চীনে বড় ডিগ্রিধারী ছেলে–মেয়েরা জীবিকার জন্য গাড়ি চালাচ্ছেন, ওয়েটারের কাজ করছেন

বেইজিংয়ে চাকরির মেলাফাইল ছবি: রয়টার্স

চীন এখন এমন একটি দেশ, যেখানে উচ্চবিদ্যালয়ের একজন খুচরা কর্মীর পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে, একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর রয়েছে পরিবেশ পরিকল্পনার যোগ্যতা, একজন পণ্য ডেলিভারি-কর্মী দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং নামকরা সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা একজন তরুণ অবশেষে সহকারী পুলিশ কর্মকর্তার চাকরির জন্য দরখাস্ত করতে বাধ্য হচ্ছেন।

তাঁরা একটি ধুঁকতে থাকা অর্থনীতিতে দেখা পাওয়া সত্য চরিত্র। সেখানে তাঁদের মতো আরও অনেককে খুঁজে পাওয়া মোটেই কঠিন নয়।

‘আমার স্বপ্নের চাকরি ছিল বিনিয়োগ ব্যাংকিংয়ে কাজ করা,’ বলেন সান ঝাঁ। চীনের দক্ষিণাঞ্চলের নানজিং শহরে একটি রেস্তোরাঁয় ওয়েটারের চাকরি করছেন তিনি, তাঁর কাজের পালায় যোগ দিতে তৈরি হচ্ছিলেন তখন।

২৫ বছর বয়সী সান ঝাঁ সম্প্রতি ফিন্যান্সে স্নাতকোত্তর পাস করেছেন। তিনি আশা করেছিলেন, বেশি বেতনের চাকরি করে ‘অনেক টাকা আয়’ করবেন। কিন্তু বললেন, ‘সেই ধরনের চাকরি খুঁজেছিলাম, তেমন ভালো কিছু পাইনি।’

চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক পাস করে বের হচ্ছেন। কিন্তু কিছু কিছু খাতে তাঁদের জন্য পর্যাপ্ত চাকরি নেই।

অর্থনীতিটি নাকানিচুবানি খাচ্ছে। দেশটির আবাসন ও অবকাঠামোসহ বড় কিছু খাত থমকে আছে।

২০২৪ সালের আগস্টে চীনে যুবক বয়সীদের মধ্যে বেকারত্ব ছিল ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ। নভেম্বর মাসে তা কমে ১৬ দশমিক ১ শতাংশে নেমে আসে।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ছেলে–মেয়েদের অনেকে নিজেদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে কাজ খুঁজে না পেয়ে এমন সব চাকরি করছেন, যা তাঁদের যোগ্যতার অনেক নিচে। এ নিয়ে আত্মীয়-বন্ধুদের গঞ্জনা-লাঞ্ছনাও সইতে হচ্ছে তাঁদের।

সান ঝাঁ ওয়েটারের চাকরি নিলে তাঁর মা-বাবা অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন।

তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারের মতামত আমার জন্য বড় উদ্বেগের বিষয়। আমি অনেক বছর পড়াশোনা করেছি, বেশ ভালো একটি স্কুলেও গিয়েছি।’

তিনি বলেন, এমন চাকরি বেছে নেওয়ায় তাঁর পরিবার বিব্রত হয়েছিল এবং তিনি একজন সরকারি কর্মচারী বা কর্মকর্তা হতে চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু তিনি এ-ও বললেন যে যা হয়েছেন, তা নিজের পছন্দেই হয়েছে।

তারপরও তাঁর এখনো একটি গোপন পরিকল্পনা আছে। ওয়েটার হিসেবে যে সময়টা তিনি পার করছেন, সেটাকে রেস্তোরাঁর কাজ শেখার সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে চান, যাতে করে একসময় তিনি নিজেই একটা রেস্তোরাঁ খুলতে পারেন।

তিনি মনে করেন, একটা সফল ব্যবসা দাঁড় করাতে পারলে তাঁর সমালোচক স্বজনদের সুর বদলে যাবে।

হংকং সিটি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ঝাং জুন বলেন, ‘চীনের মূল ভূখণ্ডে চাকরির অবস্থা আসলেই এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। তাই আমি মনে করি, যুবক বয়সী অনেকে এখন নিজেদের প্রত্যাশাকে ব্যাপকভাবে খাপ খাইয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এই কারণে আমি মনে করি, অনেক যুবককে নিজের প্রত্যাশার সঙ্গে আপস করতে হচ্ছে।’

তিনি বলেন, অনেক শিক্ষার্থী ভালো সুযোগের আশায় উচ্চতর ডিগ্রি নিচ্ছেন। কিন্তু তারপর তাঁরা চাকরি-পরিস্থিতির বাস্তবতা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। কর্মসংস্থান পরিবেশের বাস্তবতা তাঁদের হতাশ করে।

