পৃথিবী নামে আমাদের বাসযোগ্য এ গ্রহের আবহাওয়া ও জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষায় চিরহরিৎ বনাঞ্চল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে বিপুল পরিমাণে কার্বন ডাই–অক্সাইড গ্রহণ করে এ বনাঞ্চল অক্সিজেন দেয়। এমন বনাঞ্চলের অন্যতম আমাজন। অনেক অনন্য প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল এ চিরহরিৎ বনাঞ্চল। বিশ্বের অর্ধেকের বেশি উদ্ভিদ ও প্রাণী চিরহরিৎ বনাঞ্চলে পাওয়া যায়। এসব বনাঞ্চলকে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ বলেও ডাকা হয়ে থাকে। বিবিসি সায়েন্স ফোকাস ম্যাগাজিনে ২০২৪ সালের জন্য বিশ্বের শীর্ষ ১০টি বড় চিরহরিৎ বনের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। পাঠকের জন্য এসব বনের নানা তথ্য তুলে ধরা হলো—
‘পৃথিবীর ফুসফুস’ আমাজন বিশ্বের বৃহত্তম চিরহরিৎ বনাঞ্চল। এর আয়তন ৬৭ লাখ বর্গকিলোমিটার। এটি আটটি দেশে বিস্তৃত। পৃথিবীর জলবায়ুর জন্য এ বনাঞ্চল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর জানা-অজানা উদ্ভিদ ও প্রাণীর এক-দশমাংশ এখানে পাওয়া যায়। এর মধ্যে এমন উদ্ভিদ ও প্রাণী আছে, যা আমাজন ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না। গত ৪০ বছরে কৃষিজমির সম্প্রসারণের জন্য বন উজাড় করায় আমাজনের আকার ১৭ শতাংশ কমেছে। এখানে যে পরিমাণ কার্বন মজুত আছে, বন উজাড়ের ফলে তা বায়ুমণ্ডলের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
কঙ্গো বেসিন বনাঞ্চল এত বড় যে এটি ‘আফ্রিকার ফুসফুস’ নামে পরিচিত। এটি আফ্রিকা মহাদেশের ৯টি দেশের মধ্যে বিভক্ত। এর আয়তন ১৬ লাখ বর্গকিলোমিটার। এ অঞ্চলে বর্ষাকাল দুটি। এই বৃষ্টি অঞ্চলটির বাস্তুসংস্থান ঠিক রাখতে সহায়তা করে। বিস্তৃত এ বনাঞ্চল তার মাটিতে কার্বন অপসারণ ও সংরক্ষণ করার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ধারণা করা হয়, কঙ্গো বেসিন বিশ্বের বনভিত্তিক কার্বনের প্রায় ৮ শতাংশ ধারণ করে। এখানে শিম্পাঞ্জি, চিতাবাঘ ও পশ্চিমাঞ্চলীয় নিম্নভূমির গরিলাসহ বিভিন্ন প্রজাতির বৈচিত্র্যময় প্রাণীর বসবাস। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় এ বনাঞ্চলে। গাছ কেটে ফেলার কারণে এ বনাঞ্চলও হুমকির মুখে আছে।
নিউগিনি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ দ্বীপ। এ দ্বীপের ৬৫ শতাংশজুড়ে রয়েছে চিরহরিৎ বনাঞ্চল। এ বনাঞ্চলের আয়তন ৭ লাখ ৮৬ হাজার বর্গকিলোমিটার। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৈরী আবহাওয়া দেখা যায় এ অঞ্চলে। এখানে একদিকে যেমন ভারী বৃষ্টি হয়, অন্যদিকে তুষার পড়ে, আবার তীব্র তাপপ্রবাহ দেখা দেয়। এখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের বৈচিত্র্য চমকপ্রদ। লম্বা ঠোঁটের ইচিডনা, গেছো ক্যাঙ্গারু ও উড়ন্ত শিয়ালের মতো প্রাণীদের বসবাস এখানে। বিশ্বের বৃহত্তম প্রজাপতি কুইন আলেকজান্দ্রা বার্ডউইংও এখানে পাওয়া যায়।
বোর্নিও বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দ্বীপ। এটির অর্ধেকের বেশি এলাকাজুড়ে রয়েছে চিরহরিৎ বন। তিনটি দেশের মধ্যে বিভক্ত (ব্রুনেই, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া) এই বনাঞ্চল বিশ্বের বৃহৎ চিরহরিৎ বনগুলোর একটি। আয়তন ৪ লাখ ২৮ হাজার ৪৩৮ বর্গকিলোমিটার। এখানকার জলবায়ু গ্রীষ্মমণ্ডলীয়। সারা বছর তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করে। বোর্নিও নিম্নভূমি বনাঞ্চলে ১০ হাজার প্রজাতির গাছপালা রয়েছে, এর মধ্যে ২ হাজারই অর্কিড শ্রেণির। নানা জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এ বনাঞ্চল। তবে ক্রমাগত বন উজাড় ও বড় এলাকা কৃষিজমিতে রূপান্তরিত করার কারণে এ বনাঞ্চল হুমকির মুখে আছে।
