আবের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া আয়োজন নিয়ে সমালোচনার মুখে জাপানের প্রধানমন্ত্রী
জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া রাষ্ট্রীয়ভাবে আয়োজনের পরিকল্পনা করছে দেশটির সরকার। ২৭ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রীয়ভাবে আবের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, আবের প্রতি সহানভূতি দেখিয়ে তাঁর অনুসারীদের সমর্থন লাভ করে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা। আর এ জন্য ১৪০ কোটি ইয়েন খরচ করার কথাও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
জাপানের বিরোধী দলের নেতারা বলছেন, দেশের অর্থনীতির এই কঠিন সময়ে সরকারি অর্থ জনস্বার্থে খরচ করাই অনেক বেশি যুক্তিসংগত হবে। এ ছাড়া দেশের অধিকাংশ নাগরিক রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া আয়োজনের বিপক্ষে।
জুলাই মাসের শুরুতে নারা শহরে এক নির্বাচনী প্রচারে ভাষণ দেওয়ার সময় আততায়ীর গুলিতে নিহত হন ৬৭ বছর বয়সী শিনজো আবে। এর আগে দুই দফায় প্রায় ৯ বছর জাপানের সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর এক বছরের কম সময়ের মধ্যে শারীরিক অসুস্থতার কারণে দায়িত্ব ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরে ২০১২ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হওয়ার পর টানা আট বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। এর মধ্য দিয়ে জাপানের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন থাকা রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করার পরও জাপানের ক্ষমতাসীন উদার গণতন্ত্রী দল-এলডিপির সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা ছিলেন শিনজো আবে। ফলে ক্ষমতার বাইরে থাকার পরও আবেকে দেখা হচ্ছিল অনেকটা ‘কিং মেকার’ হিসেবে। এমনকি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদাও আবের সমর্থন লাভের কারণেই প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছেন। ফলে ক্ষমতাসীন নেতৃত্বের মধ্যে প্রয়াত আবের বন্দনার প্রকাশ দেখিয়ে তাঁর অনুসারীদের সমর্থন লাভ করার মধ্য দিয়ে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করে নেওয়ার বাসনার প্রতিফলন সহজেই লক্ষ করা যায়। আবের জন্য রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া আয়োজনকে জাপানে অনেকেই সেই আলোকে দেখছেন।
জাপানে প্রয়াত কোনো প্রধানমন্ত্রীর জন্য শেষবারের মতো রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন করা হয়েছিল ১৯৬৭ সালে শিগেরু ইয়োশিদার মৃত্যুতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কঠিন একসময়ে জাপানের নেতৃত্বের হাল ধরে দেশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেওয়ায় ইয়োশিদার অবদান অনেকেই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। ফলে তাঁর মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া আয়োজন সেভাবে সমালোচিত হয়নি।
শিনজো আবের জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা নিয়ে সমালোচকেরা বলছেন, ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেননি। ফলে রাষ্ট্রের তহবিল খরচ করে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সে রকম আয়োজন যুক্তিসংগত হতে পারে না। তাঁরা বলছেন, মন্ত্রিসভা ও ক্ষমতাসীন দলের উদ্যোগে এবং এদের তহবিল ব্যবহার করে অন্ত্যেষ্টির আয়োজন করা হবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পথ।
তবে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা ও তাঁর অনুসারীরা বলছেন, কঠিন একসময়ে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদান করে দীর্ঘ সময় ধরে অবদান রেখে গেছেন আবে। তাঁর স্বীকৃতি দিতেই রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন। কিশিদা আরও বলছেন, বিশ্বজুড়ে ৫০টির বেশি দেশের নেতারা আবের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে জাপান ভ্রমণে আসার জন্য প্রস্তুত থাকার কথা জানিয়েছেন। এ জন্য জাপানের সেই আয়োজন হবে কূটনৈতিক পর্যায়ে অন্তরঙ্গ আলোচনা চালানোর দুর্লভ এক সুযোগ। ফলে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে অর্থ বরাদ্দ করে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন করা হলে জাপান এতে উপকৃত হবে।
জাপানের বিরোধী রাজনৈতিক শিবির অবশ্য সে রকম যুক্তি মেনে নিতে নারাজ।
কয়েকটি বিরোধী দলের নেতারা প্রকাশ্যে বলেছেন, জাপানের অর্থনীতির সামনে দেখা দেওয়া কঠিন এই সময়ে সরকারি অর্থ জনস্বার্থে এবং নাগরিকদের কল্যাণে খরচ করা হবে অনেক বেশি যুক্তিসংগত। পাশাপাশি দেশের নাগরিকদের মধ্যেও সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টি আয়োজনের বিপক্ষে।
আগস্ট মাসের ২০ ও ২১ তারিখে জাপানের প্রভাবশালী দৈনিক মায়নিচির চালানো এক জনমত জরিপে দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মাত্র ৩০ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের জন্য আয়োজিত রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া তাঁরা সমর্থন করেন। অন্যদিকে ৫৩ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা এ ধরনের পদক্ষেপের বিরোধী। মূল কারণ হিসেবে অনেকেই অর্থনীতির কঠিন অবস্থার কথা তুলে ধরেছেন। জাপানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকা অবস্থায় সাধারণ নাগরিকদের জীবনযাত্রা এখন অনেক বেশি ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে।
প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার প্রশাসন গত মাসে ঘোষণা করেছিল, আবের রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য খরচ হবে প্রায় ২৫ কোটি ইয়েন। তবে পরে এই হিসাব ক্রমেই আরও বেড়েছে। গত মঙ্গলবার জাপান সরকার বলেছে, এ জন্য অতিরিক্ত ১৪০ কোটি ইয়েনের বরাদ্দ সরকার দেবে। কেন এই ব্যয় বৃদ্ধি, তার ব্যাখ্যা দিয়ে চিফ ক্যাবিনেট সেক্রেটারি হিরোকাযু মাৎসুনো এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ৮০ কোটি ইয়েন নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করে নিতে খরচ করা হবে। অবশিষ্ট ৬০ কোটি ইয়েন প্রয়োজন হবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সম্মানিত অতিথিদের স্বাগত জানানোর সঙ্গে সম্পর্কিত সব ধরনের ব্যবস্থা ঠিক করে নিতে।
এ অবস্থায় জাপান সরকার এখন চাইছে বিরোধী পক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে। সেই লক্ষ্যে আগামী শুক্রবার বিকেলে বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সংসদীয় অধিবেশনের বাইরে এক আলোচনা সভায় মিলিত হবেন প্রধানমন্ত্রী কিশিদাসহ জাপান সরকারের নেতারা। ওই বৈঠকে কোন ফল নিয়ে আসবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে বিভিন্ন পক্ষের বিরোধিতা সত্ত্বেও সরকার নিজস্ব পরিকল্পনা এগিয়ে নিতে দৃঢ় অবস্থান ধরে রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্তত এই যুক্তি দেখিয়ে যে শিনজো আবের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জাপান কীভাবে প্রদর্শন করে, বিশ্ব এখন তা দেখার অপেক্ষায়।