৭৯ বছর আগের এই দিনে থেমে গিয়েছিল যুদ্ধের দামামা। ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট আত্মসমর্পণ করে জাপান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় এই দিন। যুদ্ধ শেষে আসে শান্তি। তবে থেকে যায় বিভীষিকাময় স্মৃতি। আজ সেই ১৫ আগস্ট। হামলা, যুদ্ধ, ধ্বংস, হিরোশিমা-নাগাসাকির ভয়াবহতা আর জাপানের আত্মসমর্পণের সেই দিনগুলো ফিরে দেখা যাক আজ।
সম্রাট হিরোহিতোর সাম্রাজ্য বিস্তারের নামে জাপান এশিয়ার বিভিন্ন অংশে হামলা শুরু করে। শুরু হয় দখলদারত্ব। একক ক্ষমতার বলয় গড়ে তুলতে ১৯৪০ সালে জার্মানি ও ইতালির সঙ্গে হাত মেলায় জাপান। এরপরই শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। শুরু করা যাক ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে।
৭ ডিসেম্বর ১৯৪১: হাওয়াই দ্বীপের মার্কিন নৌঘাঁটি পার্ল হারবারে বোমা ও যুদ্ধবিমান নিয়ে হামলা চালায় জাপান। এ হামলায় ২ হাজার ৩০০ মার্কিন নিহত হন। আহত হন ১ হাজার ২০০ জন। ২১টি মার্কিন জাহাজ ডুবে যায়। শত শত বিমান ধ্বংস হয়। এ হামলার পর বসে থাকেনি যুক্তরাষ্ট্র। পরদিনই যুদ্ধ ঘোষণা করে। জার্মানিও পাল্টা জবাব দিতে এগিয়ে আসে। তিন দিন পর যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে জার্মানি। পার্ল হারবারে হামলার কিছু আগেই অবশ্য পশ্চিম মালয়ের পূর্ব উপকূলে জাপানি সেনারা নেমে যান। সিঙ্গাপুরের দক্ষিণে বিশাল এলাকা দখল করে ফেলেন।
১৫ জানুয়ারি ১৯৪২: এরপর পাঁচ সপ্তাহে আর তেমন বড় হামলা হয়নি। তবে ১৫ জানুয়ারি আরেকটি বড় হামলার ঘটনা ঘটে। থাইল্যান্ড থেকে আসা জাপানি স্থলবাহিনী সীমান্ত পেরিয়ে বর্তমান মিয়ানমারের দক্ষিণে হামলা চালায়। ব্রিটিশ সেনারা পাল্টা হামলা চালান। তবে জাপানের যুদ্ধকৌশলের কাছে হার মানতে হয়। মে মাসের শেষ দিকে মিয়ানমারের পতন হয়।
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪২: দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের পর এই দিনে সিঙ্গাপুরে ব্রিটিশ কমনওয়েলথ বাহিনীর কমান্ডার, লেফটেন্যান্ট জেনারেল আরথার পারসিভাল জাপানের লেফটেন্যান্ট জেনারেল টমোইউকি ইয়ামাশিতার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এর জের টানতে হয় সিঙ্গাপুরকে। এ সময় পর্যন্ত জাপানের দখলে ছিল সিঙ্গাপুর।
এপ্রিল ১৯৪২: ফিলিপাইনের বাতান প্রদেশে তিন মাস ধরে যুদ্ধ চলে। এর জেরে অত্যন্ত খারাপ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিপাইনের যুদ্ধবন্দীরা প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে বাধ্য হন। শারীরিক নির্যাতন, আমাশয় ও অন্যান্য রোগে ভুগে অনেকেই পথে মারা যান। বোর্নিওর উত্তর–পূর্ব উপকূলে মালয়েশিয়ার সাবাহ রাজ্যের সানডাকান এলাকাতেও এভাবে মৃত্যুর মিছিল দেখা যায়। পরে এ দুই ঘটনারই যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিচার হয়।
আগস্ট ১৯৪২: প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানি ও মার্কিন সেনারা দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে যুদ্ধ করে যাচ্ছিলেন। সোলোমন দ্বীপপুঞ্জে গুয়াডালক্যানালে যুদ্ধ চলে ছয় মাস ধরে। প্রশান্ত মহাসাগরে অন্যতম বড় নৌযুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হয় ‘ব্যাটল অব মিডওয়েকে’। এখানে জাপানের মিত্রশক্তিরা বড় বিজয় অর্জন করে।
অক্টোবর ১৯৪৪: তখন মার্কিন বাহিনীর কাছে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে ফিলিপাইন। লেইতে দ্বীপে জাপানি বিমানবাহিনীর বিশেষ শাখা ‘কামিকাজে স্পেশাল অ্যাটাক ইউনিট’ প্রথম হামলা চালায়। এ সময় শত্রুর লক্ষ্যবস্তুতে বিমানসহ আত্মঘাতী হামলা করা হয়। জাপানের জন্য এই কামিকাজে হামলা বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রায় চার হাজার কামিকাজে পাইলট নিহত হন। ৩৪টি মার্কিন জাহাজ ডুবে যায়।
ফেব্রুয়ারি ১৯৪৫: যুদ্ধে বিদায়ঘণ্টা বাজতে শুরু করে জাপানের। ইয়ো জিমা দ্বীপে ৩০ হাজারের বেশি মার্কিন সেনার সঙ্গে ২১ হাজার জাপানি সেনার যুদ্ধ চলছিল সেদিন। এই প্রথম জাপানের ভূখণ্ডে হামলা হয়। ৩৬ দিন ধরে ওই যুদ্ধে সেখানে মোতায়েন জাপানের প্রায় সব সেনার প্রাণ যায়। সেই সঙ্গে নিহত হন সাত হাজার মার্কিন নৌসেনা।
৬ আগস্ট ১৯৪৫: আসে সেই ভয়ংকর দিন। জাপানের প্রধান দ্বীপ হনশুর হিরোশিমায় ‘লিটল বয়’ আণবিক বোমা ফেলে যুক্তরাষ্ট্র। মুহূর্তেই প্রলয় শুরু হয়। হামলার সময় ও এর ভয়াবহ তেজস্ক্রিয়তার কারণে বছরের শেষ পর্যন্ত নিহত মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৪০ হাজার। সে সময় হিরোশিমার বাসিন্দা ছিল ৩ লাখ ৫০ হাজার। এর তিন দিন পর নাগাসাকি শহরে যুক্তরাষ্ট্র ‘ফ্যাট ম্যান’ নামে আরেকটি আণবিক বোমা ফেলে। সেদিনই ৭০ হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। দীর্ঘ মেয়াদে নিহত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল আরও অনেক বেশি।
১৫ আগস্ট ১৯৪৫: হিরোশিমা ও নাগাসিকির হামলার পর ধ্বংসযজ্ঞের আর কিছুই বাকি ছিল না। সে কথা অনুধাবন করেছিলেন জাপানের সম্রাট হিরোহিতো। তাই রেডিওতে সম্প্রচারিত ভাষণে আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেন তিনি। শেষ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫: পরেরটুকু কেবলই আনুষ্ঠানিকতা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মামোরু সিগেমিতসুর নেতৃত্বে জাপানের প্রতিনিধিদল ইউএসএস মিজৌরিতে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মার্কিন জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থার।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, উইকিপিডিয়া, এনবিসি, এএফপি, হিস্ট্রি অন ডেজ অবলম্বনে