চীনের একটি ভাসমান হাসপাতালে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের এত ভিড় কেন
হাড়কাঁপানো শীত, তুষারপাত ও দমকা হাওয়া উপেক্ষা করে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন শহরের বন্দরে ভিড় করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
চীনের একটি জাহাজ এই বন্দরে বর্তমানে নোঙর করা আছে। জাহাজটি আসলে ভাসমান হাসপাতাল। এই হাসপাতাল থেকে কেপ টাউন শহরের বাসিন্দাদের বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে।
আফ্রিকা মহাদেশের সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে উন্নত অর্থনীতির একটি দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু চলমান অর্থনৈতিক সংকটে দেশটির বিভিন্ন সরকারি সেবার তহবিলের টান পড়েছে।
মূল্যস্ফীতির কারণে দেশটির জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। ফলে দেশটির অনেক মানুষ বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ব্যয় বহন করতে পারছে না।
চীনের ভাসমান হাসপাতালটির নাম ‘পিচ আর্ক’। জাহাজটি গত সপ্তাহে কেপ টাউন বন্দরে আসে। দক্ষিণ আফ্রিকার দুই হাজার জনের বেশি নাগরিক ইতিমধ্যে এখান থেকে চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন।
ভাসমান হাসপাতালটিতে নানা ধরনের স্বাস্থ্য-চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে আছে অন্তঃসত্ত্বা ও প্রসূতি নারীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চোখের ছানির অস্ত্রোপচার, কাপিং থেরাপি।
দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে চীনের শক্তিশালী রাজনৈতিক অংশিদারত্ব আছে। বেইজিং বিশ্বজুড়ে নিজেদের প্রভাববলয় বাড়াতে নানা কৌশল খাটাচ্ছে। এসব কৌশলের সর্বশেষ উদাহরণ এই ভাসমান হাসপাতাল।
কেপ টাউনে চীনের ভাসমান হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া ব্যক্তিদের একজন লুসি মানিয়ানি। তিনি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, গর্ভে থাকা সন্তানের প্রতিচ্ছবি (ইমেজ) প্রথমবার এই হাসপাতালেই দেখেছেন তিনি। তাই তিনি খুবই খুশি।
হাসপাতালটিতে চিকিৎসাসেবা নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আরেকজন জোসেফ উইলিয়ামস। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় টেলিভিশন এসএবিসিকে বলেন, ‘আপনি যখন স্থানীয় ক্লিনিকে যাবেন, আপনাকে সেবা পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হবে। সেবা পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করবে আপনার অবস্থা কেমন, তার ওপর। কিন্তু এখানে খুব দ্রুত সেবা দেওয়া হয়। আমি কৃতজ্ঞ। আমি আসলে যে সেবার জন্য এসেছি, তা পেয়েছি।’
কর্মকর্তারা জানান, চীনের ভাসমান হাসপাতালটিতে দিনে ৭০০ জন রোগীকে সেবা দেওয়া যায়। দক্ষিণ আফ্রিকা ও চীনের সেনাবাহিনীর মধ্যকার যৌথ মহড়ার অংশ হিসেবে এই সেবা দেওয়া হচ্ছে।
হাসপাতালটিতে ৩০০টি শয্যা আছে। আইসিইউ শয্যা আছে ২০টি। একাধিক অস্ত্রোপচার কক্ষ ও ক্লিনকাল বিভাগ আছে। এমনকি একটি উদ্ধারকারী হেলিকপ্টারও আছে হাসপাতালটিতে। জাহাজে মোট কর্মী আছেন ১০০ জন।
জাহাজটিতে প্রথম দুই দিন যাঁদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে, তাঁদের আগে থেকেই বাছাই করে রাখা হয়েছিল। গত সোমবার থেকে সর্বসাধারণের চিকিৎসাসেবার জন্য হাসপাতালটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
ওয়েস্টার্ন কেপ প্রদেশের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান সাদিক করিম বিবিসিকে বলেন, তাঁরা রাতেও চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। যাতে কেপটাউনের সড়কে থাকা ছিন্নমূল মানুষদের সেবা দেওয়া যায়। কারণ, তাঁরা সাধারণত স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হন।
