আল–জাজিরায় নিবন্ধ
জাওয়াহিরি হত্যাকাণ্ড কি তালেবানের জন্য দুঃসংবাদ
মার্কিন ড্রোন হামলায় আল-কায়েদাপ্রধান আয়মান আল-জাওয়াহিরির নিহত হওয়ার ঘটনা জঙ্গি সংগঠনটির ওপর কী প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়ে আল-জাজিরায় একটি নিবন্ধ লিখেছেন গবেষক আবদুল বাসিত। তিনি সিঙ্গাপুরের এস রাজারাথম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো।
৩১ জুলাই। আফগানিস্তানের কাবুলের একটি সুরক্ষিত বাসভবনে এদিন সাতসকালে ড্রোন হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। তাতে নিহত হন আল–কায়েদার প্রধান ৭১ বছর বয়সী আয়মান আল–জাওয়াহিরি। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, এই বাড়িতে কয়েক মাস ধরে সপরিবার বসবাস করছিলেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেন ভয়াবহ হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে ধরা হয় আল–জাওয়াহিরিকে। তাঁকে হত্যা করা দেশটির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। গত বছরের আগস্টে আফগানিস্তান থেকে পিছু হটার পর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিশ্বজুড়ে তাঁর কথিত সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে একটা বড় সাফল্য পাওয়া জরুরি হয়ে পড়েছিল। একই সময়ে আল–কায়েদার জন্য জাওয়াহিরি হত্যাকাণ্ড বিশাল ধাক্কা। দীর্ঘদিন ধরেই সংগঠনটি অর্থনৈতিক সংকট, সীমিত কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল, অন্তর্দ্বন্দ্ব ও ভৌগোলিকভাবে আশ্রয় পাওয়ার অভাব—এমন সমস্যায় রয়েছে।
যাহোক, এই হত্যাকাণ্ড আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। কেননা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর তালেবান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি আদায়ের জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ও আল–কায়েদা উভয়ের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক রক্ষার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার জন্য তালেবান নেতাদের ওপর চাপ তৈরি করবে এ হত্যাকাণ্ড।
উভয় সংকটে তালেবান
মার্কিন হামলায় পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে আল–কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার পর ২০১১ সালে তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে সংগঠনটির প্রধানের দায়িত্ব নেন জাওয়াহিরি। তিনি একজন অনন্য প্রতিভার অধিকারী না হলেও ছিলেন দক্ষ নেতা। আল–কায়েদার ঘোর দুঃসময়ে এর নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন তিনি। একই সঙ্গে সক্ষম হয়েছেন সংগঠনটিকে বাঁচিয়ে রাখতে। যদিও বিভিন্ন সময়ে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছেন সংগঠনের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। এরই মধ্যে ২০১৪ সালে আল–কায়েদার ইরাক শাখা সংগঠনটি থেকে বেরিয়ে গঠন করে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আইএস।
আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে রোববারের হত্যাকাণ্ডের আগপর্যন্ত ধীরে, কিন্তু স্থিরভাবে নিজেদের পুনরুজ্জীবিত করছিল আল–কায়েদা।
যুক্তরাষ্ট্রের আশীর্বাদপুষ্ট আশরাফ গনি সরকারকে ঝোড়োগতিতে হটিয়ে তালেবান ক্ষমতা দখল করার পর তাদের জয়কে উদ্যাপন করে সংগঠনটি। যেন মনে করছিল, এটি তাদের (আল–কায়েদা) বিজয়। তখন থেকে মাঝেমধ্যেই আগের চেয়ে বেশিসংখ্যক প্রচারণামূলক ভিডিও প্রকাশ করছিলেন জাওয়াহিরি। ভিডিওতে তাঁর আত্মবিশ্বাস বেড়ে চলার কথা জানাচ্ছিলেন। তালেবান শাসনে আফগানিস্তানে আল–কায়েদার অধিকতর স্বাধীনভাবে তৎপরতা চালানোর সুযোগ পাওয়ার বিষয়টি জাতিসংঘের সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনেও নিশ্চিত করা হয়। প্রতিবেদনে এমন ইঙ্গিতও দেওয়া হয়, সংগঠনটির কিছু সদস্য তালেবান সরকারকে পরামর্শও দিয়ে থাকতে পারেন।
জাওয়াহিরি হত্যাকাণ্ডের আগপর্যন্ত তালেবান ও আল-কায়েদার সম্পর্ক ছিল আস্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমর নাইন–ইলেভেন হামলার পর আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেনকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়ার চেয়ে দেশটির আগ্রাসনের সম্মুখীন হওয়া ও ক্ষমতা হারানোকে বেছে নিয়েছিলেন।
