২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

সংকটে জর্জর শ্রীলঙ্কায় মুঠোফোনের আলোয় অস্ত্রোপচার

শ্রীলঙ্কার ক্ষুব্ধ মানুষ রাজপথে নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে
ছবি: রয়টার্স

মিরুর বয়স তিন বছর। খেলনা গাড়ি নিয়ে খেলায় মগ্ন সে। পাশে তার মা–বাবা। এই পরিবারকে এভাবে ক্ষণিক সময়ের জন্য দেখে বোঝার উপায় নেই, তারা কী ভয়াবহ সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।

মিরু ম্যালিগন্যান্ট ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত। এই রোগের কারণে শিশুটির ঘন ঘন খিঁচুনি হয়। কয়েক মিনিটের জন্য সে অজ্ঞান হয়ে যায়। মিরুর যে ওষুধ খুব প্রয়োজন, শ্রীলঙ্কায় এর ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে।

মিরুর বাবা উপুল চন্দনা। একমাত্র ছেলের চিকিৎসার জন্য অপরিহার্য ওষুধটির ঘাটতি থাকায় তা খুঁজে পেতে উপুলকে প্রতিনিয়ত হয়রান হতে হয়।

উপুল বলেন, ‘ওষুধটি আর হাসপাতালে পাওয়া যায় না। এমনকি আশপাশের ফার্মেসিগুলোতেও ওষুধটির স্টক ফুরিয়ে গেছে। এখন অর্থ দিয়েও ওষুধটি পাওয়া যাচ্ছে না।’

উপুলের মতো একই ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি শ্রীলঙ্কার বহু মানুষ। কারণ, শ্রীলঙ্কায় চলমান অর্থনৈতিক দুরবস্থা দেশটির স্বাস্থ্য-চিকিৎসাব্যবস্থাকে বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে।

গতকাল রোববার মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন অনলাইনের এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থনৈতিক বিপর্যয় শ্রীলঙ্কাকে গ্রাস করছে। এই বিপর্যয়ের জেরে দেশটিতে খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানি, বিদ্যুৎ প্রভৃতির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

শ্রীলঙ্কায় ওষুধ ও চিকিৎসাসরঞ্জামে টান পড়েছে
ছবি: রয়টার্স

শ্রীলঙ্কার ক্ষুব্ধ মানুষ রাজপথে নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। তারা দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের পদত্যাগ দাবি করছে। তবে গোতাবায়া রাজাপক্ষে পদত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছেন।

শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটকে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বাজে সংকট হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে।

বিপুল বিদেশি ঋণ পরিশোধ ও ব্যাপক বাণিজ্য ঘাটতির কারণে শ্রীলঙ্কার অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দেশটি এখন মৌলিক পণ্যসহ ওষুধ-চিকিৎসাসামগ্রী আমদানি করতে পর্যন্ত পারছে না। এ কারণে দেশটিতে ওষুধ ও চিকিৎসাসরঞ্জামে টান পড়েছে। এ প্রেক্ষাপটে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতিকে ‘অভূতপূর্ব মানবিক সংকট’ হিসেবে বর্ণনা করেছে সিঙ্গাপুরের রেডক্রস।

সংকটের মুখে শ্রীলঙ্কার চিকিৎসকেরা বিভিন্ন চিকিৎসার সরঞ্জাম ধুয়ে বারবার ব্যবহার করতে বাধ্য হওয়ার কথা জানাচ্ছেন। এমনকি মুঠোফোনের আলোয় তাঁরা অস্ত্রোপচার করছেন।

ওষুধের ঘাটতির কারণে শ্রীলঙ্কায় কারও মৃত্যুর তথ্য এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করেনি দেশটির কর্তৃপক্ষ। তবে দেশটির বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, চলমান সংকটের কারণে শ্রীলঙ্কায় মানুষের মৃত্যুসংখ্যা করোনার প্রাণহানিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। এখন পর্যন্ত দেশটিতে করোনায় ১৬ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

শ্রীলঙ্কার ক্ষুব্ধ মানুষ দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের পদত্যাগ দাবি করছে
ছবি: রয়টার্স

শ্রীলঙ্কার স্টেট ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি অথুলা অমরাসেনা বলেন, ‘এটা একটা সংকট। এই সংকট কতটা খারাপ হতে চলছে, তা আমরা অনুমান করতে পারি না।’

শ্রীলঙ্কার ফার্মাসিউটিক্যালগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে এই অ্যাসোসিয়েশন। অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি আরও বলেন, ‘তবে আমরা সতর্ক রয়েছি যে আমরা আরও সংকটের দিকে অগ্রসর হচ্ছি।’

ভয়াবহ পরিস্থিতি ওয়াসান্থা সেনেভিরত্নে প্রতিদিন শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোয় এক ফার্মেসি থেকে আরেক ফার্মেসিতে ছুটে বেড়ান। তিনি মরিয়া হয়ে একটি বিশেষ ওষুধের খোঁজ করেন। ওষুধটি কেমোথেরাপির। তাঁর সাত বছর বয়সী মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ওষুধটি খুঁজে পাওয়া ওয়াসান্থার জন্য খুবই জরুরি।

