ম্যান্ডেলার ভক্তরা এখন তাঁর দলের ওপর ভরসা রাখছেন না
জোহানেসবার্গের শহরতলিতে এক শীতের সকালে আমি খোঁড়াখুঁড়ির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। কাছে গিয়ে দেখলাম, একজন নারী মাটিতে গর্ত করছেন। আশপাশের অন্য নারী-পুরুষেরাও একই কাজ করছিলেন। তাঁদের হাতে বাগানের পুরোনো হাতিয়ার, চাকু, পাথরের টুকরা এবং গর্ত তৈরির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। এসব গর্তে তাঁরা প্লাস্টিকের টুকরা, টিন ও কাঠের টুকরা রাখতেন।
কী করছেন জানতে চাইলে ওই নারী উত্তর দেন, ‘আমরা আমাদের খুপরি লুকিয়ে রাখছি।’
আমি ১৯৯৪ সালে জোহানেসবার্গের শহরতলির একটি স্কোয়াটার ক্যাম্পের কথা বলছি। কিছুদিন পরেই দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসের প্রথম বর্ণবাদহীন নির্বাচন। এই নির্বাচনে ভোট দিতে দেশটির মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন।
বর্ণবৈষম্যে পর্যুদস্ত একটি জাতির সেই ভোট দেখতে পাওয়া ছিল বিশ্ব মানবতার গল্পের এক বিস্ময়কর মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার মতো ব্যাপার। তখন বেশির ভাগ ভোটারই ছিলেন বয়স্ক। তাঁরা নীরবে ভোট দিয়ে ইতিহাসকে অদম্যভাবে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
৩০ বছর পর দক্ষিণ আফ্রিকা এখন একেবারেই ভিন্ন একটি দেশ। গণতন্ত্র টিকে আছে বটে, অতীতের ভয় এবং বর্ণবাদী বর্বরতাও চলে গেছে; কিন্তু নেলসন ম্যান্ডেলা প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর যে দলটি দোর্দণ্ড প্রতাপে দেশ শাসন করেছে, টানা ক্ষমতা উপভোগ করেছে, সেই ক্ষমতাসীন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি) নিয়ে মানুষ এখন গভীরভাবে হতাশ। দলটি নিয়ে মানুষের বড় ধরনের মোহমুক্তি ঘটেছে।
১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদহীন প্রথম নির্বাচনের আগ মুহূর্তে জোহানেসবার্গের স্কোয়াটার ক্যাম্পে যে নারী আমাকে নিজের খুপরি লুকিয়ে রাখার কথা বলেছিলেন, তাঁর নাম সিনথিয়া এমথেবে। তাঁর সেই গল্প ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে আমার সঙ্গেই আছে।
জোহানেসবার্গের শহরতলির ওই শীতের সকালের কথা স্মরণ করলে আমার এখনো চোখে ভাসে, সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে স্কোয়াটার ক্যাম্পটি ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল। অথচ এক ঘণ্টা আগেও সেখানে কয়েক ডজন খুপরি ও ঠুনকো তাঁবু নিয়ে একটি জনগোষ্ঠী ছিল। ভোর হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে ওসব কিছুই আর নেই। আছেন শুধু মানুষ, যাঁরা কম্বল মুড়িয়ে আগুনের চারপাশে বসে আছেন।
ওই স্কোয়াটারের শিশুরা স্কুলের ইউনিফর্ম পরে প্রধান সড়ক ধরে প্রায় এক মাইল দূরের স্কুলে যেত। জীবনে যতই দুর্ভোগ থাকুক না কেন, এখানকার মা-বাবারা তাঁদের সন্তানদের যেকোনো উপায়ে শিক্ষা দিতে চাইতেন।
সিনথিয়া তখন সাত সন্তানের জননী। তাঁকে একাই সব সন্তানের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতে হতো। কারণ, কয়েক বছর আগে তাঁর স্বামী সেই যে ঘর ছাড়লেন, আর ফেরেননি।
এই পরিস্থিতিতে প্রতিদিন ভোরে সিনথিয়া ও অন্য স্কোয়াটারদের তাঁদের খুপরি ঘর ও তাঁবুগুলো খুলে মাটিচাপা দিতে হতো। তা না হলে সেগুলো বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার শঙ্কা থাকত।
প্রতি সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফিরে সিনথিয়াকে তাঁর খুপরি খুঁড়ে বের করতে হতো। এরপর অস্থায়ী খুপরি লাগিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে সেখানে ঘুমাতেন তিনি।
এত সতর্কতার পরও সেখান থেকে সিনথিয়াদের সরাতে সরকার মাঝেমধ্যে কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করেছে, রাবার বুলেট দিয়ে গুলি করেছে। তবুও তাঁরা বারবার ফিরে এসেছে। কারণ, তাঁদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না।
তখন সিনথিয়া বলেছিলেন, ‘আমি আমার বাচ্চাদের নিয়ে একটি সুন্দর বাড়িতে থাকতে চাই। কারণ, এভাবে থাকতে আমার কষ্ট হয়। আমি সাদা মানুষের মতো একই সুযোগ-সুবিধা চাই। আমি কষ্ট পাচ্ছি, কারণ আমি কালো।’
সিনথিয়া তখন একটি আবর্জনার স্তূপে কাজ করতেন। টিনের ক্যান সংগ্রহ করে বিক্রি করতেন। এখান থেকে যৎসামান্য আয় হতো, তা দিয়েই পুরো পরিবারের খরচ মেটাতেন।