ভলদিভীয় নাতিশীতোষ্ণ বনাঞ্চল প্রশান্ত মহাসাগর ও আন্দিজ পর্বতমালার মধ্যে এবং নিরক্ষরেখা থেকে ৪০ ডিগ্রি দক্ষিণে লাতিন আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত। আয়তন ২ লাখ ৪৮ হাজার ১০০ বর্গকিলোমিটার। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এ বনের উত্তর ও দক্ষিণে বৃষ্টির পার্থক্য ব্যাপক। দক্ষিণাঞ্চলে বছরে গড়ে ছয় হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হলেও উত্তরে হয় মাত্র এক হাজার মিলিমিটার। দক্ষিণ আমেরিকার একমাত্র নাতিশীতোষ্ণ চিরহরিৎ বন এটি। এ অঞ্চলে স্থানীয় প্রজাতির কিছু পশুপাখি রয়েছে। বৃক্ষনিধনের কারণে বনাঞ্চলটি ঝুঁকিতে আছে।
নিউ সাউথ ওয়েলসের পূর্ব উপকূল থেকে দক্ষিণ কুইন্সল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত পূর্ব অস্ট্রেলীয় নাতিশীতোষ্ণ বনাঞ্চল। আয়তন ২ লাখ ২২ হাজার ১০০ বর্গকিলোমিটার। এটি মূলত উন্মুক্ত ঘন ইউক্যালিপটাস বন, গুল্মভূমি ও ঘন উপক্রান্তীয় চিরহরিৎ বন নিয়ে গঠিত। এখানকার আবহাওয়া অপেক্ষাকৃত আর্দ্র। বার্ষিক বৃষ্টির প্রায় অর্ধেক হয় এ বনাঞ্চলে। পূর্ব অস্ট্রেলীয় নাতিশীতোষ্ণ বনে কোয়ালাস, মখমল কীট, কুকাবুরাস ও সুইফট তোতাপাখির মতো প্রাণীদের বসবাস।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় নাতিশীতোষ্ণ চিরহরিৎ বন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে আলাস্কা হয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত। আয়তন ৬০ হাজার ৩৪৬ বর্গকিলোমিটার। এ বনাঞ্চল বিপুল প্রজাতির গাছের আবাসস্থল। এর মধ্যে আছে কোস্ট রেডউড ও কোস্ট ডগলাস-ফারের মতো বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু গাছ। এখানে রাকুন, কোয়োটস (নেকড়ের একটি প্রজাতি), বুলফ্রগ (ব্যাঙের একটি প্রজাতি), লাল শিয়াল, অপসামসহ অনেক সাধারণ প্রজাতির প্রাণীও পাওয়া যায়। এ বনাঞ্চল দাবানলের ঝুঁকিতে নেই। তবে বাতাস বা তুষারপাতে এটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। আইনি সুরক্ষার অভাবে এটি অবৈধভাবে কাঠ কাটার হুমকিতে পড়েছে। ফলে গত শতাব্দীতে এ বনের বিশাল এলাকা উজাড় হয়ে গেছে।
সুমাত্রার ক্রান্তীয় রেইনফরেস্ট হেরিটেজ (টিআরএইচএস) ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে তিনটি জাতীয় উদ্যান নিয়ে গঠিত। আয়তন ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটার। এ বনে আনুমানিক ১০ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ এবং ৫০০ প্রজাতির পাখিসহ বিপুল জীববৈচিত্র্য রয়েছে। স্থানীয় প্রজাতির পশু হিসেবে সুমাত্রা ওরাংওটান ও সুমাত্রা বাঘও পাওয়া যায় এ বনে। এটি ইন্দোনেশিয়ার বৃহত্তম আগ্নেয়গিরি গুনুং কেরিনসিও অঞ্চলে অবস্থিত। অবৈধভাবে কাঠ কাটা, রাস্তা নির্মাণ ও বনের জমি দখল করে কৃষিকাজ করায় এ বনের ভবিষ্যৎও হুমকির মুখে আছে।
নিকারাগুয়ার মোট স্থলভাগের প্রায় ১৫ শতাংশজুড়ে বোসাওয়াস বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ বনাঞ্চল। এটি পশ্চিম গোলার্ধের দ্বিতীয় বড় চিরহরিৎ বন। আয়তন ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার। নানা জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থল এটি। বিশ্বের প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতির ১৩ শতাংশের বেশি এখানে বসবাস করে। হার্পি ঈগল, সাসলায়া মস সালামান্ডার এবং জাগুয়ার ও পুমাসের মতো বড় বিড়ালও এ রিজার্ভে পাওয়া যায়। স্থানীয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর লোকজন এ বনাঞ্চল সংরক্ষণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। তাই এ বনের অবস্থা বেশ ভালো বলেই ধরা হয়।
ওয়েস্টল্যান্ড নাতিশীতোষ্ণ বন নিউজিল্যান্ডের সাউথ আইল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত। আয়তন ১১ হাজার ৮৮০ বর্গকিলোমিটার। দক্ষিণ আল্পস পর্বতমালা ও তাসমান সাগরের সীমানায় অবস্থিত হওয়ায় এ বনে প্রতিবছর প্রায় তিন হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। বনাঞ্চলটি কেয়া ও কাকা (তোতাপাখির দুটি প্রজাতি) এবং ওকারিটো ব্রাউন কিউইয়ের মতো অনেক বিপন্ন প্রজাতির পাখির আবাসস্থল। এখানকার প্রায় অর্ধেক জমি সুরক্ষিত। তবে জলবায়ুর পরিবর্তন এ বনাঞ্চলের ভবিষ্যতের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। খরার কারণে দাবানলের ঝুঁকি অব্যাহতভাবে বাড়ছে এখানে।