হত্যার শিকার সাংবাদিকের ক্যামেরাটি ১৬ বছর পর ফিরে পেল পরিবার
সময়টা ২০০৭ সাল। মিয়ানমারে তখন জান্তাবিরোধী তুমুল বিক্ষোভ চলছে। সেই খবর সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন জাপানের সাংবাদিক কেনজি নাগাই। কিন্তু মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তাঁর প্রাণ যায়। শেষ মুহূর্তেও তাঁর হাতে ছিল নিহত হওয়ার পর নাই হয়ে যাওয়া ভিডিও ক্যামেরা। তাই এতে কী ধারণ করা হয়েছে, তা এত দিন ছিল অজানাই।
১৬ বছর পর গত বুধবার সেই ক্যামেরা ও এর ভেতরে থাকা ফুটেজ নিহত সাংবাদিকের পরিবারের হাতে ফিরেছে। এদিন থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে কেনজির বোন নোরিকো ওগাওয়ার হাতে ক্যামেরাটি তুলে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের আশা, হয়তো ক্যামেরার এ ফুটেজ থেকে কেনজির জীবনের শেষ মুহূর্ত সম্পর্কে জানা যাবে।
কেনজি তখন টোকিওভিত্তিক একটি ছোট সংস্থা এপিএফ নিউজের জন্য কাজ করেন। তৎকালীন জান্তা শাসনের বিরুদ্ধে ভিক্ষুদের নেতৃত্বে চলা বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহ করতে তিনি মিয়ানমারে এসেছিলেন।
২০০৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ইয়াঙ্গুনের কাছে সুলে প্যাগোডার কাছে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি ছোড়ে মিয়ানমারের বাহিনী। তখন সেখানে ছিলেন সাংবাদিক কেনজিও। অনেকের সঙ্গে সেখানে সেদিন নিহত হন তিনিও। সেদিনের জেনারেলদের নৃশংস এ দমনপীড়ন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নজর কাড়ে।
ওই দিনের একটি দৃশ্য ছিল এমন। গুরুতর আহত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছেন নাগাই। সামরিক বাহিনীর পোশাক পরা এক ব্যক্তি তাঁর দিকে বন্দুক তাক করে আছেন। নাগাইয়ের মাথার ওপরের দিকে রাস্তায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে স্যান্ডেল। ওই অবস্থায়ও তিনি বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ ও সেনাদের দমনপীড়নের দৃশ্য ধারণের চেষ্টা করছিলেন। এ ছবিটির জন্য ২০০৮ সালে ব্রেকিং নিউজ ফটোগ্রাফিতে পুলিৎজার পুরস্কার পায় রয়টার্স। ছবিটি তুলেছিলেন রয়টার্সের ফটোসাংবাদিক আদ্রিস লতিফ।
প্রকাশিত হলো ফুটেজ
নাগাইয়ের বোন নোরিকো ওগাওয়া ভাইয়ের ক্যামেরাটি ফেরত পেয়ে বেশ রোমাঞ্চিত ও আনন্দিত। ক্যামেরাটি ফেরত চাওয়ার পর মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ না করে দিয়েছিল। এরপর আর কোনো দিন ক্যামেরার ফুটেজ দেখতে পারবেন, এমন আশা তিনি ছেড়েই দিয়েছিলেন।
নোরিকো বলেন, ‘আমার মনে হয় ভাই এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমি এটা তাঁর সমাহিত হওয়ার স্থানে নিয়ে যেতে চাই।’ কেনজি নিহত হওয়ার ঘটনায় কাউকে অভিযুক্ত করা হয়নি। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের দাবি এ হত্যাকাণ্ড একটি ‘দুর্ঘটনা’।
কিন্তু জাপানে নাগাইয়ের মরদেহের ময়নাতদন্তে দেখা গেছে, খুব কাছ থেকে, আনুমানিক ৩ ফুট দূর থেকে গুলি করে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।
বুধবার থাইল্যান্ডের ব্যাংককের ফরেন করেসপন্ডেন্টস ক্লাবে নাগাইয়ের ক্যামেরা থেকে পাওয়া ফুটেজ প্রথমবারের মতো গণমাধ্যমকর্মীদের দেখানো হয়।