এখন পর্যন্ত যা বলা হলো, তা কেবল একজন সিনথিয়ার জীবনের করুণ আখ্যান নয়; বরং দক্ষিণ আফ্রিকার লাখ লাখ দরিদ্র মানুষের গল্প। সিনথিয়ার জন্ম ১৯৪৬ সালে, শ্বেতাঙ্গদের মালিকানাধীন একটি খামারে। তাঁর জন্মের দুই বছর পর ‘আফ্রিকানার ন্যাশনালিস্টরা’ (শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী) ক্ষমতা দখল করে বর্ণবাদী নীতির বাস্তবায়ন শুরু করেন।
আফ্রিকানার ন্যাশনালিস্টরা জাতিগত বৈষম্যকে আইনে রূপ দিয়েছিল। ওই বর্ণবাদী আইনে অশ্বেতাঙ্গদের জীবনের প্রতিটি দিক, তথা তাঁরা কোথায় থাকতে পারবেন, কী কাজ করতে পারবেন, কাকে বিয়ে করতে পারবেন ইত্যাদি নির্মমভাবে নিয়ন্ত্রণ করত শ্বেতাঙ্গ সরকার। অত্যাচার, গুম, চলতে-ফিরতে অপমান ছিল কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের নিত্যসঙ্গী।
বাসস্থান, গণপরিবহন বা বিনোদনের স্থানসহ সবকিছুতে অশ্বেতাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গদের পৃথক রাখার তথাকথিত বর্ণবাদী আইনের অধীন লাখ লাখ কৃষ্ণাঙ্গকে দক্ষিণ আফ্রিকার এমন অঞ্চলে রাখা হয়েছিল, যা ছিল অনুর্বর। সেখানে তাঁদের নামমাত্র স্বাধীনতা ছিল।
সিনথিয়ার বর্ণবৈষম্যের অজস্র বেদনাদায়ক স্মৃতির একটি হলো জোহানেসবার্গের একটি সাদা পরিবারে পরিচারিকার কাজ করা। একবার সেই পরিবার তাঁকে কিছু উচ্ছিষ্ট খেতে দিয়েছিল। যে প্লেটে দেওয়া হয়েছিল, সিনথিয়া সেই প্লেটেই উচ্ছিষ্ট খেতে শুরু করেছিলেন। বাড়ির গৃহিণী তা দেখে বেশ খেপে গিয়েছিলেন।
সেই অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ টেনে সিনথিয়া বলেন, ‘বাড়ির ম্যাডাম আমাকে বলেছিলেন, আমি যেন আর কখনো এমনটি না করি, তাঁরা যে প্লেটে খান, সেই একই প্লেট থেকে যেন না খাই। তাঁর আচরণ এমন ছিল, যেন আমি একটা কুকুর।’
সিনথিয়া এমথেবে সেসব লাখ লাখ দক্ষিণ আফ্রিকাবাসীর একজন, যাঁদের নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৯০ সালে কারামুক্ত হওয়ার পর সমতা ও ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এর তিন বছর পর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার গ্রহণের সময় এএনসির এই নেতা দক্ষিণ আফ্রিকাকে 'শিশুস্বর্গে’ পরিণত করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন।
সেই দক্ষিণ আফ্রিকা এখন আরেকটি সাধারণ নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে। এমন একটি সময়ে সিনথিয়ার সঙ্গে আমি দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি বর্তমানে ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিদের নিয়ে দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় একটি গ্রামে থাকেন। গ্রামটি সিনথিয়ার সঙ্গে আমার প্রথম যে স্কোয়াটারে দেখা হয়েছিল, সেখান থেকে অনেক দূরে।
দক্ষিণ আফ্রিকার পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন আগামীকাল বুধবার। ১৯৯৪ সালের পর থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সাতটি নির্বাচনেই জিতেছে নেলসন ম্যান্ডেলার এএনসি। ক্ষমতাসীন দলটির সিরিল রামাফোসা দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট।
কাল বুধবারের নির্বাচন রামাফোসার নেতৃত্বাধীন এএনসিকে অগ্নিপরীক্ষায় ফেলে দিয়েছে। কারণ, বিভিন্ন জরিপের পূর্বাভাস, এবারের নির্বাচনে এএনসির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা কম। দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তি আন্দোলনের সবচেয়ে বড় ও পুরোনো এই দল ৫০ শতাংশের কম ভোট পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমনটি হলে দলটিকে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জোট সরকার গঠন করতে হবে।
কর্মসংস্থানের সংকট, বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আবাসন–সংকট, দুর্নীতি, শ্বেতাঙ্গ-অশ্বেতাঙ্গের আয়বৈষম্যের মতো বিষয়গুলো চলতি নির্বাচনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। ৩০ বছরের বেশি সময় আগে যে সিনথিয়া এএনসির একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন, দলটি নিয়ে আজ তিনিও হতাশ।
জীবনের ঘানি টানতে টানতে রোগ-শোক ও বয়সের ভারে ক্লান্ত সিনথিয়া বলেন, দেশে কোনো চাকরি নেই। মানুষ কষ্টে আছেন। কিন্তু তারপরও এএনসি ঘ্যানঘ্যান করছে—ভোট দেন, দয়া করে আমাদের ভোট দেন। আমি কিন্তু এবার ভোট দিতে যাচ্ছি না। কেন আমি ভোট দিতে যাব? আমাদের ভোট কোনো পরিবর্তন আনছে না। সরকার আমাদের জন্য কিছুই করছে না।