আফগান প্রেসিডেন্ট প্যালেস থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে রাজধানী কাবুলের একটি নিরাপদ বাড়িতে নিহত হন জাওয়াহিরি। এ ঘটনা তালেবান ও আল–কায়েদার মধ্যে অব্যাহত অংশীদারি সম্পর্ক চলা নিয়ে অন্য যেকোনো সন্দেহ দূর করে দেয়।
জাওয়াহিরি হত্যা অনস্বীকার্য, এ প্রমাণও পেশ করে যে তালেবান ২০২০ সালের দোহা চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন করেছে। চুক্তি অনুযায়ী, আফগানিস্তান থেকে পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহার করে নেয় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী। তালেবানও প্রতিশ্রুতি দেয়, তাদের শাসনামলে আল–কায়েদাকে তারা আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করতে দেবে না। এখন দেখা যাচ্ছে, তালেবান আল-কায়েদার সঙ্গে শুধু সম্পর্কই রক্ষা করেনি, বরং সংগঠনটির প্রধানকেও কাবুলে আশ্রয় দিয়েছে।
জাওয়াহিরি হত্যাকাণ্ড তালেবানকে দুই দিক থেকে জটিল অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। একদিকে, এটি তালেবান শাসনের ব্যাপারে ওয়াশিংটনের সর্বশেষ যেকোনো আস্থা নষ্ট করতে পারে। ছেদ টানতে পারে শিগগিরই তালেবান সরকারের আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি পাওয়ার সুযোগেও। এটা নিশ্চিত, নাইন-ইলেভেন হামলা সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সহায়তাকারী আল–কায়েদা প্রধানকে কাবুলে থাকার সুযোগ দেওয়ায় কোনো দেশই বিশ্বাস করবে না, আফগানিস্তানকে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর স্বর্গ হয়ে ওঠা ঠেকাতে তালেবান কাজ করছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও আল-কায়েদা উভয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করার বাইরে জাওয়াহিরি হত্যা তালেবানের ভেতরও ক্ষতি করবে। এ হত্যাকাণ্ড তালেবানের অভ্যন্তরে বাস্তববাদী ও ভাবাদর্শীদের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে জোরাল করবে। বাস্তববাদী অংশ চায়, আল-কায়েদা ও হক্কানি নেটওয়ার্কের মতো কট্টরপন্থী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে দূরত্ব। আর এই গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী অপর অংশ।
অন্যদিকে, আল–কায়েদার সঙ্গে তালেবানের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে জাওয়াহিরি হত্যার এ ঘটনা, যে সম্পর্ক কখনো মেরামত হওয়ার নয়। এ হত্যাকাণ্ডের আগপর্যন্ত তালেবান ও আল–কায়েদার সম্পর্ক ছিল আস্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমর নাইন-ইলেভেন হামলার পর আল–কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেনকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়ার চেয়ে দেশটির আগ্রাসনের সম্মুখীন হওয়া ও ক্ষমতা হারানোকে বেছে নিয়েছিলেন।
জাওয়াহিরি হত্যার ঘটনায় আল–কায়েদা নিঃসন্দেহে তালেবানের ওপর আস্থাসংকটে ভুগবে। সংগঠনটির কিছু সদস্য এই হত্যাকাণ্ডকে তালেবানের পক্ষ পরিবর্তনের ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন। অন্যরা এটি দেখছেন তালেবানের ক্রমবর্ধমান অক্ষমতার ফল হিসেবে। উভয় ক্ষেত্রে, আসলে কী ঘটেছে এবং তালেবানের সহযোগী আল–কায়েদার সঙ্গে কেন এমনটা ঘটেছে, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে তালেবান নেতাদের ঘাম ঝরাতে হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র ও আল–কায়েদা উভয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করার বাইরে জাওয়াহিরি হত্যা তালেবানের ভেতরও ক্ষতি করবে। এই হত্যাকাণ্ড তালেবানের অভ্যন্তরে বাস্তববাদী ও ভাবাদর্শীদের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে জোরাল করবে। বাস্তববাদী অংশ চায়, আল–কায়েদা ও হক্কানি নেটওয়ার্কের মতো কট্টরপন্থী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে দূরত্ব। আর এ গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী অপর অংশ।
আল–কায়েদার শেষ এটা?
