করোনার নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’ সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে
দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনার নতুন একটি ধরন শনাক্ত হয়েছে। নতুন এ ধরন বারবার জিনগত রূপ বদলাতে সক্ষম। ধরনটির কারণে বিশ্বে নতুন করে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদ্বেগ ছড়িয়েছে। জারি হচ্ছে বিধিনিষেধ ও ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা।
ঝুঁকিপূর্ণ বলা হচ্ছে কেন
প্রাথমিকভাবে করোনার নতুন এ ধরনটির বৈজ্ঞানিক নাম বি.১.১.৫২৯। তবে গতকাল শুক্রবার এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘ওমিক্রন’। এ নাম দিয়েই ধরনটিকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে আখ্যায়িত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। উদ্বেগজনক বলার কারণ হিসেবে সংস্থাটি এ ধরনটির বারবার জিনগত রূপ বদল এবং আগেও করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত ব্যক্তিদের আবার এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির বিষয়টিকেই সামনে তুলে এনেছে।
প্রথম কোথায় শনাক্ত হয়?
গত মঙ্গলবার দক্ষিণ আফ্রিকায় ধরনটি প্রথম শনাক্ত হয়। ধরনটির কারণে গত দুই সপ্তাহে দেশটির গৌতেং প্রদেশে করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়া ও জোহানেসবার্গ নিয়ে নগর অঞ্চলটি গঠিত। এ ধরন অধিক সংখ্যকবার জিনগত রূপ বদল এবং মানুষের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে সক্ষম বলে বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা। মূলত এ দুটি কারণেই নতুন ধরনটি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যে ব্যাপক হইচই ফেলে দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা বিভাগের প্রধান চিকিৎসা পরামর্শক নতুন এ ধরনকে ‘ভয়াবহ’ ও ‘এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে খারাপ ধরন’ বলে বর্ণনা করেছেন।
কোথায় থেকে এল এই ধরন?
দক্ষিণ আফ্রিকায় গৌতেং প্রদেশে প্রথম শনাক্ত হয়েছে বলেই যে ধরনটির উৎপত্তি সেখানে তা বলা যাচ্ছে না। এর আগে সংগ্রহ করা নমুনায় দেখা যাচ্ছে, ১১ নভেম্বর বতসোয়ানায় সংগৃহীত নমুনায় এ ধরন ছিল। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ধরনটির অস্বাভাবিকভাবে জিনগত রূপ বদলের ব্যাপারটি থেকেই বোঝা যায় যে এটি সম্ভবত রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাওয়া দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে এসেছে। যেমন চিকিৎসা করা হয়নি এমন একজন এইচআইভি/ এইডস রোগী।
বিজ্ঞানীরা এতটা উদ্বিগ্ন কেন?
এ ধরনটির স্পাইক প্রোটিনে ৩০টির বেশি মিউটেশন রয়েছে। অতি সংক্রামক ডেলটার তুলনায় সংখ্যাটা দ্বিগুণেরও বেশি। আমাদের দেহকোষে ঢুকে পড়ার জন্য ভাইরাস মূলত এটাকে ব্যবহার করে থাকে। এমন নাটকীয় পরিবর্তনের কারণে এ উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যে এর আগে সংক্রমিত হওয়ার কারণে শরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি অথবা করোনার টিকা ধরনটির সঙ্গে আর মানিয়ে নিতে পারবে না। জিনগত রূপ বদলের বিষয়টির ওপর ভিত্তি করেই বিজ্ঞানীদের পূর্বানুমান, এ ধরনটি আরও বেশি মাত্রায় সংক্রমণ ঘটাবে এবং এর আগে অন্য ধরনের কারণে যাদের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা তৈরি হয়েছে তারা পুনরায় আক্রান্ত হতে পারেন।
এটা কি আরও সংক্রামক?
