দক্ষিণ কোরিয়ার অভিশংসিত প্রেসিডেন্টের সমর্থকেরা কেন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা ওড়াচ্ছেন
অভিশংসিত হয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল। শুক্রবার সকালে তাঁকে গ্রেপ্তার করতে গিয়েছিলেন তদন্তকারীরা। এ সময় রাজধানী সিউলে ইউনের সরকারি বাসভবনের বাইরে জড়ো হন তাঁর সমর্থকেরা। তাঁদের হাতে দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় পতাকার পাশাপাশি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা। শেষ পর্যন্ত ইউন সুক-ইওলকে গ্রেপ্তার না করে ফিরে যায় পুলিশ।
একসঙ্গে দুই দেশের পতাকা ওড়ানোটা অনেককেই অবাক করে দিতে পারে। তবে ইউন সুক-ইওলের সমর্থকেরা যুক্তরাষ্ট্রকে শুধু একটি মিত্রের চেয়ে বড় কিছু বলে মনে করেন। তাঁদেরই একজন ৭৪ বছর বয়সী পিয়ং ইন-সু। তিনি বলেন, দক্ষিণ কোরিয়ার ‘দেশপ্রেমী নাগরিকদের’ বাধার কারণে পুলিশ ইউনকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউনের সহায়তায় এগিয়ে আসবেন বলে মনে করেন পিয়ং ইন-সু। তাঁর হাতে থাকা দুই দেশের পতাকায় লেখা ছিল, ‘চলুন, একসঙ্গে এগিয়ে যাই।’ পতাকা ওড়াতে ওড়াতে পিয়ং বলেন, ‘আশা করি, আমাদের দেশকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে অভিষেকের পর নিজের প্রভাব কাজে লাগাবেন ট্রাম্প।’
দক্ষিণ কোরিয়ায় নিজেদের বিরোধী পক্ষকে শত্রুদেশ উত্তর কোরিয়ার আজ্ঞবহ বলে মনে করেন ইউনের সমর্থকেরা। তবে একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘পূজায়’ নামতেও পিছপা হন না নিজেরা। তাঁরা প্রায়ই মনে করিয়ে দেন, জাপানের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে কোরিয়াকে স্বাধীন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত চলা কোরিয়া যুদ্ধেও দক্ষিণ কোরিয়াকে রক্ষা করেছিল ওয়াশিংটন।
ইউনের এই সমর্থকেরা দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ নন; বরং প্রান্তিক বলা চলে। যুক্তরাষ্ট্রের অধিকারসংক্রান্ত যেসব বুলি রয়েছে, সেগুলো বিগত কয়েক বছরে আরও বেশি আত্মস্থ করেছেন তাঁরা। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের মতো নির্বাচনী জালিয়াতি নিয়ে কথা বলা বাড়িয়েছেন। গত মাসে ইউন সামরিক আইন জারি কারার পর তাঁর সমর্থকদের মধ্যে এ প্রবণতা বেড়েছে।
৩ ডিসেম্বর সামরিক শাসন জারি করেছিলেন ইউন সুক–ইওল। দক্ষিণ কোরিয়ায় নির্বাচনে জালিয়াতি করা হয়েছে এবং দেশটিতে ‘উত্তর কোরিয়াপন্থী এবং দেশবিরোধী শক্তির’ উপস্থিতি রয়েছে দাবি করে সামরিক শাসন জারির সিদ্ধান্তকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। তবে তা সফল হয়নি। ওই সিদ্ধান্তের জেরেই তাঁকে অভিশংসন করা হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত।
ইউনের নির্বাচনী জালিয়াতির দাবির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যানের আন্দোলনের মিল পাওয়া যায়। দক্ষিণ কোরিয়ায় চলতি সপ্তাহে করা একটি জরিপে দেখা গেছে, ইউনের রক্ষণশীল পিপল পাওয়ার পার্টির ৬৫ শতাংশ সমর্থক মনে করেন, গত এপ্রিলে দেশটির পার্লামেন্ট নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে। যদিও সাধারণ মানুষের মাত্র ২৯ শতাংশ জালিয়াতি হয়েছে বলে মনে করে থাকেন।