মার্কিন অভিযানে ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার পর জাওয়াহিরি হত্যার ঘটনা আল–কায়েদার ওপর অন্যতম বড় আঘাত। এর অভিঘাত মোকাবিলা করা সংগনঠটির পক্ষে কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতে পারে। আল–কায়েদার পরবর্তী নেতৃত্বের প্রশ্নে দুটি নাম আলোচিত হচ্ছে। প্রথমজন সংগঠনটির উপপ্রধান মিসরীয় বংশোদ্ভূত সাইফ আল–আদেল। দ্বিতীয়জন তাঁর জামাতা মরক্কো বংশোদ্ভূত আব্দ আল–রেহমান আল–মাঘরিবি। তিনি আল–কায়েদার গণমাধ্যম শাখার প্রধান। দুজনই বর্তমানে ইরানে বসবাস করছেন।
২০২০ সালের নভেম্বরে ইরানের রাজধানী তেহরানে ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন আল–কায়েদার তৎকালীন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা আবু মুহাম্মদ আল–মাসরি। এই হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে ইরানে অবস্থান করে সাইফ আল–আদেল ও রেহমান আল–মাঘরিবির জন্য সংগঠন পরিচালনা করা কঠিন ও অনিরাপদ হতে পারে। এমনকি কাবুলে জাওয়াহিরি হত্যার ঘটনায় আল–কায়েদা ও তালেবানের মধ্যকার সম্পর্কে যে বিশ্বাসহীনতা দেখা দিয়েছে, তার প্রেক্ষাপটে এ দুজন আফগানিস্তানে অবস্থান করে সংগঠন পরিচালনা করতে নিরাপদ বোধ করবেন না।
মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান করে সংগঠন পরিচালনা করতে গিয়ে উদ্ভূত নিরাপত্তাহীনতা আল–কায়েদার পরবর্তী নেতৃত্বকে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে সংগঠনের বিস্তৃতি ঘটানো ও সেসব জায়গায় অবস্থান করে সংগঠন পরিচালনায় আগ্রহী করতে পারে।
বর্তমানে আফ্রিকার দেশ সোমালিয়ায় আল–কায়েদার সাংগঠনিক ভিত্তি বেশ মজবুত।সেখানে আহমেদ দিরাইয়ের নেতৃত্বে সোমালি আল–শাবাব কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আল–কায়েদার সব শাখার মধ্যে সোমালি আল–শাবাবকে সবচেয়ে শক্তিশালী ও সম্পদশালী বিবেচনা করা হয়। কিন্তু আহমেদ দিরাইয়ে একজন অনারব। তিনি আল–কায়েদার পরবর্তী নেতা হলে তা সিরিয়া, ইয়েমেন, পাকিস্তানে সংগঠনের নেতা–কর্মীদের ক্ষুব্ধ করতে পারে; যা সংগঠনটিতে ভাঙনের পথ প্রশস্ত করার ঝুঁকি তৈরি করবে। তাই বলা যায়, আগামী দিনগুলোয় জাওয়াহিরির উত্তরসূরি নির্বাচনে আল–কায়েদাকে বেশ মুশকিলে পড়তে হবে।
এ মুহূর্তে আল–কায়েদা শুধু তাদের সর্বোচ্চ নেতাকে হারিয়েছে তা–ই নয়, সংগঠনটি তালেবাননিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানে তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলও খুইয়েছে। একই সঙ্গে আফ্রিকা মহাদেশে আইএসের ক্রমবিস্তারের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে সংগঠনটিকে। জাওয়াহিরি হত্যার ঘটনায় এ চ্যালেঞ্জ আরও জোরালো হতে পারে।
এক দশকের কিছু বেশি সময় আল–কায়েদার সর্বোচ্চ নেতা ছিলেন জাওয়াহিরি। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই সংগঠনের সমাপ্তির সূচনা দেখছেন অনেকেই। এ ঘটনা তালেবানের জন্যও একটি বড় ধাক্কা হতে পারে। কেননা এমন একসময় এ হত্যাকাণ্ড ঘটল, যখন আফগানিস্তানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রয়েছে তালেবান সরকার। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন তালেবান নেতারা। এখন আল–কায়েদার সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কের বিষয়টি এ ক্ষেত্রে প্রভাবক হয়ে উঠতে পারে। এমনকি আগামী দিনগুলোতে আল–কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ও নতুন করে ভাবতে পারে তালেবান।
মধ্যপ্রাচ্যে আইএসের কার্যত পতন ঘটেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে সিরিয়ায় নিহত হয়েছেন আইএস নেতা আবু ইব্রাহিম আল–কুরাইশি। এ সবই প্রমাণ করে, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সোনালি সময়ের ইতি ঘটেছে। এদের প্রভাব, প্রতিপত্তি ও কার্যক্রম এখন তলানির দিকে। তারপরও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের হুমকি এখনো পুরোপুরি দূর হয়নি। এ হুমকি প্রতিহত করতে ঝুঁকিতে থাকা দেশ ও অঞ্চলগুলোয় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন, সার্বক্ষণিক নজরদারি পরিচালনা এবং কার্যকর হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে।
ভাষান্তর: মো. আবু হুরাইরাহ্ ও অনিন্দ্য সাইমুম ইমন