সংক্রমণের মাত্রা নিয়ে স্পষ্ট হওয়া না গেলেও ধরনটি সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে, সেটা খুব উদ্বেগজনক। দক্ষিণ আফ্রিকায় ঊর্ধ্বগতি সংক্রমণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ১৬ নভেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় যেখানে ২৭৩ জনের করোনা শনাক্ত হয় এ সপ্তাহের শুরুতে সেই সংখ্যা ১ হাজার ২০০ ছাড়িয়ে গেছে। এর ৮০ শতাংশের বেশি দেশটির গৌতেং প্রদেশের। প্রাথমিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, খুব দ্রুত এ ধরন আধিপত্যশীল ধরন হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। এতে আগাম সতর্কতা জরুরি হয়ে পড়েছে।
বিদ্যমান টিকা এর বিরুদ্ধে কাজ করবে?
নতুন ধরনের জিনগত রূপ বদল নিয়ে বিজ্ঞানীরা সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। তাঁদের উদ্বেগের কারণ নতুন ধরনের কিছু কিছু মিউটেশন যে রোগ প্রতিরোধব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে সক্ষম তা ইতিমধ্যে জানা গেছে। যদিও এগুলো তাত্ত্বিক জায়গা থেকে বিজ্ঞানীদের পূর্বানুমান। অ্যান্টিবডিগুলো কীভাবে কার্যকরভাবে নতুন এ ধরনের সংক্রমণ রুখে দিতে পারে, তা পরীক্ষার জন্য জোর গতিতে গবেষণা শুরু হয়েছে। তবে এ ধরনটির কারণে সত্যিকার অর্থে বিশ্বজুড়ে পুনরায় করোনায় সংক্রমিত হওয়ার হারের তথ্য-উপাত্ত আসতে শুরু করলে হয়তো মানুষের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন ঘটবে কি না, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাবে।
বিদ্যমান অ্যান্টবডিগুলো নতুন ধরনটিকে একেবারেই শনাক্ত করতে পারবে না, এমনটা অবশ্য মনে করছেন না বিজ্ঞানীরা। যেটা হতে পারে যে এখন করোনার যেসব টিকা আছে সেগুলো নতুন ধরনে কম সুরক্ষা দেবে। এ জন্য ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে তৃতীয় ডোজসহ টিকাদানের হার বৃদ্ধি করাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে।
এই ধরনে কোভিড কি গুরুতর হবে?
করোনার নতুন এ ধরনে আক্রান্ত হলে কোভিডের উপসর্গ বদলে যাবে অথবা আক্রান্ত ব্যক্তির অসুস্থতা আরও গুরুতর হবে কি না, তা নিয়ে এখনো কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞানীরা বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। নিশ্চিত কোনো তথ্য পেতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে। তবে এ মুহূর্তে বিজ্ঞানীরা বলছেন যে এখন পর্যন্ত এমন কোনো শক্তিশালী কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি, যার কারণে সন্দেহ করা যায় নতুন এ ধরনটি ভয়াবহ হবে, নাকি মাঝারি পর্যায়ের হবে।
বিশ্বজুড়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা কতটা?
এখন পর্যন্ত ধরনটিতে আক্রান্ত বেশির ভাগ মানুষ দক্ষিণ আফ্রিকার। এ ছাড়া বতসোয়ানা ও হংকংয়ে এ ধরনে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ইসরায়েলেও একজনের এ ধরনে আক্রান্ত হওয়ার কথা জানা গেছে। ওই ব্যক্তি সম্প্রতি মালাউই থেকে ফিরেছেন। দেশটিতে আরও দুজন এ ধরনটিতে আক্রান্ত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া গতকাল বেলজিয়ামে একজন এ ধরনে আক্রান্ত হয়েছেন। ওই ব্যক্তি সম্প্রতি মিসর এবং তুরস্কে সফরে গিয়েছিলেন।
এ ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকায় গোষ্ঠী পর্যায়ে এ ধরনের সংক্রমণ ছড়িয়েছে। যদি এ ধরনের সংক্রমণ ক্ষমতা বেশি হয়ে থাকে, তাহলে ধরে নেওয়া যায় যে ইতিমধ্যে অন্যান্য দেশেও এর বিস্তার ঘটেছে।