দক্ষিণ কোরিয়ার অভিশংসিত প্রেসিডেন্টকে গ্রেপ্তার করা এত কঠিন কেন

দক্ষিণ কোরিয়ার অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলফাইল ছবি: এএফপি

ঘটনাস্থল দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন। গত শুক্রবার সকালে সেখানে ১০০ জনের বেশি পুলিশ ও তদন্তকারী কর্মকর্তা গিয়েছিলেন। কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছিল দেশটির সাময়িক বরখাস্ত প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলকে গ্রেপ্তারের পরোয়ানা।

ইউনকে গ্রেপ্তারের প্রচেষ্টা ঘিরে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবনের বাইরে এক নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। প্রায় ছয় ঘণ্টা ধরে ‘অচলাবস্থা’ চলে। শেষ পর্যন্ত ইউনকে গ্রেপ্তারে ব্যর্থ হয় দক্ষিণ কোরিয়ার কর্তৃপক্ষ।

স্থানীয় গণমাধ্যমের তথ্য অনুসারে, গ্রেপ্তার-চেষ্টা ঘিরে ইউনের নিরাপত্তা দলের সদস্যদের সঙ্গে পুলিশ ও তদন্তকারীদের মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হয়। ইউনের গ্রেপ্তার ঠেকাতে তাঁর নিরাপত্তা দলের সদস্যরা মানবপ্রাচীর তৈরি করেন। গ্রেপ্তারকারী দলের পথ আটকাতে তাঁরা যানবাহন দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন।

আরও পড়ুন
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবনের কাছে ইউন সুক-ইওলের সমর্থকেরা
ফাইল ছবি: এএফপি

দক্ষিণ কোরিয়া একটি নজিরবিহীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সবাইকে হতবাক করে দিয়ে গত ৩ ডিসেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ায় সামরিক আইন জারি করেছিলেন ইউন। কিন্তু তীব্র প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মুখে মাত্র ছয় ঘণ্টার মাথায় তিনি তা প্রত্যাহারে বাধ্য হন।

স্বল্পস্থায়ী এই সামরিক আইন জারির জেরে ১৪ ডিসেম্বর ইউনকে পার্লামেন্টে অভিশংসন করা হয়। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব থেকে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

তারপর শুরু হয় ফৌজদারি তদন্ত। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলবে হাজির হতে ইউন অস্বীকৃতি জানান। এর জেরে ৩১ ডিসেম্বর ইউনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন দেশটির একটি আদালত।

দক্ষিণ কোরিয়ার এই ডানপন্থী নেতার প্রতি এখনো দেশটির জনগণের জোরালো সমর্থন রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। গত শুক্রবার সকালে ইউনকে গ্রেপ্তার-চেষ্টার বিরোধিতা করে হাজারো মানুষ তাঁর বাসভবনের বাইরে জড়ো হয়েছিলেন।

আরও পড়ুন

তবে অনেকের মতে, ইউন এখন একজন নিন্দিত, অসম্মানিত নেতা। তাঁর ভাগ্য ঝুলে আছে সাংবিধানিক আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর। এই আদালত যদি ইউনের অভিশংসন বহাল রাখেন, তাহলে তাঁকে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে অপসারিত করা যাবে।

কিন্তু ইউনকে গ্রেপ্তার করাটা পুলিশ, তদন্তকারীদের পক্ষে এত কঠিন কেন?
ইউনকে কারা পাহারা দিচ্ছেন, তার মধ্যেই আছে এই প্রশ্নের উত্তর।

আরও পড়ুন

কারা পাহারা দিচ্ছেন

দক্ষিণ কোরিয়ার আইনপ্রণেতারা ইউনের অভিশংসনের পক্ষে ভোট দেওয়ার পর তাঁর কাছ থেকে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি এখনো নিরাপত্তা-সুবিধা পাচ্ছেন।

আর এই ব্যক্তিরা (প্রেসিডেনশিয়াল সিকিউরিটি সার্ভিস-পিএসএস) গত শুক্রবার ইউনের গ্রেপ্তার ঠেকাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

সিউলের হানকুক ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক ম্যাসন রিচি বলেন, ইউনের প্রতি আনুগত্য থেকে কিংবা নিজেদের আইনি ও সাংবিধানিক ভূমিকা সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর ধারণা থেকে পিএসএস এই কাজ (গ্রেপ্তারে বাধা) করে থাকতে পারে।