ফুটেজে দেখা যায়, ইয়াঙ্গুন শহরের কেন্দ্রস্থলে বিশাল বিক্ষোভ চলছে। সেখানে বিক্ষোভকারীরা গান গাইছেন। মারদাঙ্গা পুলিশ ও সেনারা যখন তাঁদের দিকে তেড়ে আসেন, তখন বেতের তৈরি ঢাল ও রাইফেল নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন তাঁরা।
২০০৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ইয়াঙ্গুনের কাছে সুলে প্যাগোডার কাছে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি ছোড়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তখন সেখানে ছিলেন সাংবাদিক কেনজিও। অনেকের সঙ্গে সেখানে সেদিন মৃত্যু হয় তাঁরও। সেদিনের জেনারেলদের নৃশংস দমনপীড়ন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের নজর কাড়ে।
বিক্ষোভকারীদের কেউ কেউ অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির প্রতীক ময়ূরের ছবিসংবলিত পতাকা বহন করছিল। কেউবা গেরুয়া পোশাকধারী ভিক্ষুদের সামনে মাথা নুয়ে ছিলেন। একটি ছোট শিশুকে ভিড়ের মধ্য থেকে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের পানির বোতল সংগ্রহ করতেও দেখা যায়।
এ সময় সেনাসদস্যরা ট্রাকের একটি বহর নিয়ে বিক্ষোভকারীদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে করতে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। এরপর নাগাই ক্যামেরাটি নিজের দিকে ঘুরিয়ে ট্রাকগুলোর দিকে ইশারা করেন। তাঁর শেষ কথা ছিল, ‘সেনারা সবেমাত্র এসেছে। সবখানে তারা। তারা ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত।’
সত্য প্রকাশ করুন
ক্যামেরাটি মিয়ানমারের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ডেমোক্রেটিক ভয়েস অব বার্মার সাংবাদিকেরা পেয়েছেন। এর প্রধান সম্পাদক আয়ে চ্যান নাইং বলেছেন, আবারও সামরিক শাসনের অধীনে এখন মিয়ানমার। তাই যে উৎসের সহায়তায় ক্যামেরাটি উদ্ধার হয়েছে, তার সুরক্ষার স্বার্থে কীভাবে সেটি পাওয়া গেছে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত বলেননি তাঁরা।
আয়ে চ্যান বলেন, ‘আমরা একজন ভালো মানুষের কাছ থেকে এটি পেয়েছি, যিনি জানেন কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল।’
সর্বশেষ ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের আগে ডেমোক্রেটিক ভয়েস অব বার্মা (ডিভিবি) ক্যামেরাটি পায়। জাতিসংঘ ও ডিভিবিসহ বেশ কয়েকটি নিরপেক্ষ গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, এই সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত মিয়ানমারে অন্তত ১৭০ জন সাংবাদিক গ্রেপ্তার হয়েছেন। নিষিদ্ধ করা হয়েছে ডিভিবিকে।
গ্রেপ্তার সাংবাদিকদের মধ্যে গত বছর জাপানের সাংবাদিক তোরু কুবোতা সাড়ে তিন মাস কারাভোগ করেছেন। তাঁকে ইয়াঙ্গুনের কাছে সরকারবিরোধী একটি বিক্ষোভের কাছ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
নোরিকো ওগাওয়া বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যেটাকে দুর্ঘটনা বলে দাবি করে আসছে, এর বিরুদ্ধে এ ফুটেজগুলো জাপান কর্তৃপক্ষের কাছে ‘প্রমাণ’ হিসেবে জমা দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মিয়ানমার সরকারের কাছে সত্যটা প্রকাশের দাবি অব্যাহত রাখব...একই সঙ্গে আমি চাই বিশ্ব আবার মিয়ানমারের দিকে মনোনিবেশ করুক।’