকদের বলেছেন, তাঁর দল সম্মত হওয়া রাজনৈতিক বিষয়াবলি নিয়ে যেকোনো দলের সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছে।
অন্যদিকে ইশিবাও নীতিসংক্রান্ত বিষয়াবলি নিয়ে বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে চান। ডিপিপির সঙ্গে সরাসরি আলোচনা শুরু করার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কিছু বলা হয়নি। তবে ইশিবা যেভাবে আস্থার সঙ্গে পদত্যাগ না করা এবং দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার কথা বলেছেন, তা পরিষ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে, যেকোনো একপর্যায়ে ডিপিপিকে সরকারে নিয়ে আসা নিয়ে সমঝোতা হয়তো হয়ে গেছে। ফলে ইশিবার তাৎক্ষণিক পদত্যাগ নিয়ে জোরালো আলোচনা না চললেও তিনি যে সম্পূর্ণ নিরাপদ, তা অবশ্য বলা যায় না। কেননা, নির্বাচনের ফলাফলকে এলডিপির অনেক নেতাই পরাজয় হিসেবে দেখছেন। পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলে এই পরাজয়ের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য ইশিবার ওপর তাঁরা যে চাপ দিতে থাকবেন, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
নির্বাচনী ফলাফলে দলের ব্যর্থতা দৃশ্যমান হয়ে ওঠার পর দ্রুত দায়িত্ব থেকে সরে গেছেন এলডিপির নির্বাচন পরিচালনা পরিষদের প্রধান কোইজুমি শিনজিরো। সাবেক এই মন্ত্রীকে ইশিবা এই পদে বসিয়েছিলেন দলীয় সভাপতি নির্বাচনের পরপর।
কোইজুমি হয়তো ভবিষ্যতে সরকার কিংবা দলের আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য পদত্যাগের মধ্য দিয়ে নিজের জন্য ক্ষেত্র তৈরি করে নেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন। তবে ইশিবার সবচেয়ে কঠোর সমালোচক এবং প্রতিদ্বন্দ্বী তাকাইচি সানায়ে এখন পর্যন্ত অনেকটা নিশ্চুপ। সম্ভবত দেখার অপেক্ষায় আছেন, হাওয়া আগামী দিনগুলোতে কোন পথে বইতে শুরু করে। ফলে সুযোগের অপেক্ষায় তিনি আছেন। আর তাই বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরু আপাতত ঘর গুছিয়ে নিতে সক্ষম হলেও অল্পদিনের মধ্যেই ঝড়ের মুখে তাঁকে হয়তো পড়তে হবে।