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবনে পুলিশ ও তদন্তকারী কর্মকর্তা
ফাইল ছবি: এএফপি
আরও পড়ুন

ইউনকে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে—এই প্রেক্ষাপটে পিএসএসের উচিত ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট চোই সাং-মোকের কাছ থেকে নির্দেশনা নিয়ে কাজ করা।

পিএসএসের ভূমিকা নিয়ে ম্যাসন রিচি সম্ভাব্য দুটি ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন। তিনি বলেন, ইউনকে সুরক্ষা (গ্রেপ্তারে বাধা) দেওয়া থেকে বিরত থাকার বিষয়ে হয় পিএসএসকে নির্দেশ দেননি ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট চোই, কিংবা তারা তাঁর এমন আদেশ প্রত্যাখ্যান করছে।

কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, নিরাপত্তা কর্মকর্তারা নিজেদের বিধিবদ্ধ দায়িত্ব-কর্তব্যের পরিবর্তে ইউনের প্রতি ‘নিঃশর্ত আনুগত্য’ দেখিয়েছেন।

এই ঘরানার বিশেষজ্ঞরা এ প্রসঙ্গে পিএসএসের প্রধান পার্ক জং-জুনের নিয়োগের কথা সামনে এনেছেন। পার্ক জং-জুনকে গত সেপ্টেম্বরে ইউন নিয়োগ দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন
সবাইকে হতবাক করে দিয়ে গত ৩ ডিসেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ায় সামরিক আইন জারি করেছিলেন ইউন সুক-ইওল
ফাইল ছবি: এএফপি

পার্ক জং-জুনের পূর্বসূরি ছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী কিম ইয়ং-হিউন। ইউনকে সামরিক আইন জারি করার বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে।

ইউনের সামরিক আইন জারি-সংক্রান্ত ফৌজদারি অপরাধ তদন্তের অংশ হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কিম ইয়ং-হিউনকে আগেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আইনজীবী ও কোরিয়া বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টোফার জুমিন লি বলেন, ব্যাপারটি এমনও হতে পারে যে ইউন এই পরিস্থিতির প্রস্তুতির অংশ হিসেবে তাঁর কট্টর অনুগত ব্যক্তিদের দিয়ে পিএসএসকে সাজিয়েছেন।

আরও পড়ুন

উত্তেজনা বাড়ার ঝুঁকি

ক্রিস্টোফার জুমিন লির মতে, দক্ষিণ কোরিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের জন্য সহজ সমাধান হলো, সাময়িক সময়ের জন্য ইউনের সুরক্ষার কাজ থেকে সরে দাঁড়ানোতে পিএসএসকে নির্দেশ দেওয়া।

ক্রিস্টোফার জুমিন লি বলেন, ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট চোই যদি তা করতে ইচ্ছুক না হন, তাহলে বিষয়টি পার্লামেন্টে তাঁর নিজের অভিশংসনের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

আশঙ্কাটি যে অমূলক নয়, তার নজির আগে দেখা গেছে। ইউনের অভিশংসনের পর দক্ষিণ কোরিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছিলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী হান ডাক-সু। তাঁকেও অভিশংসন করেন দেশটির আইনপ্রণেতারা। এরপর অর্থমন্ত্রী চোই ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন।

প্রেসিডেনশিয়াল সিকিউরিটি সার্ভিস (পিএসএস) ইউন সুক-ইওলের গ্রেপ্তার ঠেকাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে
ছবি: এএফপি
আরও পড়ুন

দক্ষিণ কোরিয়ায় বর্তমানে যে অচলাবস্থা চলছে, তা দেশটির রাজনৈতিক মেরুকরণকেও প্রতিফলিত করে। এই মেরুকরণের একদিকে আছেন যেসব লোক, যাঁরা ইউনকে সমর্থন করেন, যাঁরা তাঁর সামরিক আইন জারির সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেন। আর অন্যদিকে আছেন সেসব লোক, যাঁরা এর বিরোধিতা করেন। এর বাইরে অন্য বিষয়েও মতপার্থক্য লক্ষণীয়।