বিভিন্ন যত্নকেন্দ্রে থাকা বয়স্ক মানুষদেরও এখানে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান সাদিক করিম। তিনি নিজেও বাকি সাধারণ মানুষের মতো সারি ধরে এই হাসপাতালে সেবা নিয়েছেন।
নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে সাদিক করিম বলেন, নাম নিবন্ধন থেকে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ শেষ করতে তাঁর এক ঘণ্টার মতো সময় লেগেছে। তাঁর দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসাসেবা পেতে এর চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগে। কারণ, হাসপাতালগুলোয় জনবলের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে।
অথচ দক্ষিণ আফ্রিকার যেসব প্রদেশে স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা ভালো বলে দাবি করা হয়, তার একটি ওয়েস্টার্ন কেপ।
দক্ষিণ আফ্রিকায় চীনের ভাসমান হাসপাতালটিতে এখন পর্যন্ত ৫৭টি অস্ত্রোপচার হয়েছে। পুরো প্রদেশের প্রায় ৮০ হাজার মানুষ এখানে নানা ধরনের চিকিৎসাসেবা পাওয়ার অপেক্ষা আছেন।
চিকিৎসা কর্মকর্তা সাদিক করিম বলেন, বেশির ভাগ রোগী অর্থোপেডিকের। এ ছাড়া চোখের ছানির রোগীও আছেন বেশ। কিছুসংখ্যক নারী স্থায়ী বন্ধ্যাকরণের অস্ত্রোপচার করতে চাইছেন। কারণ, তাঁরা আর সন্তান নিতে চান না।
স্থানীয় লোকজনের কাছে পিচ আর্কের চিকিৎসাসেবা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে হেলথ জাস্টিস ইনিশিয়েটিভের প্রধান ডা. শুয়াইব মাঞ্জরা বলেন, এই প্রদেশ, এমনকি পুরো দেশে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা যেমনটা হওয়া উচিত ছিল, তেমনটা নেই। যেভাবে রোগীদের সেবা দেওয়া দরকার ছিল, সেভাবে দেওয়া হচ্ছে না। এই হাসপাতালের জনপ্রিয়তা সে কথাই বলছে।
শুয়াইব মাঞ্জরা বিবিসিকে বলেন, প্রায় সময়ই দেখা যায়, লোকজন চিকিৎসাসেবা পেতে সারাদিন ধরে ক্লিনিকে বসে আছেন। হাসপাতালগুলোয় অনেক ভিড় থাকে। বাজেট ও জনবল কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে সাধারণ চিকিৎসাসেবা পেতে লোকজনকে কাজকর্ম ফেলে হাসপাতালে অনেক সময় কাটিয়ে দিতে হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষমতাসীন দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি) বলছে, তাদের জাতীয় স্বাস্থ্য বিমা স্কিম বাস্তবায়িত হলে দেশটির সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপক উন্নতি হবে। একপর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা বিনা মূল্যে হবে। কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে খরচ মেটানো হবে।
গত মে মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এএনসি পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। ফলে জোট সরকারের অংশীদারদের কথা এএনসিকে বিবেচনায় নিতে হয়।
শরিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (ডিএ) জাতীয় স্বাস্থ্য বিমার কিছু দিক নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে, তা সত্ত্বেও দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী অ্যারন মোতসোয়ালেদি জাতীয় স্বাস্থ্যবিমার বাস্তবায়ন নিয়ে আশাবাদী।
যদি তা হয়, তাহলে দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাস্থ্য খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। তবে সমালোচকদের আশঙ্কা, এর ফলে চিকিৎসা পেশাজীবীরা চাপে পড়ে যেতে পারেন। তখন তাঁরা দেশের বাইরে কর্মসংস্থানের দিকে ঝুঁকতে পারেন।
দেশটির স্বাস্থ্যখাতের বেসরকারি কোম্পানিগুলো ইতিমধ্যে জোরেশোরে এই বিমার বিরোধিতা করেছে। কারণ, এই ব্যবস্থায় লোকজনকে চিকিৎসার জন্য বেসরকারি বিমা গ্রহণ করতে দেওয়া হবে না।
বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকার ১৪ শতাংশ মানুষ বেসরকারি চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করেন। বাকি ৮৬ শতাংশ মানুষ সরকারি ক্লিনিক-হাসপাতালের সেবার ওপর নির্ভরশীল।