একটি জরিপে দেখা গেছে, ইউনের রক্ষণশীল পিপল পাওয়ার পার্টির ৬৫ শতাংশ সমর্থক মনে করেন, গত এপ্রিলে দেশটির পার্লামেন্ট নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে।
এপ্রিলে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টিসহ বিরোধী দলগুলো বড় জয় পেয়েছিল। পার্লামেন্টের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৯২টি আসনই জিতেছিল তারা। আদালত বা বড় কোনো নির্বাচন পর্যবেক্ষক ওই নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেনি। জালিয়াতির দাবিগুলোর সপক্ষে কোনো প্রমাণ না থাকায়, সেগুলোও আমলে নেওয়া হয়নি।
নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে বলে দাবি করার এই কৌশল দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র—দুই দেশেই দেখা গেছে। কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে নির্বাচনের স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ করা, ধর্মীয় মূল্যবোধের মাধ্যমে নৈতিক কর্তৃত্ব দাবি করা এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের দেশের শত্রু হিসেবে তুলে ধরা।
দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতিতে ইউন সমর্থকদের এই তৎপরতার শুরুটা জানতে হলে ফিরতে হবে দেশটিতে প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চগুলোর উত্থানের সময়ে। এই চার্চগুলোই ইউনের সবচেয়ে উৎসাহী সমর্থকদের শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। এসব চার্চের অনেকগুলোই গড়ে তুলেছিলেন কোরিয়া যুদ্ধের আগে উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা খ্রিষ্টানেরা। এ কারণে চার্চগুলোর মধ্যে কমিউনিস্ট বিরোধী কট্টর আদর্শ ঢুকে গিয়েছিল।
এই চার্চগুলোসহ প্রভাবশালী সারাং জেইল চার্চ মধ্য সিউলের গোয়াংহয়ামুন স্কয়ারে প্রায়ই সমাবেশের আয়োজন করত। সেখানে সব বিরোধীদের ‘কমিউনিস্ট’ তকমা দিয়ে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেওয়ার কথা বলা হতো। চার্চগুলোর সাপ্তাহিক সমাবেশ যুক্তরাষ্ট্রের দর্শকদের জন্য লাইভ এবং ইংরেজিতে অনুবাদ করা হতো। আন্তর্জাতিক অনুদান পাওয়ার জন্য দেওয়া হতো ব্যাংক হিসাবের নম্বর।
ইউন সুক-ইওলকেও এই চার্চগুলোর সুরে সুর মেলাতে দেখা গেছে। ইউটিউবে তাঁদের সম্প্রচার করা ভিডিও দেখেন বলেও স্বীকার করেছেন তিনি।
ইউন সুক–ইওলকেও এই চার্চগুলোর সুরে সুর মেলাতে দেখা গেছে। ইউটিউবে তাঁদের সম্প্রচার করা ভিডিও দেখেন বলেও স্বীকার করেছেন তিনি। খ্রিষ্টীয় নববর্ষের দিন নিজের সমর্থকদের সতর্ক করে ইউন বলেছেন, দক্ষিণ কোরিয়ার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করছে বিভিন্ন শক্তি। একই সঙ্গে এই শক্তির বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন তিনি।
শুক্রবার প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের বাইরে অবস্থান নেওয়া লোকজনের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে দুটি ভাষায় কিছু কথা লেখা ছিল। কোরীয় ভাষায় লেখা হয়েছিল—‘নির্বাচনে জালিয়াতি’। আর ইংরেজিতে লেখা ছিল—‘চুরি বন্ধ করুন।’ তাঁদের কাছে অবশ্য নির্বাচনে জালিয়াতির প্রমাণ চাওয়া হয়েছিল। তবে কেউই তা দিতে পারেননি।