ভূমিকম্পের পর মরক্কোর গ্রামে এখন শুধু স্বজন হারানোর আর্তনাদ
মরক্কোর পার্বত্য এলাকা হাই এটলাসের মাওলায় ব্রাহিম গ্রামের বাসিন্দা লাহচেন একটি ওষুধের দোকানের কোনায় চুপচাপ বসে আছেন। গত শুক্রবার রাতে ভূমিকম্পে স্ত্রী ও চার সন্তানকে হারানোর পর শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছেন তিনি।
মরক্কোর পর্যটন শহর মারাকেশ থেকে গাড়িতে করে গ্রামটিতে যেতে এক ঘণ্টার মতো সময় লাগে। এএফপির প্রতিনিধিরা গ্রামটিতে পৌঁছাতেই স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে লাহচেনের পরিবারের মর্মান্তিক ঘটনার কথা শোনা গেল।
৪০ বছর বয়সী লাহচেনের কাছে গিয়ে দেখা যায়, তিনি মাথা নিচু করে রেখেছেন। তাঁর শরীর ব্যথায় কুঁকড়ে গেছে। খুব আস্তে আস্তে লাহচেন বলেন, ‘আমার সব শেষ হয়ে গেল।’
লাহচেনের সঙ্গে যখন এএফপির প্রতিনিধিদলের কথা হয়, তখন শনিবার বিকেল। উদ্ধারকর্মীরা তখন পর্যন্ত ধ্বংসাবশেষ থেকে তাঁর স্ত্রী আর ছেলের লাশ উদ্ধার করতে পারেননি। ভূমিকম্পে ভেঙে পড়া নিজেদের বাড়ির ধ্বংসাবশেষের নিচে চাপা পড়েন তাঁরা। তবে তাঁর তিন মেয়ের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে।
শোকে যেন পাথর হয়ে গেছেন লাহচেন। এএফপিকে তিনি বলেন, ‘আমি এ মুহূর্তে কিছু করতে পারছি না। আমি শুধু জগৎ থেকে দূরে থেকে শোক করতে চাই।’
শুক্রবার মরক্কোর স্থানীয় সময় রাত ১১টা ১১ মিনিটে ৬ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পটি অনুভূত হয়। উত্তর আফ্রিকার দেশটিতে এযাবৎকালের আঘাত হানা সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প এটি। ভূমিকম্পের সময় বাড়ির বাইরে ছিলেন লাহচেন।
মরক্কোর সর্বশেষ সরকারি হিসাবে বলা হয়েছে, ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছেন দুই হাজারের বেশি মানুষ। তাঁদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
নিহত মানুষের মধ্যে অর্ধেকের বেশি আল হাউস প্রদেশের বাসিন্দা। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলটি এখানে। মাওলায় ব্রাহিম গ্রামটির অবস্থানও আল-হাউস প্রদেশে। সেখানে ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত ১২ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানির ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আরও প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ভূমিকম্পের আগে মাওলায় ব্রাহিম গ্রামে প্রায় তিন হাজার মানুষের বসবাস ছিল।
ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে উদ্ধারকারীরা অনুসন্ধানকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ ধ্বংসাবশেষে আটকে আছেন কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছেন তাঁরা। লাশ দাফনের জন্য পাহাড়ে কবর খোঁড়া হচ্ছে।
গ্রামের উঁচু একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে কবর খোঁড়ার দৃশ্য দেখছিলেন আর ওড়নায় চোখের পানি মুছছিলেন বুশরা। এএফপিকে তিনি বলেন, ভূমিকম্পে তাঁর চাচাতো ভাইয়ের নাতি-নাতনিরা প্রাণ হারিয়েছে।
ভূমিকম্পের সময়কার পরিস্থিতি বর্ণনা করে বুশরা বলেন, ‘আমি এখনো কাঁপছি। মনে হলো যেন একটি আগুনের গোলা এসে সবকিছু গ্রাস করে নিয়েছে। এখানকার সবাই স্বজন হারিয়েছে। হয় এ গ্রামে, না হয় অন্য কোনোখানে।’
আরেক গ্রামবাসী লাহচেন আইত তাগাদ্দির্ত ভূমিকম্পে তাঁর দুই ভাতিজাকে হারিয়েছেন। তারা পাশের গ্রামে থাকত। তাদের একজনের বয়স ছয় বছর এবং আরেকজনের তিন বছর।
লাহচেন আইত তাগাদ্দির্ত বারবার বলছিলেন, ‘খোদার ইচ্ছায় এমনটা হয়েছে।’ তবে ভূমিকম্পে এত ক্ষয়ক্ষতির জন্য অঞ্চলটির বিচ্ছিন্নতাকেও আংশিকভাবে দায়ী করেছেন তিনি।
তাগাদ্দির্ত বলেন, ‘এখানে আমাদের কিছু নেই। পাহাড়ি এলাকাগুলো খুব দুর্গম।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী বলেন, তাঁর চাচা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচেছেন।
ওই নারী আরও বলেন, ঘরের ছাদ ভেঙে পড়ার সময় তাঁর চাচা প্রার্থনা করছিলেন। কোনোরকমে তাঁকে ধ্বংসাবশেষ থেকে বের করে আনা হয়।
ভূমিকম্পের ভয়াবহতা সম্পর্কে ওই নারী বলেন, কম্পনের সামান্য কিছু মুহূর্ত অনেক দুর্ভাগ্য ডেকে নিয়ে আসতে পারে।