‘চাকরির বাজার আসলেই কঠিন হয়ে গেছে,’ বলেন ২৯ বছর বয়সী উ ড্যান। তিনি এখন সাংহাইয়ে আহত খেলোয়াড়দের জন্য পরিচালিত একটি মাসাজ ক্লিনিকে প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘চাকরির বাজার আসলেই বেশ কঠিন। স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে আমার যাঁরা সহপাঠী ছিলেন, তাঁদের অনেকেই এই প্রথম চাকরি খুঁজছেন। হাতে গোনা কয়েকজন তা পেয়েছেন।’

হংকং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিন্যান্সের ডিগ্রিধারী উ ড্যানও ভাবেননি যে তাঁকে একটি মাসাজ ক্লিনিকে কাজ নিতে হবে। এই পেশায় তাঁর চাকরি করার ইচ্ছা নেই। এর আগে তিনি সাংহাইয়ের একটি বাণিজ্যিক কোম্পানিতে চাকরি করে কৃষিপণ্য বিষয়ে অভিজ্ঞ হয়ে উঠছিলেন।

হংকংয়ে পড়াশোনা শেষে চীনের মূল ভূখণ্ডে ফিরে আসার পর তিনি কোনো বেসরকারি বিনিয়োগ (ইক্যুইটি) ফার্মে কাজ করতে চেয়েছিলেন। কিছু কিছু ফার্ম থেকে ডাকও পেয়েছিলেন। কিন্তু চাকরির শর্ত নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি।

এসব চাকরির কোনোটিতে যোগ না দিয়ে তিনি ক্রীড়া-চিকিৎসায় (স্পোর্টস মেডিসিন) প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেন। কিন্তু তাঁর এ সিদ্ধান্তকে পরিবার ভালো চোখে দেখেনি।

চীনের চংকিং ইউনিভার্সিটি অব পোস্টস অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনসের স্নাতক প্রথম বর্ষের পরিচিতিমূলক অনুষ্ঠানে। ২২ জুন ২০২২
ফাইল ছবি: রয়টার্স

‘তাঁরা ভেবেছিলেন, আমি আগে এত ভালো একটা চাকরি করেছি এবং আমার শিক্ষাগত যোগ্যতার বেশ ভালো বাজার আছে। তাঁরা (পরিবারের সদস্যরা) মনে করেছিলেন আমার সামনে ভালো চাকরির সুযোগ আছে এবং আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা বেশ প্রতিযোগিতামূলক। কিন্তু আমি যে কেন কম যোগ্যতার একটা চাকরি বেছে নিয়েছি, কম বেতনে গায়ে-গতরে খাটুনির কাজ করছি, তা তাঁরা বোঝেননি।’

তিনি এ কথা স্বীকার করেন যে বর্তমানে তিনি যে বেতন পান, তা দিয়ে সাংহাইয়ে টিকে থাকতে পারতেন না। কিন্তু তাঁর জীবনসঙ্গী তাঁদের বাসাটির মালিক হওয়ায় বাড়িভাড়া দিতে হচ্ছে না, একরকম করে চলে যাচ্ছে।

গোড়ায় দিকে কেউ তাঁর বর্তমান পেশার পক্ষে ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি তিনি চিকিৎসা করে তাঁর মায়ের পিঠের ব্যথা অনেকটা সারিয়ে তুলেছেন। চিকিৎসায় তাঁর ব্যথা অনেকটা কমেছে। এর পর থেকে মায়ের মত বদলাতে শুরু করেছে।

ফিন্যান্সের সাবেক এই শিক্ষার্থী বলেন, এখন তাঁর মনে হয় বিনিয়োগের দুনিয়াটা আসলে তাঁর জন্য জুতসই নয়।

উ ড্যান বলেন, তিনি খেলোয়াড়দের আঘাত নিয়ে কাজ করতে আগ্রহ পাচ্ছেন। তিনি এই কাজ পছন্দ করেন। একদিন তিনি নিজেই একটি ক্লিনিক দিতে চান।

অধ্যাপক ঝাং জুন বলছেন, চীনের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়া ছেলেমেয়েরা ‘ভালো চাকরি বা পদ’ বিষয়ে তাঁদের ধারণা পাল্টাতে বাধ্য হচ্ছেন।

তিনি আরও বলেন, প্রযুক্তি কোম্পানিসহ চীনের অনেক কোম্পানি বিপুল কর্মীকে অব্যাহতি দিয়েছে (লে অফ)। যুবক বয়সীদের জন্য এটাকে অশনিসংকেত হিসেবে গণ্য করা যায়।

হংকং সিটি ইউনিভার্সিটির এই নারী অধ্যাপক বলেন, অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে এখন চাকরির শর্তাবলি খারাপ হচ্ছে। একসময় এই খাতগুলো ছিল স্নাতক ডিগ্রিধারীদের বড় চাকরিদাতা। এখন এসব খাতে শোভন সুযোগ-সুবিধা চিরতরে উধাও হয়ে যাচ্ছে।