খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ একটি মহাদেশ আফ্রিকা। স্বর্ণের মতো মূল্যবান ধাতুর অনেক খনি রয়েছে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে। এসব খনি ঘিরে গড়ে উঠেছে স্বর্ণ চোরাচালান চক্র। এসব চক্র ব্যবহার করে অপরাধীরা বিশ্বজুড়ে শত শত কোটি ডলার পাচার করছেন। এ ছাড়াও এসব চক্র বিভিন্ন দেশের সরকারকে তাদের ওপর আরোপিত আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা পাশ কাটাতে সাহায্য করছে। এসব তথ্য উঠে এসেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে।
‘গোল্ড মাফিয়া’ নামে চার পর্বের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করেছেন আল–জাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা। তিন মহাদেশজুড়ে গোপনে কার্যক্রম চালানো কয়েক ডজন স্বর্ণ চোরাচালান চক্র এবং এ সংক্রান্ত হাজার হাজার নথি পর্যালোচনা করে আল–জাজিরা অনুসন্ধানী সিরিজ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। তাদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এসব স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের মাধ্যমে কীভাবে সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা শত শত কোটি ডলার মুনাফা করছেন।
আল–জাজিরার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, কীভাবে জিম্বাবুয়ে থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে প্রতি মাসে শত শত কোটি ডলারের স্বর্ণ চোরাচালান হচ্ছে। এর মাধ্যমে অপরাধীরা তাঁদের কালো টাকা সাদা করতে পারছে। এটা করা হচ্ছে অসংখ্য অদৃশ্য কোম্পানি, নকল চালান ও সরকারের নিয়োগ দেওয়া কর্মকর্তাদের মাধ্যমে।
অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, কীভাবে জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট এমারাসন নানগাওয়ার সরকার দেশের ওপর আরোপিত পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা থেকে বাঁচার জন্য স্বর্ণ চোরাচালানকারীদের কাজে লাগাচ্ছে। অর্থপাচার ও স্বর্ণ চোরাচালানের এসব কাজে জড়িত আছেন জিম্বাবুয়ের প্রভাবশালী কূটনীতিকদের একজন। এখানেই শেষ নয়, এই কাজে জড়িত স্বয়ং জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট নানগাওয়া এবং প্রেসিডেন্টের আশপাশেই থাকেন এমন সব কর্মকর্তা ও অন্যান্য ব্যক্তিরা।
এসব চোরাকারবারির মধ্যে কোটিপতি ও ধনকুবেররা আছেন। এর মধ্যে এমন একজন চোরাকারবারি আছেন যাঁর বিরুদ্ধে স্বর্ণ চোরাচালান–সংশ্লিষ্ট একই ধরনের দুর্নীতির পরিকল্পনার মাধ্যমে কেনিয়াকে প্রায় দেউলিয়া করার অভিযোগ আনা হয়েছিল এর আগে।
স্বর্ণ চোরাচালান, অর্থপাচার
অপরাধী চক্রের গোপন কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে আল–জাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদকেরা নিজেদের অপরাধী হিসেবে পরিচয় দেন। তাঁরা পরিচয় দেন, তাদের বাড়ি চীনে এবং তাঁরা এক কোটি মার্কিন ডলার পাচার করতে চান। এর মাধ্যমে এসব চোরকারবারি ও অপরাধী চক্রের (গ্যাং) সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে সমর্থ হন তাঁরা।
চোরাকারবারিদের এসব কর্মকাণ্ডের ‘মূল খেলোয়াড়’ জিম্বাবুয়ে। আফ্রিকার এ দেশটি প্রতি বছর যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করে, তার মধ্যে প্রায় অর্ধেক (২০০ কোটি ডলারের বেশি) স্বর্ণ। তবে দেশটির সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একটি কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। পশ্চিমা দেশগুলো দেশটির স্বর্ণ বাণিজ্যের ওপর সরাসরি নিষেধাজ্ঞা না দিলেও আরোপিত অন্যান্য নিষেধাজ্ঞার কারণে জিম্বাবুয়ের পক্ষে বৈধভাবে অতি মূল্যবান এই ধাতু রপ্তানি করার প্রক্রিয়াটি বেশ কঠিন।
