চোখের পলকে ভেঙে পড়ছিল ভবনগুলো, যেন ‘কেয়ামত শুরু হয়েছে’
রাস্তার মাথায় দাঁড়িয়ে আছে পরিপাটি একটি বহুতল ভবন। নিচতলায় কয়েকটি দোকান। ওপরের তলাগুলোয় মানুষের বসবাস। হঠাৎ কী যেন হলো। চোখের পলকে ধসে পড়ল পুরো ভবনটি। নিমেষেই সব শেষ। সাজানো–গোছানো এলাকাটি ইট, পাথর, রড আর ধুলাবালুতে একাকার হয়ে গেল। চারপাশে মানুষের আর্তনাদ–আহাজারি।
চিত্রটি ধরা পড়েছে টুইটারে শেয়ার করা একটি ভিডিওতে। আজ সোমবার তুরস্কের সানলিউফরা শহর থেকে সেটি ধারণ করা হয়েছে। আজকের ভূমিকম্পে তুরস্কের যেসব এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, সেগুলোর একটি সানলিউফরা। ভূমিকম্পে তছনছ হয়েছে পাশের দেশ সিরিয়াও। দুই দেশে ভূমিকম্পে মৃত্যুর সংখ্যা এখন পর্যন্ত সাড়ে তিন হাজার ছাড়িয়েছে। এই সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।
তুরস্ক–সিরিয়া সীমান্ত অঞ্চলে ভূমিকম্পটি যখন আঘাত হানে, ঘড়িতে তখন সময় ভোর ৪টা ১৭ মিনিট, সবাই ঘুমিয়ে। মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৮। এর পর থেকে ছোট ছোট কম্পন অনুভূত হচ্ছিল। তবে ১২ ঘণ্টা পেরোতে না পোরোতেই ৭ দশমিক ৫ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প হয়। তবে প্রথম ভূমিকম্প এতটাই শক্তিশালী ছিল যে তা টের পাওয়া গেছে ইসরায়েল, সাইপ্রাস এমনকি সাড়ে ৫ হাজার কিলোমিটার দূরের গ্রিনল্যান্ডেও।
ভূমিকম্পে মানুষের অসহায় অবস্থা উঠে এসেছে তুরস্কের আরেকটি ভিডিওতে। সেটি কোন এলাকার, তা জানা যায়নি। টুইটারে প্রকাশিত ওই ভিডিওতে দেখা গেছে, ভূমিকম্পের পর আতঙ্কে রাস্তা দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে মানুষ। তাঁদের মধ্যে এক নারী বুকের মধ্যে এক শিশুকে আঁকড়ে ধরে রয়েছেন। হঠাৎ রাস্তার পাশের একটি বহুতল ভবন ধসে পড়ে। ধোঁয়া ও ধুলায় ঢেকে যায় পুরো এলাকা।
বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ও ভিডিওগুলো দেখলেই বোঝা যায়, এই ভূমিকম্প তুরস্ক ও সিরিয়ায় কতটা ক্ষত সৃষ্টি করেছে। দেখা গেছে, উপদ্রুত এলাকাগুলোর সড়কের দুই পাশের ভবনগুলো একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। মনেই হবে না কিছু সময় আগেই সবকিছু সাজানো–গোছানো ছিল। ধসে পড়া ভবনগুলোতে মানুষের আনাগোনা। তাঁদের কেউ কেউ উদ্ধারকারী, কেউ আবার হতাহতদের স্বজন।
উদ্ধারকারীরা একের পর এক লাশ ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে আনছেন। উদ্ধার হওয়া অনেকের শরীরে রয়েছে প্রাণের অস্তিত্ব। তাঁদের হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। আর অন্যরা অপেক্ষা করছেন ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া স্বজনদের জন্য। তাঁদের আশা, হয়তো বেঁচে আছেন পরিবারের মানুষগুলো। তবে শেষ পর্যন্ত আশা ভঙ্গ হচ্ছে অনেকের। পরিবারের সদস্যের লাশ পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা গেছে অনেককে।
ভূমিকম্পের কবল থেকে যাঁরা বেঁচে গেছেন, তাঁরা এখনো আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। এমনই একজন তুরস্কের কাহরামানমারাস শহরের মেলিসা আকতেমুর। বার্তা সংস্থা এএফপিকে তিনি বলেছেন, ‘এমন ভয়াবহ অবস্থায় আগে কখনো পড়িনি। আমরা ভেবেছিলাম কেয়ামত শুরু হয়ে গেছে।’ ভূমিকম্পের সময়কে কেয়ামত বলে মনে হয়েছিল সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশের সারমাদা শহরের বাসিন্দা আনাস হাব্বাসরের কাছেও। তিনি বলেন, ‘সিরিয়ার যুদ্ধের মধ্যেও আমার এমন অনুভূতি হয়নি।’
এদিকে ভূমিকম্পের পর উপদ্রুত এলাকার হাসপাতালগুলোর কর্মীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। আহত ব্যক্তিদের নিয়ে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স আসছে হাসপাতালগুলোতে। সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশে আল–রাহমা হাসপাতালেও দেখা গেছে একই চিত্র। সেখানে এএফপির সঙ্গে কথা হয়েছে ওসামা আবদেল হামিদ নামের এক ব্যক্তির। ভূমিকম্প আঘাত হানার সময় তিনি ঘুমাচ্ছিলেন। টের পেয়ে উঠে দরজা খুললে তাঁর চারতলা বাড়িটি ধসে পড়ে। আটকা পড়েন আবদেল হামিদ।
পরে তাঁকে উদ্ধার করে আল–রাহমা হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালের চিকিৎসক মাজিদ ইব্রাহিম বলেন, পরিস্থিতি খারাপ। সকাল থেকে প্রায় ১৫০ জন আহত ব্যক্তি হাসপাতালে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে শিশুরাও রয়েছে। হাসপাতালে জরুরি সহায়তা প্রয়োজন।
ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঐতিহাসিক বিভিন্ন স্থাপনাও। এর মধ্যে রয়েছে গাজিয়ানতেপ শহরের ২ হাজার ২০০ বছরের প্রাচীন দুর্গও। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল এই শহরের কাছেই। সামাজিক যোগযোগের ম্যাধমে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, বলতে গেলে দুর্গটির পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজিয়ানতেপ দুর্গের আগের একটি ছবির সঙ্গে ভূমিকম্পের পরের একটি ছবি প্রকাশ করেছে বিবিসি। কম্পন যে কতটা ভয়াবহ ছিল, তা এই দুই ছবির মধ্যকার ফারাক দেখলেই বোঝা যায়।
গাজিয়ানতেপের একটি বিমানবন্দরের রানওয়ের আরেকটি ভিডিও প্রকাশ পেয়েছে টুইটারে। সেখানে দেখা গেছে, রানওয়ের মাঝ বরাবর ফাটল ধরেছে।
চলতি শতকে তুরস্কে এমন ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়নি। এর আগে ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে তুরস্কের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। ওই সময় ৩০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিলেন। এ ঘটনার পর ১৯৯৯ সালে ৭ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প ইস্তাম্বুলের দক্ষিণে তুরস্কের মারামারা অঞ্চলে আঘাত হানে। এতে সাড়ে ১৭ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন।
তথ্যসূত্র: এএফপি, বিবিসি, রয়টার্স