ওয়াসান্থার মেয়েকে ৭ এপ্রিল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই হাসপাতালসহ যেসব ফার্মেসিতে তিনি মেয়ের জন্য ওষুধ কিনতে যান, সব জায়গাতেই তাঁকে একই কথা শুনতে হয়। ওষুধটি শ্রীলঙ্কার কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।

ওয়াসান্থা বলেন, ‘কোনো সরকারি হাসপাতাল, ফার্মেসি, এমনকি আমদানিকারকের কাছেও ওষুধটি নেই। ওষুধটি শ্রীলঙ্কার কোথাও নেই।’

ওয়াসান্থা জানান, তাঁর মেয়ের নিউরোব্লাস্টোমা হয়েছে। এটি ক্যানসারের একটি ধরন। এর চিকিৎসার জন্যই তাঁর মেয়ের বিশেষ ওষুধটির দরকার হয়।

অসহায় বাবা ওয়াসান্থা বলেন, ‘এখন আমার কী করা উচিত? ওষুধটি না পেলে আমার সন্তান হয়তো বেশি দিন বাঁচবে না।’

শ্রীলঙ্কায় খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানি, বিদ্যুৎ প্রভৃতির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে
ছবি: রয়টার্স

ওয়াসান্থা জানান, মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেও শ্রীলঙ্কার হাসপাতালগুলোয় বিনা মূল্যে তাঁর মেয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধটি দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু এখন রোগীদের পরিবারকে নিজ দায়িত্বে প্রাইভেট ফার্মেসি থেকে এই ওষুধ আনতে বলা হচ্ছে।

ওয়াসান্থার বিবরণে শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্য-চিকিৎসাব্যবস্থার যে সংকটের কথা এসেছে, বাস্তব পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। শ্রীলঙ্কা মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (এসএলএমএ) প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক চিঠিতে পরিস্থিতির ভয়াবহতার স্বরূপ উঠে আসে।

এসএলএমএর চিঠিতে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কাজুড়ে সব হাসপাতালে জরুরি ওষুধ ও চিকিৎসাসরঞ্জামের সংকট রয়েছে। চেতনানাশকসহ প্রয়োজনীয় উপকরণের স্বল্পতার কারণে দেশটির বেশ কয়েকটি সরকারি হাসপাতালকে রুটিন সার্জারি স্থগিতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই কারণে পরীক্ষাগারে পরীক্ষা কমাতে বলা হয়েছে।

শ্রীলঙ্কার পেরিনেটাল সোসাইটির সভাপতি সম্প্রতি দেশটির হাসপাতালগুলোকে নবজাতকদের ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহে ব্যবহৃত এন্ডোট্র্যাকিয়াল টিউব জীবাণুমুক্ত করে তা পুনরায় ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছেন। কারণ, দেশটিতে এই টিউবের বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে।

চাকরি হারানোর ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শ্রীলঙ্কার একজন সার্জন বলেন, স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসায় ব্যবহৃত অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের এখন গুরুতর সংকট রয়েছে। সংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তিনি যে হাসপাতালে কর্মরত, সেখানে ক্যাথেটার পর্যন্ত পুনরায় ব্যবহার করতে বাধ্য করা হচ্ছে।

ওই সার্জন চলতি সপ্তাহে সিএনএনকে বলেন, ‘জানি, আমি রোগীর জীবন বিপন্ন করছি। আমি নিরাশ, পুরোপুরি অসহায় বোধ করছি।’

এই সার্জন জানান, তিনি এখন তাঁর বেশির ভাগ সময় চিকিৎসাসরঞ্জাম পুনরায় ব্যবহারের জন্য জীবাণুমুক্তকরণের কাজে ব্যয় করেন। এই কাজ ঠিক নয়।

শ্রীলঙ্কার এই চিকিৎসক সিএনএনকে বলেন, তিনি ও তাঁর অন্য সহকর্মীরা একদিন একটি শিশুর অস্ত্রোপচার করছিলেন। হৃদ্‌রোগ–সংশ্লিষ্ট এই অস্ত্রোপচার চলাকালে বিদ্যুৎ চলে যায়। কিন্তু তখন অস্ত্রোপচারে বিরতি দেওয়ার উপায় ছিল না। এ অবস্থায় হাসপাতালের জেনারেটর চালু হওয়ার আগপর্যন্ত অস্ত্রোপচারের কক্ষে থাকা অন্য চিকিৎসাকর্মীরা মুঠোফোনের টর্চ জ্বেলে হাতে ধরে রাখেন। এই টর্চ ব্যবহার করেই তাঁরা অস্ত্রোপচারের কাজটি চালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। মুঠোফোনের টর্চের আলোয় অস্ত্রোপচারের কাজ করা সহজ নয়। সিএনএন অনলাইন অবলম্বনে