আফ্রিকার দিকে ঝুঁকছে আইএস?
পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো গত ২৯ এপ্রিল প্রকাশ্য ভিডিওবার্তা দিয়েছিলেন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতা আবু বকর আল-বাগদাদি। ভিডিওবার্তায় তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল বেশ মলিন। মলিন হবে নাই–বা কেন, ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের নিয়ন্ত্রণ কমতে কমতে এখন প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র–সমর্থিত অভিযানে গত মার্চে ইরাক-সিরিয়ায় নিজেদের শেষ ঘাঁটিটিও হারিয়েছে আইএস।
কিন্তু নিজের অনুসারীদের নতুন বার্তা দিয়েছেন বাগদাদি। মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ন্ত্রণ হারালেও কার্যক্রম স্থগিত করছে না আইএস। বরং মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে তারা এখন ঝুঁকছে আফ্রিকার দিকে। মালি ও বুরকিনা ফাসোর বিদ্রোহী দলগুলো আইএসের সঙ্গে জোট বাঁধছে। ভিডিও বার্তায় এমন খবর জানিয়েছেন বাগদাদি নিজেই। নতুন এই জোটকে স্বাগতও জানিয়েছেন তিনি। বৃহত্তর সাহারা অঞ্চলে আইএসের নেতা আবু ওয়ালিদ আল-সাহরাওয়ির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন বাগদাদি। এমন অবস্থায় তাই প্রশ্ন উঠছেই, তবে কি মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে আফ্রিকার দিকে ঝুঁকছে আইএস?
গত বছর আফ্রিকায় জঙ্গি হামলায় প্রায় ১০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, যাদের মধ্যে বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের হামলায় যত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, আফ্রিকায় জঙ্গি হামলায় কেবল এক বছরেই তার কাছাকাছি সংখ্যক মানুষের প্রাণ গেছে। আফ্রিকায় জঙ্গি মোকাবিলায় নিয়োজিত পশ্চিমা সেনার সংখ্যা খুব দ্রুতই অন্য যেকোনো অঞ্চলে নিয়োজিত সেনা সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে প্রায় সাত হাজার সেনা নিয়োজিত করেছে। ফ্রান্স সাহেল অঞ্চলে প্রায় সাড়ে চার হাজার সেনা মোতায়েন করেছে। জার্মানি ও ইতালি উভয়েই এক হাজার করে সেনা মোতায়েন করেছে। এ ছাড়া কানাডা, স্পেন, এস্তোনিয়া ও ডেনমার্কের মতো দেশগুলোও আফ্রিকায় জঙ্গি মোকাবিলায় সেনা পাঠাচ্ছে।
কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে নয়, বরং আফ্রিকার বেশ অনেকটা অংশজুড়েই আইএস ও তাদের জঙ্গি কার্যক্রম বিস্তৃত হয়ে পড়ছে। পূর্বে সোমালিয়া থেকে শুরু করে পশ্চিমে আটলান্টিক পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে আইএসের কার্যক্রম। বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর বেশির ভাগই আফ্রিকা মহাদেশে অবস্থিত। বাজে শাসনব্যবস্থার কারণে অনেক দেশেই একাধিক বিদ্রোহী দলও গড়ে উঠেছে। এটিকেই কাজে লাগাতে চাইছে আইএস। সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ লোকজনের অনেকেই সামান্য প্ররোচনায় যোগ দিচ্ছেন জঙ্গিগোষ্ঠীতে। আবার সরকারি বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়েও অনেকে আইএসে নাম লেখাচ্ছেন।
তবে চাপটা সবচেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে সাহেল অঞ্চলে। দুই বছর ধরেই সেখানে জঙ্গি হামলায় নিহত মানুষের সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। কেবল মালি, বুরকিনা ফাসো ও নাইজারেই ২০১৮ সালে ১১ শতাধিক মানুষ জঙ্গি হামলায় প্রাণ হারিয়েছে। গত পাঁচ মাসে পুরো সাহেল অঞ্চল মিলিয়ে পাঁচ হাজারের মতো মানুষ মারা গেছে। আফ্রিকার অন্যতম প্রভাবশালী ও ভয়ানক জঙ্গিগোষ্ঠী বোকো হারামের নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে চাদ থেকে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে সাহেল অঞ্চলে জঙ্গিগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল মাত্র এক। আর এখন সেই সংখ্যা অন্তত ১০-এ এসে ঠেকেছে।
ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, জঙ্গি বাহিনী ও সরকারি সামরিক বাহিনীর লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে প্রাণ দিতে হচ্ছে সাধারণ ও বেসামরিক নাগরিকদের। সামরিক বাহিনীর ওপর জঙ্গিদের হামলার জবাব দিতে মালিতে গত মার্চে হামলা চালিয়ে প্রায় ১৭০ জনের প্রাণ নিয়েছে সামরিক বাহিনী। গত জানুয়ারিতে বুরকিনা ফাসোর গ্রামাঞ্চলে ২১০ জন বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে দেশটির সামরিক বাহিনী। এমন প্রাণঘাতী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে আইএসের প্রতি সমর্থন বাড়িয়ে যাচ্ছে সাহেল অঞ্চলের দেশগুলোর সামরিক বাহিনীগুলো।
এ বিষয়গুলো থেকে এটি স্পষ্ট যে, মধ্যপ্রাচ্যের পর এবার আফ্রিকায় প্রাধান্য বিস্তার করতে চলেছে আইএস। মধ্যপ্রাচ্যের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, সামরিক বাহিনী ও আইএসের এই লড়াই বেশ দীর্ঘ হতে চলেছে।