সেন্টার ফর আ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির জ্যেষ্ঠ ফেলো ডুইয়ন কিম বলেন, দক্ষিণ কোরীয়দের অধিকাংশই এ বিষয়ে একমত যে ইউনের সামরিক আইন জারির ঘোষণার সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল। আর এই সিদ্ধান্তের জন্য তাঁকে জবাবদিহি করা দরকার। কিন্তু সেই জবাবদিহির স্বরূপ কেমন, তা নিয়ে দেশটির মানুষের মধ্যে ভিন্নমত আছে।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ডুইয়ন কিম বলেন, প্রধান ভূমিকায় থাকা ব্যক্তিরা জবাবদিহির প্রক্রিয়া, পদ্ধতি ও তার আইনি ভিত্তি নিয়ে দ্বিমত পোষণ করছেন। বিষয়টি দেশটির রাজনীতিতে আরও অনিশ্চয়তা যুক্ত করছে।

আরও পড়ুন
ইউন সুক-ইওলের সমর্থকেরা
ছবি: এএফপি

অনিশ্চয়তার পাশাপাশি দেশটিতে উত্তেজনাও বাড়ছে। গত শুক্রবার ইউনকে গ্রেপ্তার–চেষ্টা ঘিরে প্রেসিডেন্টের বাসভবনের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। প্রেসিডেন্টের বাসভবনের বাইরে কয়েক দিন ধরে অবস্থান নিয়ে ইউনের সমর্থকেরা তাঁর গ্রেপ্তার-চেষ্টার তীব্র বিরোধিতা করে আসছিলেন। তাঁরা উত্তপ্ত বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে আসছিলেন। এমনকি তাঁদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ পর্যন্ত হয়।

সিউলের হানকুক ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক ম্যাসন রিচি বলেন, ইউনকে গ্রেপ্তার করতে ভবিষ্যতে আইনপ্রয়োগকারীরা আরও বেশিসংখ্যক জনবল সঙ্গে নিয়ে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে আসতে পারেন। তাঁরা শক্তি প্রয়োগ করতে পারে। তবে ব্যাপারটি অত্যন্ত বিপজ্জনক হবে।

পিএসএস ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। তাই ইউনকে যাঁরা গ্রেপ্তার করতে যাবেন, তাঁরা উত্তেজনা বৃদ্ধি এড়ানোর চেষ্টা করবেন।

আরও পড়ুন

কোরিয়া বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টোফার জুমিন লি কিছু প্রশ্ন সামনে এনেছেন। তিনি বলেন, বাধা সৃষ্টিকারী পিএসএসের সদস্যদের গ্রেপ্তারের পরোয়ানা নিয়ে যদি পুলিশ হাজির হয়, তখন কী হবে? আবার পিএসএস যদি সেই পরোয়ানাকেও উপেক্ষা করে, পুলিশ ও তদন্তকারীদের দিকে তারা যদি অস্ত্র তাক করে, তখন কী হবে?

দক্ষিণ কোরিয়ার পুলিশ বলেছে, ইউনকে গ্রেপ্তারে বাধা দেওয়ার ঘটনায় তারা পিএসএসের পরিচালক ও তাঁর ডেপুটির বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। ফলে আরও অভিযোগ ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ভবিষ্যতে আসতে পারে।

ইউনের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দেশটির দুর্নীতি তদন্ত কার্যালয় (সিআইও)। সিআইওর বয়স মাত্র চার বছর। ফলে একটি নবীন সংস্থা হিসেবে ইউনের মতো ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্তকাজ পরিচালনা করাটা সিআইওর জন্য সহজ বিষয় নয়।

আরও পড়ুন

অতীতে দক্ষিণ কোরিয়ার একাধিক সাবেক প্রেসিডেন্ট জেল খেটেছেন। কিন্তু ইউন প্রথম ব্যক্তি, যিনি প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করার আগে, অর্থাৎ পদে বর্তমান থাকা অবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। আর এই পরোয়ানার ধারাবাহিকতায় তিনি এখন গ্রেপ্তার হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন।

ইউনের বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানার মেয়াদ আজ সোমবার (৬ জানুয়ারি) শেষ হচ্ছে। আজকের মধ্যে তাঁকে গ্রেপ্তার করতে তদন্তকারীরা ব্যর্থ হলে তাঁরা নতুন করে পরোয়ানা চাইতে পারেন। সে ক্ষেত্রে নতুন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।