শ্রীলঙ্কার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়া রনিল বিক্রমাসিংহে গতকাল বৃহস্পতিবার দেশটির অষ্টম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন। গণরোষের মুখে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে পদত্যাগ করার পর গত বুধবার পার্লামেন্ট সদস্যদের ভোটে রনিল প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
তবে বুধবারের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটাভুটি ছিল ব্যতিক্রম। কারণ, শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করার জন্য পার্লামেন্টে ভোটাভুটি হয়। জ্বালানি ও জীবনযাত্রায় ব্যয় কমানোর দাবিতে বিক্ষুব্ধ গণবিক্ষোভের মুখে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে দেশ ছেড়ে পালিয়ে ১৪ জুলাই পদত্যাগে বাধ্য হন। এর আগে প্রায় এ রকম একটি ঘটনা ঘটেছিল ১৯৯৩ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসার মৃত্যুর পর। তবে সেই সময় ডি বি উইজেতুঙ্গা পার্লামেন্টে ভোট ছাড়াই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট পদে রনিল ছাড়াও আরও দুজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। অপর দুজন হলেন এসএলপিপি দলের দুলাস আলহাপেরুমা ও জেভিপি দলের অনূঢ়া কুমারা দিসানায়েকে।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিক্রমাসিংহেকে নির্বাচন সমস্যা সমাধানের চেয়ে তা আরও জটিল করবে বলে মনে হচ্ছে। রনিলকে রাজাপক্ষেদের এজেন্ট এবং তাঁদের মাধ্যমে নিযুক্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবেই মনে করার ধারণা ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে উদ্ধৃত করে গতকাল সিংহলি ভাষার সংবাদপত্রের খবরে বলা হয়েছে, ‘দেশ এখন “ভালো হাতে” রয়েছে এবং তিনি আশাবাদী যে রনিল বিক্রমাসিংহে দ্বীপরাষ্ট্রটিকে অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের করে আনবেন।’
অথচ এই রাজাপক্ষেরা ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বন্ড কেলেঙ্কারি এবং অদক্ষতার জন্য রনিলকে দায়ী করেছিলেন। তাঁকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চরম ব্যর্থ বলেও অভিযুক্ত করেছিলেন রাজাপক্ষেরা। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তাঁর ভাই মাহিন্দার সঙ্গে গোতাবায়ার দূরত্ব তৈরি হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গোতাবায়া মাহিন্দাকে ক্রমেই দূরে সরিয়ে রাখেন বলেও মনে করা হয়।
বিক্ষোভকারীরা রনিলের পদত্যাগের দাবি অব্যাহত রেখেছেন। তাঁরা বলছেন, রনিলের জনগণের সমর্থন নেই। আগের নির্বাচনে তাঁর পরাজয়ের পর তিনি একটি সংসদীয় আসনেও জয় পাননি। জনগণ তাঁকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
পাল্টা যুক্তিতে নিরপেক্ষ বিশ্লেষকেরা অজনপ্রিয় হলেও প্রশ্নটি তুলছেন, যদি তা–ই হয়, তবে গোতাবায়াকে উৎখাত করার কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। কারণ, তিনি ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বড় জয় পেয়েছিলেন। কেউ কেউ আবার শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটকে বৈশ্বিক খাদ্য ও জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত বলে মনে করছেন। যদিও বিক্ষোভকারীরা শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য রাজাপক্ষে পরিবারের দুর্নীতি ও সরকারি তহবিল অপচয়কে দায়ী করছেন।
বিশ্লেষকেরা অবশ্য বলেছেন, বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটে রনিল তাঁর দায় এড়াতে পারেন না। কারণ, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর আমলেই ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বন্ড কেলেঙ্কারি হয়েছিল। ওই কেলেঙ্কারির ঘটনায় শ্রীলঙ্কার ক্ষতি হয়েছে ১০ লাখ মার্কিন ডলারের বেশি। রনিল কর্তৃক নিযুক্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্জুনা মহেন্দ্রান এ কেলেঙ্কারির মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন। তিনি এখনো বিদেশে রয়েছেন। রনিল এবং রাজাপক্ষে উভয় সরকারই এ ঘটনার বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
গতকাল রনিল বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ‘ছদ্মবেশে’ জনগণের বিক্ষোভে জড়িত হওয়া বেআইনি এবং তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে কলম্বো ফোর্ট ম্যাজিস্ট্রেট ইন্টার ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট ফেডারেশনের (আইইউএসএফ) আহ্বায়ক ওয়াসান্থা মুদালিগের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। ২০২১ সালের একটি বিক্ষোভের সঙ্গে জড়িত থাকার মামলায় আদালতে হাজির হতে ব্যর্থ হওয়ায় এ পরোয়ানা জারি করা হয়। ফ্রন্টলাইন সোশ্যালিস্ট পার্টির (এফএসপি) সঙ্গে যুক্ত আইইউএসএফ, যারা কৌশলে বিক্ষোভকারীদের সমর্থন দিচ্ছে।
বিক্ষোভকারীরা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে রনিলের থেকে দেশকে মুক্ত করার কথা জানিয়ে বলেছেন, রাজাপক্ষেদের জায়গায় রনিলের আসা গণতন্ত্রের জন্য লজ্জার। এরই মধ্যে গতকাল রেলের ভাড়া বাড়ানো এবং খাবারের দাম বাড়তে থাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
এদিকে বর্তমান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নন্দলাল বীরাসিংহে বলেছেন, পাঁচ মাসের মধ্যে শ্রীলঙ্কা বর্তমান সংকট থেকে বেরিয়ে আসার আশা করতে পারে। দেশকে মন্দা থেকে বের করে আনতে তিনি কাজ করছেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা জাপান থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলেছেন, আইএমএফ আশা করছে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব’ উদ্ধার আলোচনা শেষ করা হবে।
বিশ্লেষকেরা অবশ্য বলছেন, আইএমএফের বেইল আউট (অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সহায়তা) জনগণের ওপর নেতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলবে। কারণ, তাদের প্রস্তাবিত কঠোর করহার জনগণকেই বহন করতে হবে।