অসংখ্য অদৃশ্য কোম্পানি এবং জিম্বাবুয়ের অতি ক্ষমতাধর কিছু ব্যক্তির ক্ষমতা ও পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে চোরাকারবারিরা স্বর্ণ বাণিজ্যের এই বাধার ফায়দা তুলে শত শত কোটি ডলার পাচার করছেন। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার এ খড়গকে একটি সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করছেন চোরাকারবারিরা। এদিকে চোরাকারবারিদের এসব চক্র জিম্বাবুয়ের সরকারকে পশ্চিমা দেশগুলোর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার যে পরিণতি বা পরিণাম সেই সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে মুনাফা অর্জনের সুযোগও করে দিচ্ছে।
চোরাচালানের এই প্রক্রিয়াটি যেমন সুচতুর তেমনি এর প্রক্রিয়াটিও বেশ সহজ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অপরাধীদের কাছে রয়েছে বিপুল পরিমাণ বেহিসাবি অর্থ। এই অর্থ তাঁরা সরাসরি বা কোনো চোরাকারবারির মাধ্যমে জিম্বাবুয়ের সরকারকে দেয়। এদিকে ডলারের জন্য মরিয়া জিম্বাবুয়ের সরকার। কারণ বছরের পর বছর ধরে মূল্যস্ফীতির কারণে জিম্বাবুয়ের মুদ্রার মান তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এতে করে দেশটির মুদ্রার আন্তর্জাতিক মান নেই বললেই চলে। এ জন্যই ডলার প্রয়োজন।
এর পরিবর্তে চোরাকারবারিরা জিম্বাবুয়ের স্বর্ণ বিক্রি থেকে আসা নগদ ও বৈধ অর্থ পান। এই অর্থ চোরাকারবারিদের নিজেদের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়।
‘ভালো ওয়াশিং মেশিন’
আল–জাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদক দল এমন একটি চোরাকারবারি চক্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়। এই চক্রের নেতৃত্বে আছেন উয়েবার্ট অ্যাঞ্জেল। উয়েবার্ট ইউরোপ ও আমেরিকায় জিম্বাবুয়ের অ্যাম্বাসেডর–অ্যাট–লার্জ। তাঁকে এই পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট নানগাগওয়া স্বয়ং। তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয় জিম্বাবুয়েতে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করা। উয়েবার্ট জিম্বাবুয়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী কূটনীতিকদের একজন।
উয়েবার্টের একজন সহকারীও রয়েছেন, যাঁর নাম রিক্কি দোলান। আল–জাজিরার অনুসন্ধানী দল যোগাযোগ করলে তাঁরা জানান যে, একজন কূটনীতিক হিসেবে উয়েবার্টের যে ক্ষমতা আছে তিনি সে ক্ষমতা ব্যবহার করে জিম্বাবুয়েতে কালো টাকা পাচার করতে পারবেন। এই অর্থ এরপর জিম্বাবুয়ের স্বর্ণ কেনার কাজে ব্যবহার করা হবে। এ কাজে সাহায্য করবেন হেনিরিয়েতা রুশওয়া। এই রুশওয়া হলেন জিম্বাবুয়ের ‘মাইনার্স ফেডারেশনের’ প্রধান। তিনি প্রেসিডেন্ট নানগাওয়ার ভাতিজি।
আল–জাজিরার প্রতিবেদকদের সঙ্গে কথোপকথনের সময় দোলান কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে বলেন, ‘এটা খুব ভালো ওয়াশিং মেশিন, তাই না?’
উয়েবার্ট ও দোলান বারবার দাবি করতে থাকেন, দেশটির প্রেসিডেন্ট তাঁদের সঙ্গে ওই বিমানেই আছেন। উয়েবার্ট তো অর্থপাচারের আরও একটি ধারণা দেন। তিনি বেহিসাবি এসব অর্থ ব্যবহার করে জিম্বাবুয়ের অন্যতম জনপ্রিয় একটি পর্যটন আকর্ষণ ভিক্টোরিয়া ফলসের অদূরে একটি হোটেল নির্মাণের প্রস্তাব দেন।
‘এটা খুবই সহজ পথ’
একটি গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দেন কমলেশ পাট্টিনি নামে একজন ব্যবসায়ী। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে সোনা চোরাচালানের মাধ্যমে কেনিয়ার কোষাগারের কোটি কোটি ডলার পকেটস্থ করার অভিযোগে অভিযুক্ত হন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগই উঠেছিল কিন্ত তিনি কখনোই দোষী সাব্যস্ত হননি এবং সাজাও হয়নি।
স্বর্ণ চোরাকারবারিদের গোপন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে ছদ্মবেশী আল–জাজিরার অনুসন্ধানী দলের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কমলেশ পাট্টিনি এখন জিম্বাবুয়েতে একই ধরনের চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত। তিনি প্রথমে জিম্বাবুয়ে থেকে দুবাইয়ে সোনা পাচার করেন। এরপর তিনি সেই অর্থ ও স্বর্ণ অন্য কোথাও পাচার করেন।
