ম্যান্ডেলা নেই, ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাঁর বন্ধুত্ব এখনো অমলিন
১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস, দীর্ঘ ২৭ বছরের কারাবাসের পর সদ্য মুক্তি পেয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে ম্যান্ডেলা সাক্ষাৎ করেন আরেক মুক্তিকামী নেতা ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে।
সাক্ষাতে আরাফাতকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন ম্যান্ডেলা। তিনি ফিলিস্তিনিদের মুক্তির আন্দোলনকে সমর্থন করতেন। যদিও এটা নিয়ে নানা বিতর্ক–সমালোচনা ছিল। কিন্তু ম্যান্ডেলা সেসবে কখনোই কান দেননি।
ফিলিস্তিনের প্রশ্নে তিনি (নেলসন ম্যান্ডেলা) কখনোই আপস করেননি। আমাদেরও করা উচিত হবে না।
ম্যান্ডেলা শুধু ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করতেন তা নয়, আরাফাতের প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন (পিএলও) বর্ণবাদের বিরুদ্ধে, দক্ষিণ আফ্রিকায় সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ শাসনের বিরুদ্ধে ম্যান্ডেলার দীর্ঘদিনের সংগ্রামে সমর্থন জুগিয়ে এসেছে। আর ম্যান্ডেলা আরব ভূখণ্ডে ইসরায়েলি আগ্রাসনের ঘোর বিরোধী ছিলেন।
নেলসন ম্যান্ডেলার দশম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ৫ ডিসেম্বর। ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। দশম মৃত্যুবার্ষিকীর প্রাক্কালে নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি মান্ডলা ম্যান্ডেলা এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমরা ভাগ্যবান, তারা (ফিলিস্তিনিরা) আমাদের সমর্থন জুগিয়েছিল। এমন সমর্থনের জেরে আমরা কাঙ্ক্ষিত মুক্তি অর্জন করেছি...আমার দাদা বলেছিলেন, ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম ছাড়া আমাদের স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ।’
দাদা নেলসন ম্যান্ডেলার দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) একজন আইনপ্রণেতা মান্ডলা ম্যান্ডেলা। ৩ ডিসেম্বর থেকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে জোহানেসবার্গে তিন দিনের একটি সম্মেলন আয়োজন করেছেন তিনি। সম্মেলনে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সদস্যরাও হাজির ছিলেন।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভূখণ্ডে হামাসের হামলার মধ্য দিয়ে চলমান সংঘাতের সূচনা। হামলায় ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হন। বন্দী করা হয় ২৪০ ইসরায়েলিসহ অন্যান্য দেশের নাগরিককে। এসব হিসাব ইসরায়েল সরকারের। ওই দিনই হামাসের নিয়ন্ত্রণে থাকা অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় পাল্টা নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী।
দাদা নেলসন ম্যান্ডেলার দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) একজন আইনপ্রণেতা মান্ডলা ম্যান্ডেলা। ৩ ডিসেম্বর থেকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে জোহানেসবার্গে তিন দিনের একটি সম্মেলন আয়োজন করেছেন তিনি। সম্মেলনে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সদস্যরাও হাজির ছিলেন।
এরপর দুই মাস হতে চলল। মাঝে যুদ্ধবিরতির কয়েক দিন বাদে প্রতিদিনই গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। হামলা থেকে স্কুল, কলেজ, মসজিদ, গির্জা, হাসপাতাল—কিছুই বাদ যায়নি। হামলায় প্রাণ গেছে সাড়ে ১৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির। বেশির ভাগই নারী ও শিশু। গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার মধ্যে প্রায় ১৯ লাখ এখন বাস্তুচ্যুত।
রক্তাক্ত এই সময়ে ফিলিস্তিনিদের পাশে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। গত মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার পার্লামেন্টে ক্ষমতাসীন এএনসির আইনপ্রণেতাদের সমর্থনে একটি প্রস্তাব পাস হয়। এর আওতায় ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থগিত করে দেশটি। বলা হয়, গাজায় যুদ্ধবিরতিতে রাজি না হওয়া পর্যন্ত সম্পর্ক স্থগিত রাখা হবে।
এএনসির আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপপ্রধান ওবেদ বাপেলা বলেন, ‘নিজ ভূখণ্ডে এখনো পুরোপুরি স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছে না ফিলিস্তিনিরা। তাদের ভূমি এখনো আগ্রাসী শক্তির দখলে। দক্ষিণ আফ্রিকায় আমরাও একসময় অনেকটা একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি।’
বর্ণবাদের সঙ্গে তুলনা করাকে ইহুদিদের প্রতি বিদ্বেষ হিসেবে চিহ্নিত করে সমালোচনা করেছে ইসরায়েল। তবে দক্ষিণ আফ্রিকাবাসীর তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। তাঁদের অনেকে এখনো ফিলিস্তিন প্রশ্নে নেলসন ম্যান্ডেলার আদর্শ ধরে রেখেছেন।
ইতিহাসবিদ ও লেখক ডেভিড সাকস বলেন, ফিলিস্তিনিদের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন থাকার পরও নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যিনি ১৯৯৪ সালের পর ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল সফরে যান। সফরকালে ইসরায়েলের মানুষ তাঁকে সাদরে বরণ করে নিয়েছিল। আর তখনকার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক এবং তৎকালীন ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট এজার উইজম্যানকে তিনি (নেলসন ম্যান্ডেলা) ‘আমার বন্ধু’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।
বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার অভিনয়শিল্পী, কবি ও লেখক লেবোগাং মাশাইলি বলেন, ‘ফিলিস্তিনের প্রশ্নে তিনি (নেলসন ম্যান্ডেলা) কখনোই আপস করেননি। আমাদেরও করা উচিত হবে না।’