ভারতীয় গুপ্ত পরিবার যে কারণে দক্ষিণ আফ্রিকায় নিন্দনীয়
ভারতীয় একটি পরিবার। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকায় রয়েছে তাদের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য।
কম্পিউটারের যন্ত্রপাতির ব্যবসা দিয়ে শুরু। তারপর বিদ্যুৎ, জ্বালানি, রেলওয়ে, খনিজ, আকাশ সেবা, আবাসন, সংবাদমাধ্যম, প্রযুক্তিসহ নানা খাতে ডালপালা মেলেছে পরিবারটির ব্যবসা।
অভিবাসী হিসেবে গিয়ে তিন দশকের কম সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম শীর্ষ ধনীর স্বীকৃতি পান পরিবারটির সদস্যরা। তবে এই নাটকীয় উত্থান-যাত্রায় তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠে দুর্নীতি, রাজনীতিতে অবৈধ প্রভাব বিস্তারের গুরুতর অভিযোগ। শুরু হয় নিন্দা-সমালোচনা। হাওয়া বদলে গেলে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে পালান পরিবারটির সদস্যরা।
সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতে পরিবারটির দুই সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ ঘটনায় দক্ষিণ আফ্রিকানরা যারপরনাই খুশি।
বলছি গুপ্ত পরিবারের কথা। একসময়ে দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনীতি-অর্থনীতিতে প্রভাবশালী এই পরিবার এখন দেশটির মানুষের কাছে চরম নিন্দনীয়।
দক্ষিণ আফ্রিকায় গুপ্ত পরিবারের নাটকীয় উত্থান-পতনের ইতিহাস জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে তিন দশক আগে।
সময়টা ১৯৯৩ সাল। বর্ণবাদের কালো ছায়া থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার সদ্যই নবযাত্রা হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর থেকে তিন ভাই অজয় গুপ্ত, অতুল গুপ্ত ও রাজেশ গুপ্ত (টনি গুপ্ত) দক্ষিণ আফ্রিকায় পা রাখেন। তাঁদের বাবা শিবকুমার গুপ্ত ভেবেছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকা ভবিষ্যতে আমেরিকার মতো উন্নত দেশ হবে। তাই ভাগ্য ফেরাতে তিন ছেলেকে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠিয়ে দেন।
জুমার আশীর্বাদে ফুলেফেঁপে উঠেছে গুপ্ত পরিবারের সাম্রাজ্য। এ কারণে দুই পরিবারকে এক করে ‘জুপ্তাস’ শব্দটি দক্ষিণ আফ্রিকাবাসীর কাছে জনপ্রিয়তা পায়।
অভিবাসী হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে গুপ্ত ভাইয়েরা সাহারা কম্পিউটারস নামের একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁরা কম্পিউটারের যন্ত্রপাতির ব্যবসা শুরু করেন। এরপর তাঁরা দ্রুত ব্যবসা সম্প্রসারণে মনোযোগ দেন।
কয়েক বছরের মধ্যে গুপ্ত ভাইয়েরা খনি ও গণমাধ্যম ব্যবসায় সুনাম কুড়ান। তারপর আর তাঁদের পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে জ্বালানি, আকাশ সেবা, প্রযুক্তি, রেলওয়ে প্রভৃতি খাতে গুপ্ত পরিবারের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যবসা খাতে গুপ্ত পরিবারের বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে।
গুপ্ত পরিবারের সম্পদ
গুপ্ত পরিবারের সদস্যদের সম্মিলিত সম্পদ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য খুব একটা পাওয়া যায় না। তবে আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে বড় স্টক এক্সচেঞ্জ জোহানেসবার্গের জেএসই ২০১৬ সালে জানায়, অতুল গুপ্ত দক্ষিণ আফ্রিকার সপ্তম শীর্ষ ধনী। তাঁর একার সম্পদের পরিমাণ ৭৭ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি। অন্য ভাইদের ব্যক্তিগত সম্পদের সুনির্দিষ্ট ও প্রকাশ্য তথ্য নেই।
জোহানেসবার্গে ‘সাহারা এস্টেট’ নামের গুপ্ত ভাইদের অভিজাত ম্যানশন রয়েছে। সেখানে অন্তত চারটি প্রাসাদসম বাড়িতে এ পরিবারের সদস্যরা বসবাস করতেন। একেকটি বাড়ির মূল্য ৩৪ লাখ ডলারের বেশি।
যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের ছেলে মার্ক থ্যাচারের কেপটাউনে একটি বাড়ি ছিল। এই বাড়ি গুপ্ত ভাইয়েরা কিনে নেন।
গুপ্ত ভাইদের সংগ্রহে রয়েছে বিশ্বের নামীদামি ব্র্যান্ডের একাধিক গাড়ি ও চার্টার্ড প্লেন। মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের বিনিয়োগ ও সম্পদ রয়েছে।
গুপ্ত পরিবারের সদস্যরা নিজেদের বিলাসী জীবন ও ধনসম্পদ নিয়ে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করেন না। তাই এ-সংক্রান্ত তথ্য খুব একটা পাওয়া যায় না।
একটি ‘রাজকীয়’ বিয়ে
দক্ষিণ আফ্রিকার বিলাসবহুল সান সিটি রিসোর্টে ২০১৩ সালে একটি রাজকীয় বিয়ের আসর বসেছিল। বর দিল্লির ব্যবসায়ী আকাশ জাহাজগারহিয়া। কনে ভেগা গুপ্ত। তিনি অজয়-অতুল-রাজেশ গুপ্তর বোনের মেয়ে।
বিয়েতে দুই শতাধিক অতিথি আমন্ত্রিত ছিলেন। তাঁদের আনা-নেওয়ায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল প্রিটোরিয়ার পার্শ্ববর্তী ওয়াটারলফ সামরিক বিমানঘাঁটি। সেখানে একের পর এক চার্টার্ড ফ্লাইট ওঠানামা করেছিল। বিমানঘাঁটি থেকে পুলিশি পাহারায় রিসোর্টে গিয়েছিল অতিথিদের গাড়িবহর।
দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাওয়া বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানদের জন্য এ বিমানঘাঁটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু গুপ্ত ভাইদের তা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা।
রাজকীয় এ বিয়ের পর থেকে গুপ্ত পরিবারের বিলাসী জীবন ও ধনসম্পদের পরিমাণ নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়। গুপ্ত পরিবারের সদস্যদের বিশেষ রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া নিয়ে জুমার দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ভেতরেও সমালোচনা হয়।
সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে বেরিয়ে আসে সাপ। গুপ্ত পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগের স্তূপ জমে।
জুমার সঙ্গে সখ্য
অভিবাসী থেকে অল্প সময়ে গুপ্ত ভাইদের ধনকুবের হওয়ার পেছনে জুমার পরিবারের সঙ্গে তাঁদের সখ্যর বিষয়টি সামনে চলে আসে।
অভিযোগ ওঠে, জুমার আশীর্বাদে ফুলেফেঁপে উঠেছে গুপ্ত পরিবারের সাম্রাজ্য। এ কারণে দুই পরিবারকে এক করে ‘জুপ্তাস’ শব্দটি দক্ষিণ আফ্রিকাবাসীর কাছে জনপ্রিয়তা পায়।
২০০৯-২০১৮ সাল পর্যন্ত জুমা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘন, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে। পরে তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন। তিনি এখন বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন।
২০১৩ সালের ‘রাজকীয়’ বিয়ের পর জানা যায়, জুমার স্ত্রী বঙ্গি এনগেমা জুমা গুপ্ত পরিবারের জেআইস মাইনিং সার্ভিসের হয়ে কাজ করেছেন। জুমার মেয়ে দুদুজিলে জুমা সাহারা কম্পিউটারসের পরিচালক ছিলেন। ছেলে দুদুজানে জুমা গুপ্তদের মালিকানাধীন কয়েকটি কোম্পানির পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। মোট কথায়, দুই পরিবারের মধ্যকার সখ্য স্পষ্ট হয়।
‘গুপ্তগেট’ কেলেঙ্কারি
জুমার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে গুপ্ত পরিবার দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনীতিতে বেপরোয়া হস্তক্ষেপ করেছে বলে মনে করেন সমালোচকেরা। তাঁদের মতে, জুমা সরকারে কাকে কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হবে, আড়াল থেকে কলকাঠি নেড়ে তা-ও ঠিক করে দিয়েছে এ পরিবার। কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্রের আলোচিত ‘ওয়াটারগেট’ কেলেঙ্কারির আদলে বিষয়টিকে ‘গুপ্তগেট’ কেলেঙ্কারি নামে অভিহিত করেন।
সমালোচকেরা বলেন, জুমা সরকারের সময় রাজনীতিক নাকি করপোরেট ব্যবসায়ী—কারা দেশ চালিয়েছেন, সেটাই ছিল বড় প্রশ্ন। আর তাঁদের অভিযোগের আঙুল ছিল সরাসরি গুপ্ত পরিবারে দিকে।
রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের পাশাপাশি সরকারের কাছ থেকে বেআইনি সুবিধা নিয়েছেন গুপ্ত ভাইয়েরা। তবে জুমা ও গুপ্ত ভাইয়েরা কোনো ধরনের অনিয়মে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন।
পতনের শুরু
অনিয়ম, দুর্নীতি, সরকারে গুপ্ত পরিবারের প্রভাব বিস্তারের খবর সামনে আসতে থাকায় জুমার জনপ্রিয়তায় ধস নামে। ২০১৮ সালে তিনি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। জুমার প্রস্থানে বড় ধাক্কা খান গুপ্ত ভাইয়েরা।
গুপ্ত ভাইদের জোহানেসবার্গের বাড়িতে তল্লাশি চালায় পুলিশ। জুমার বিচার শুরু হলে গুপ্ত ভাইয়েরা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে পালিয়ে যান। ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাঁদের নামে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়।
গত সপ্তাহে গুপ্ত ভাইদের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। দক্ষিণ আফ্রিকার আইন ও সংশোধন সেবা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, সংযুক্ত আরব আমিরাতে রাজেশ ও অতুল গুপ্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন। তবে অজয় গুপ্ত এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন।
এখন সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে থাকা বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় রাজেশ ও অতুল গুপ্তকে ফিরিয়ে আনার প্রত্যাশা করছে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার। দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরিয়ে এনে তাঁদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে বলে জানিয়েছেন দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা।
বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান ও আল-জাজিরা অবলম্বনে
আরও পড়ুন: