থাইল্যান্ডে তারুণ্যের পক্ষে এই জনজোয়ারও কি ভেস্তে দেবে সেনাবাহিনী
থাইল্যান্ডের নির্বাচনে বড় ধাক্কা খেয়েছে দেশটির সেনা–সমর্থিত ক্ষমতাসীন সরকার। জয় হয়েছে তারুণ্যের। নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে তরুণদের সমর্থিত প্রগতিশীল মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি (এমএফপি)। পার্লামেন্টে সবচেয়ে বেশি আসনও তাদের দখলে। এরপরই রয়েছে আরেক বিরোধী দল ফিউ থাই পার্টি।
বেশ কয়েক দশক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে থাইল্যান্ড শাসন করেছেন সেনা–সমর্থিত রক্ষণশীলরা। অভ্যুত্থান করে অনেকবার নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়েছে সেনাবাহিনী। এবারের নির্বাচনে এমএফপি ও ফিউ থাইয়ের সফলতার মধ্য দিয়ে এটা আবারও প্রমাণিত হয়েছে যে সেনা–সমর্থিত শাসকদের ওপর ভরসা নেই মানুষের।
ব্যাংককের চুলালংকর্ন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক থিতিনান পংসুধিরাকের ভাষ্যও এমনটাই। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের মাধ্যমে থাইল্যান্ডের কর্তৃত্ববাদী সামরিক বাহিনীর অতীতকে তিরস্কার করেছেন মানুষ। ওই অতীতকে প্রত্যাখ্যান করেছেন তাঁরা। নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনীতিতে সামরিক আধিপত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছেন থাইল্যান্ডের ভোটাররা।’
গত দুই দশকে যতবারই থাইল্যান্ডের মানুষ ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক বিরোধীদের বিপুল সমর্থন দিয়েছেন। গত রোববারের নির্বাচনেও একই ধারাবাহিকতা দেখা গেছে। তবে এবার সেনাবাহিনীবিরোধীদের জয়ের পরও এটা নিশ্চিত নয়, কে হচ্ছেন থাইল্যান্ডের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।
এর কারণও আছে। ২০১৪ সালে থাইল্যান্ডে সামরিক জান্তা ক্ষমতায় আসার পর দেশটির সংবিধানে সংশোধন আনে। ওই সংশোধনের ফলে যে দলই নির্বাচনে জয় পাক না কেন, কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা ঠিক করার বড় ক্ষমতা থেকে যায় সামরিক বাহিনীর হাতে।
থাইল্যান্ডের পার্লামেন্ট দুই কক্ষবিশিষ্ট। উচ্চকক্ষের নাম সিনেট। আর নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ। সিনেটে ২৫০টি আর প্রতিনিধি পরিষদে ৫০০টি—মোট ৭৫০টি আসন রয়েছে। কোনো দল বা জোটকে সরকার গঠন করতে হলে দুই কক্ষ মিলে অন্তত ৩৭৬টি আসনে জয় পেতে হবে। তবে সমস্যা সিনেটের এই ২৫০টি আসন নিয়ে।
জান্তা সরকারের সময় থাইল্যান্ডের সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী, সিনেটের ২৫০ আসনের সদস্যদের নির্বাচিত করে সামরিক বাহিনী। তাদের সেনাপন্থীদের সমর্থন দেওয়ার ইতিহাস রয়েছে। বলা চলে, ২০১৯ সালের নির্বাচনের কথাই। সেবার সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছিল ফিউ থাই। এরপরও সিনেটের সমর্থন পেয়ে সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন সাবেক সেনাপ্রধান প্রাউত চান-ওচা।
তাই সরকার গঠনের ও প্রধানমন্ত্রিত্ব পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই বিরোধী দলগুলোকে প্রতিনিধি পরিষদে ৩৭৬টি আসনে জয় পেতে হবে। এমএফপি বা ফিউ থাই—কেউ এককভাবে এত আসন পায়নি। এবার এমএফপি পেয়েছে ১৫২টি আসন। আর ফিউ থাই পেয়েছে ১৪১টি। সে ক্ষেত্রে জোট করে সরকার গঠন করতে চাইলে তাদের আরও দলের সমর্থন দরকার হবে।
অন্য বাধাও আছে বিরোধীদের সামনে। এর আগে যেসব দল পরিবর্তন আনতে চেয়েছিল, তারা থাইল্যান্ডের সামরিক বাহিনী, রাজতন্ত্র ও প্রভাবশালী অভিজাত—এককথায় ‘এস্টাবলিশমেন্টের’ রক্ষণশীলতার কাছে ব্যর্থ হয়েছে। আইনপ্রণেতাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দল ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এমনকি সরকার পতনও ঘটানো হয়েছে।
আর থাইল্যান্ডে যে নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও সাংবিধানিক আদালতকে স্বাধীন তকমা দেওয়া হয়েছে, তারাও চলে এই এস্টাবলিশমেন্টের ছড়ির ইশারায়। ফলাফল, ১৯৩২ সাল থেকে ডজনখানেক সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে থাইল্যান্ডে। গত ১৭ বছরেই হয়েছে দুবার।
