জনগণকে মুরগির পা খেতে বলেছে মিসর সরকার, কারণ কী
ভালো নেই বৈশ্বিক অর্থনীতি। আরব দেশ মিসরের অবস্থাও একই। বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ মূল্যস্ফীতির খপ্পরে পড়েছে দেশটি। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে সাধারণ খাদ্যপণ্যও অনেক মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
দিন দিন দাম বাড়তে থাকা এসব খাদ্যপণের মধ্যে রয়েছে মুরগিও। ২০২১ সালে দেশটিতে এক কেজি মুরগির দাম ছিল ৩০ মিসরীয় পাউন্ড, যা বাংলাদেশের হিসাবে ১১৭ টাকা। আর গত সোমবার এক কেজি মুরগি কিনতে হয়েছে ৭০ মিসরীয় পাউন্ড বা ২৫১ টাকায়।
এদিকে মুরগির পা খেতে বলার পর দেখা দিয়েছে আরেক বিপত্তি। এক কেজি মুরগির পায়ের দাম বেড়ে এখন ২০ মিসরীয় পাউন্ড, যা আগের দামের দ্বিগুণ।
মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে মুরগির দাম দ্বিগুণের বেশি হওয়ায় অনেকেই তা কিনতে পারছেন না। ফলে দেখা দিয়েছে পুষ্টির ঘাটতি। এমন পরিস্থিতিতে গত ডিসেম্বরে মিসরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর নিউট্রিশন পুষ্টির ঘাটতি পূরণে বিকল্প খাবারের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। ওই তালিকায় রয়েছে মুরগির পা, এমনকি গবাদিপশুর খুরও।
সরকারের এমন আহ্বানে চটেছেন অনেক মিসরীয়। তাঁদের মনে হয়েছে, এই মাধ্যমে যেন ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে মিসরকে অতি দরিদ্র দেশ। এমন মনে করার অবশ্য কারণও আছে, মিসরে মাংসজাতীয় খাবারের মধ্যে সবচেয়ে কম দাম মুরগির পায়ের। এটিকে খাদ্যের চেয়ে বর্জ্য হিসেবেই বিবেচনা করে তারা।
বিগত বছরগুলোতে মিসরে অনেক মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আফ্রিকার সবচেয়ে উঁচু টাওয়ার নির্মাণ এবং মরুভূমির মধ্যে একটি নতুন রাজধানী গড়ে তোলা।
এমনই একজন মিসরের গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ আল–হাশিমি। নিজের চার লাখ অনুসারীর উদ্দেশে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তিনি বলেন, ‘আমরা মুরগির পায়ের যুগে প্রবেশ করেছি। এতে করে মিসরীয় পাউন্ডের যে অবস্থা খারাপ আর দেশ যে দিন দিন ঋণের দায়ে ডুবে যাচ্ছে, তা ফুটে উঠেছে।’
এদিকে মুরগির পা খেতে বলার পর দেখা দিয়েছে আরেক বিপত্তি। এক কেজি মুরগির পায়ের দাম বেড়ে এখন ২০ মিসরীয় পাউন্ড, যা আগের দামের দ্বিগুণ। মিসর সরকার বলছে, দেশটির প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। তবে ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাংকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মিসরের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ হয় দরিদ্র অথবা ঝুঁকিতে রয়েছে।
যেভাবে এই সংকটে মিসর
বিগত কয়েক দশকে বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে মিসর। এতে করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও উপসাগরীয় মিত্রদেশগুলোর কাছে জরুরি প্রণোদনা সহায়তা (বেলআউট) চাইতে হয়েছিল কায়রোকে। সব মিলিয়ে এক ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছে দেশটি। আইএমএফ বলছে, চলতি বছরে মিসরের মোট অর্থনীতির ৮৫ দশমিক ৬ শতাংশই ঋণ।
বিশেষজ্ঞদের অনেকের ভাষ্যমতে, এ অবস্থার পেছনের কারণগুলোর একটি মিসরের সামরিক বাহিনীর ভূমিকা। এর ফলে দেশটির বেসরকারি খাত নাজুক হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া বিগত বছরগুলোতে দেশটিতে অনেক মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আফ্রিকার সবচেয়ে উঁচু টাওয়ার নির্মাণ এবং মরুভূমির মাঝে একটি নতুন রাজধানী গড়ে তোলা। এর পেছনে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া গত দুই বছরে করোনা মহামারি ও রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ মিসরকে অর্থনৈতিকভাবে আরও পিছিয়ে নিয়েছে। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে, বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, করোনার কারণে ২০২০ সালে মিসর থেকে দুই হাজার ডলার তুলে নিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত বছরও বহু বিনিয়োগকারী প্রায় একই পরিমাণ অর্থ তুলে নিয়েছেন।
ওয়াশিংটনভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা তাহরির ইনস্টিটিউট ফর মিডল ইস্ট পলিসির গবেষক টিমোথি কালডাস বলেন, ২০১৬ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আইএমএফ থেকে মিসর যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, তার সমান হচ্ছে এই দুই হাজার কোটি ডলার। গত বছরে মাত্র এক সপ্তাহেই এ অর্থ মিসর থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসব কারণেই আজকের দিনে মিসরের এই অর্থনৈতিক দৈন্য।
গত বছরে মিসরীয় পাউন্ডের মান প্রায় অর্ধেক কমেছে। আর গত সপ্তাহে এক ডলারের বিনিময়ে পাওয়া যাচ্ছিল ৩০ মিসরীয় পাউন্ড। এটা মিসরের ইতিহাসে একটি রেকর্ড।
তবে এ অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতে চাইছে মিসর। গত ডিসেম্বরে দেশটিকে বেলআউট দিতে রাজি হয়েছে আইএমএফ। এরই মধ্যে ৩০০ কোটি ডলারও দিয়েছে তারা। এ প্রণোদনা সহায়তার পর তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশগুলোসহ অনেক মিত্রদেশ আরও ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দিতে পারে বলে আশা করছে মিসর।