পাট্টিনির বড় প্রতিযোগী এডওয়ার্ড ম্যাকমিলান নামে আরেকজন স্বর্ণ চোরাকারবারি। তিনিও ছদ্মবেশী আল–জাজিরার প্রতিবেদকদের অর্থ পাচারে সাহায্য করার প্রস্তাব দেন। পাট্টিনির মতো ম্যাকমিলানও জিম্বাবুয়ে থেকে দুবাইয়ে প্রতি সপ্তাহে শত শত কেজি স্বর্ণ চোরাচালান করেন। পরে সেখানে অদৃশ্য কয়েকটি কোম্পানির এবং নকল চালানের মাধ্যমে তা পাচার করেন। ম্যাকমিলানের চোরাকারবারের বিষয়টি দেখভাল করেন তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার অ্যালিস্টায়ার ম্যাথিয়াস নামের একজন ব্যক্তি। চক্রটির সঙ্গে যেসব ব্যক্তি যোগাযোগ করেন, তাঁদের ‘কালো টাকা’ কীভাবে ‘সাদা’ করা যাবে সে বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার কাজ করেন ম্যাথিয়াস।
জিম্বাবুয়ে ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে কীভাবে জিম্বাবুয়ের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি সিমন রুডল্যান্ড অর্থ পাচার করেন, সে বিষয়টি নিয়েও সব শেষে বিস্তারিত জানতে পারে আল–জাজিরা। রুডল্যান্ড আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় বিশেষত দক্ষিণ আফ্রিকার সিগারেট ব্র্যান্ড গোল্ড লিফ টোব্যাকোর মালিক।
আল–জাজিরার হাতে আসা নথিপত্র মূল্যায়ন করে দেখা যায় যে, জিম্বাবুয়ের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈধ লাইসেন্স রয়েছে এসব চোরকারবারী চক্রের। এই লাইসেন্সের মাধ্যমে তারা জিম্বাবুয়ের স্বর্ণ দুবাইয়ে বিক্রির অনুমতি পায়। চক্রগুলো এসব স্বর্ণ চোরাচালান থেকে পাওয়া অর্থ আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা করে বলে জানা যাচ্ছে।
তবে অর্থ পাচারের এ পদ্ধতি থাকার পরও পাট্টিনি, ম্যাকমিলান ও ম্যাথিয়াস আল–জাজিরার ছদ্মবেশী প্রতিবেদকদের দুবাইয়ে অদৃশ্য কোম্পানি(শেল কোম্পানি) খোলার কথা বলেন। কারণ হিসেবে তাঁরা বলেন, স্বর্ণ চোরাচালানের জন্য এমন কোম্পানি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। দুবাইয়ে জিম্বাবুয়ের স্বর্ণ বিক্রি থেকে পাওয়া বৈধ অর্থ অদৃশ্য কোম্পানিগুলোর ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। পরে চোরকারবারীরা কালো টাকা নগদে না এনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে জিম্বাবুয়েতে আনে।
ম্যাকমিলানের স্বর্ণ চোরাচালান ও অর্থ পাচার চক্রের সহযোগী ম্যাথিয়াস এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘তাহলে, আমরা যেভাবে কাজটি করি তাতে সব প্রক্রিয়া বেশ স্বচ্ছ।’
আল–জাজিরা সব কিছু অনুসন্ধান শেষে অনুসন্ধানে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে সেসব সম্পর্কে পাট্টিনির কাছে জানতে চান। পাট্টিনি তখন বলেন, কেনিয়ায় তাঁর নামে কোনো ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ নেই। তিনি অর্থ পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন। এমনকি যে কারও পক্ষে অর্থপাচার বা এ সংক্রান্ত কোনো কিছুতে জড়িত নন বলে দাবি করেন। তিনি আরও দাবি করেন, আল–জাজিরার ছদ্মবেশী প্রতিবেদকদের সঙ্গে যখন তাঁর দেখা হয় তখন তিনি মনে করেছিলেন একজন বিনিয়োগকারীর সঙ্গে দেখা করছেন যিনি হোটেল ব্যবসায় শেয়ার বিক্রি করতে চান এবং জিম্বাবুয়ের স্বর্ণ–খনিজ সম্পদে বিনিয়োগ করবেন।
একই ভাবে অ্যালিস্টায়ার ম্যাথিয়াসের কাছেও জানতে চাওয়া হলেও তিনি দাবি করেন, অর্থ পাচারের এই পদ্ধতি তিনি তৈরি করেননি। তিনি বলেন, কখনো অর্থ পাচার করেননি কিংবা অবৈধভাবে স্বর্ণ চোরাচালানও করেননি। ম্যাথিয়াস আল–জাজিরাকে বলেন, ইওয়ান ম্যাকমিলানের সঙ্গে তাঁর কাজের সম্পর্ক ছিল না।
আল–জাজিরাকে রুডল্যান্ড বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে সবই মিথ্যা। তৃতীয় কোনো পক্ষের স্বার্থেই তাঁর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে। তিনি নিজেকে একজন বড় ব্যবসায়ী দাবি করে বলেন, লোভী ও হিংসুকদের বিরুদ্ধে লড়ছেন। স্বর্ণ চোরকারবারের অভিযোগও অস্বীকার করেন।
রিজার্ভ ব্যাংক অব জিম্বাবুয়ে আল–জাজিরাকে জানায়, তারা অর্থ পাচার ও স্বর্ণ চোরাচালানের বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। এমন কোনো কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত হবে না। তবে প্রেসিডেন্ট নানগাওয়া, ম্যাকমিলান, উবেয়ার্ট, ডোলান, রুশওয়াসহ জড়িত অন্যরা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।