ক্ষমতা গ্রহণের শুরু থেকেই অভ্যুত্থানের ঝুঁকিতে ছিলেন পশ্চিমাপন্থী বাজোম
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালি ও বুরকিনা ফাসোতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অভ্যুত্থান হয়েছে। সামরিক জান্তার হাতে গেছে রাষ্ট্রক্ষমতা। ব্যতিক্রম ছিল নাইজার। দেশটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বাজোম পশ্চিমাপন্থী ও গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত শাসকদের একজন। শক্ত হাতে দেশ সামলাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত বাজোমও সেনাবাহিনীর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেন।
মোহাম্মদ বাজোম ২০২১ সালে ক্ষমতায় আসেন। গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচনে জিতে প্রেসিডেন্ট হন তিনি। নাইজারে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতার পালাবদলের অগ্রপথিক ধরা হয় তাঁকে। গতকাল বুধবার হঠাৎ করে মোহাম্মদ বাজোমকে রাজধানী নিয়ামেইর প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে বন্দী করা হয়। নাইজারের প্রেসিডেন্ট গার্ডের সদস্যরা তাঁকে বন্দী করেন।
এরপর পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হয়। নাইজারের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক বিবৃতিতে দেশটির সেনারা জানান, প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বাজোমকে পদচ্যুত করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিদ্যমান অব্যবস্থাপনা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জেরে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
মোহাম্মদ বাজোমের জন্ম ১৯৬০ সালে নাইজারের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলের দিফায়। দেশটির সংখ্যালঘু আরব সম্প্রদায়ে তাঁর জন্ম। তিনি নাইজারের দক্ষিণাঞ্চলের গৌরে ও জিন্দারে পড়াশোনা করেন। পরে দর্শনশাস্ত্রে উচ্চতর শিক্ষা নিতে সেনেগালে যান তিনি।
সেখানে শিক্ষকতায় যুক্ত হন মোহাম্মদ বাজোম। প্রাদেশিক একটি হাইস্কুলে তিনি ছয় বছর শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকতা পেশায় থাকাকালে বক্তৃতায় বেশ পটু হয়ে ওঠেন তিনি। দেশে ফিরে শ্রমিক রাজনীতিতে যুক্ত হন তিনি। নাইজেরিন পার্টি ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড সোশ্যালিজমের (পিএনডিএস) প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য তিনি।
নাইজারে ২০১১ সাল থেকে প্রেসিডেন্ট ছিলেন মোহাম্মাদু ইসুফু। এক দশকের শাসনামলে মোহাম্মদ বাজোম তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। কয়েকটি মন্ত্রণালয় সামলানোর অভিজ্ঞতা যুক্ত হয় তাঁর ঝুলিতে। নাইজারের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হওয়ার লড়াইয়ে শামিল হতে ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে সরকারি দপ্তর ছাড়েন মোহাম্মদ বাজোম।
এরপর পুরোপুরি রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন মোহাম্মদ বাজোম। ২০২১ সালের নির্বাচনে ৫৫ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে নাইজারের প্রেসিডেন্ট হন তিনি। প্রেসিডেন্টের দপ্তরে প্রবেশ করে মোহাম্মদ বাজোম ঘোষণা দেন, তিনি পূর্বসূরি ইসুফুর আমলের প্রশাসনিক কাজের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে আগ্রহী।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের গবেষক ইব্রাহিম ইয়াহিয়া ইব্রাহিম বলেন, এ অঞ্চলের শাসকদের বিরুদ্ধে সচরাচর ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। কিন্তু নাইজারে বড় বড় দুর্নীতির ঘটনাগুলোয় প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বাজোমের সম্পৃক্ততা নেই। বরং জনগণের উন্নয়নের জন্য গৃহীত কাজ কঠোরভাবে পরিচালনার জন্য তিনি বিশেষভাবে পরিচিত।
নাইজারের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে জিহাদিদের বিরুদ্ধে লড়াই এগিয়ে নিয়েছেন মোহাম্মদ বাজোম। এই কাজের মধ্য দিয়ে তিনি পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। যুক্তরাষ্ট্র এবং একসময় নাইজারে উপনিবেশ স্থাপন করা ফ্রান্স সরকার তাঁকে সরাসরি সহায়তা করে।
নাইজারে ফ্রান্সের সামরিক ঘাঁটিও রয়েছে। বুরকিনা ফাসো থেকে সাম্প্রতিক সময়ে ফরাসি সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো নাইজারে প্রায় দেড় হাজার ফরাসি সেনা রয়ে গেছে।
এত কিছুর পরও সেনা অভ্যুত্থানের ঝুঁকির মধ্যেই ছিলেন মোহাম্মদ বাজোম। প্রেসিডেন্ট পদে তাঁর শপথের কয়েক দিন আগেও এমন চেষ্টা দেখা গেছে। ওই সময় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের মধ্যে নাইজারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওসমানে সিসে ও বিমানবাহিনীর ক্যাপ্টেন সানি গৌরোজা ছিলেন। গত ফেব্রুয়ারিতে গৌরোজাসহ পাঁচজনকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। খালাস পান সিসে।
গত মার্চে আবারও মোহাম্মদ বাজোমকে উৎখাতে আরেক দফা চেষ্টা চলে। জানা যায়, ওই সময় মোহাম্মদ বাজোম তুরস্ক সফরে ছিলেন। দেশে ফিরে শক্ত হাতে পরিস্থিতি সামলান তিনি। কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে সরকার উৎখাতের এই প্রচেষ্টা ও গ্রেপ্তারের বিষয়ে মোহাম্মদ বাজোমের প্রশাসন কখনোই প্রকাশ্যে কিছু জানায়নি।
পশ্চিমাপন্থী মোহাম্মদ বাজোম এখন প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে বন্দী। সেখানে তিনি কী অবস্থায় আছেন, তা জানা যায়নি। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বাজোমের অবিলম্বে মুক্তি চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, জাতিসংঘ, পশ্চিম আফ্রিকার প্রধান আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক জোট ইকোয়াস, আফ্রিকান ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ এবং সংস্থা।