অপর দিকে প্রগতিশীল দলগুলোর ভরসার জায়গা জনসমর্থন, মানুষের বিপুল ভোট। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী থিতিনান পংসুধিরাকের মতে, নির্বাচনে সেনাপন্থী ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদের পাওয়া আসনে যদি এত ফারাক না থাকত, তাহলে নির্বাচনের ফলে হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকত। কিন্তু নির্বাচনে দুই পক্ষের আসনে বড় ব্যবধান রয়েছে। ফলে এই ফল উল্টে দিতে চাইলে মানুষের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হবে।
২০১৯ সালের নির্বাচনে আসন পাওয়ার দিক দিয়ে তৃতীয় অবস্থানে ছিল ফিউচার ফরোয়ার্ড পার্টি। নির্বাচনের পরপরই দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। পরে দলটি ভেঙে দেওয়া হয়। ফিউচার ফরোয়ার্ড পার্টি ভেঙে দেওয়ার পর ২০২০ সালে থাইল্যান্ডের তরুণদের নেতৃত্বে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। তৈরি হয় নতুন প্রজন্মের একদল নেতা।
ওই নেতাদের অনেকেই পুরোনো একটি বিষয় সামনে আনেন—রাজতন্ত্রের কাঠামোতে সংস্কার। সংস্কার আনার ওই আহ্বান সে সময় থাইল্যান্ডে বড় ঝাঁকুনি দিয়েছিল। কারণ, দেশটির রাজতন্ত্র নিয়ে খোলাখুলি কোনো আলোচনা কারাবাসের কারণ হতে পারে। ওই বিক্ষোভে অংশ নেওয়া অনেককেই সাজা দেওয়া হয়। আর বিক্ষোভকারীদের একাংশ গড়ে তোলে আজকের মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি।
বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন, বর্তমানে মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির ওপর আবার নিষেধাজ্ঞা দেওয়াটা সেনা কর্তৃপক্ষের জন্য সহজ হবে না। আর দলটি শেষ পর্যন্ত সরকার গঠন করলে, নতুন একটি অভ্যুত্থানও কঠিন হবে। এই বিশেষজ্ঞদের একজন গবেষণা প্রতিষ্ঠান দ্য লোয়ি ইনস্টিটিউটের সাউথইস্ট এশিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক সুসানাহ প্যাটন। তবে এমন আশঙ্কা একেবারে উড়িয়েও দেননি তিনি।
সংখ্যাগরিষ্ঠতার হিসাব–নিকাশ
মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির প্রধান পিটা লিমজারোয়েনরাত গত বৃহস্পতিবার বলেছেন, সরকার গঠন করতে আরও সাতটি দল জোট গঠনে রাজি হয়েছে। তিনি এই জোটকে ‘আশাবাদ ও পরিবর্তনের কণ্ঠস্বর’ অভিহিত করেছেন। বলেছেন, তাঁকে থাইল্যান্ডের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সমর্থন জানাতে রাজি হয়েছে দলগুলো।
মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির সঙ্গে জোট গড়তে চাওয়া দলগুলো হলো ফিউ থাই, থাই সাং থাই, প্রাচাচার্ত, সেরি রুয়াম থাই, ফিউ থাই রুয়াম পালাং, এফএআইআর পার্টি ও প্লাং সাংকম মাই পার্টি। জোট গঠনের পর প্রতিনিধি পরিষদে তাঁদের আসনসংখ্যা হবে ৩১৩। জোট নিয়ে আশাবাদ প্রকাশ করে পিটা লিমজারোয়েনরাত বলেছেন, ‘আমরা অবশ্যই সরকার গঠন করতে পারব।’
এদিকে থাইল্যান্ডের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী প্রাউত চান-ওচার দল থাই ন্যাশন পার্টি প্রতিনিধি পরিষদে মাত্র ৩৬ আসন পেয়েছে। সেনাবাহিনী-সমর্থিত আরেকটি দল পালাং প্রাচারাত পেয়েছে ৪০ আসন। মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি ও ফিউ থাইয়ের পর নির্বাচনে তৃতীয় সর্বাধিক ৭০টি আসন পেয়েছে ভুমজাইথাই। সংখ্যাগরিষ্ঠতার হিসাবে এই দলই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাদের ৭০ আসন যেদিকে যাবে, সেই পাল্লাই ভারী হয়ে উঠতে পারে।
তবে পিটা লিমজারোয়েনরাতের জোটে এখন পর্যন্ত যোগ দিতে রাজি হয়নি ভুমজাইথাই। মুভ ফরোয়ার্ড পার্টিও বলেছে, জোটে তারা ভুমজাইথাইকে আমন্ত্রণ জানায়নি। কারণ, সরকার গঠনের জন্য ইতিমধ্যে প্রতিনিধি পরিষদে যথেষ্ট আসন তাদের জোটের রয়েছে।
যা–ই হোক, মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির প্রধান পিটা লিমজারোয়েনরাত বলেছেন, তিনি বিরোধী দলগুলোকে নিয়ে সরকার গঠনের পথে হাঁটবেন। যদি সব ঠিকঠাক থাকে তাহলে তিনিই হতে যাচ্ছেন থাইল্যান্ডের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। এখন দেখার বিষয় সেনাবাহিনী (এস্টাবলিশমেন্ট) কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় কি না। কারণ, এর আগেও জনগণের সমর্থনকে নস্যাৎ করে ক্ষমতা আঁকড়ে রেখেছে তারা।