সুদানে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা
সুদানে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালিয়েছে দেশটির আধা সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)। প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ, সেনাপ্রধানের বাসভবন ও খার্তুম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার দাবি করেছে আধা সামরিক বাহিনীটি। আজ শনিবারের এ অভ্যুত্থানচেষ্টার ঘটনায় সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আরএসএফের সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে।
সেনাবাহিনীই আগে তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছে আরএসএফ। একই সঙ্গে তারা উত্তরাঞ্চলীয় শহর মেরোবি ও পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর এল-ওবেইদের বিমানবন্দরও দখলে নেওয়ার দাবি করেছে।
আরএসএফ এক লাখের মতো সদস্যের একটি শক্তিশালী বাহিনী। সেনাবাহিনীই আগে তাদের ওপর হামলা চালিয়েছিল বলে আধা সামরিক বাহিনীটি দাবি করেছে।
সেনাবাহিনী বলেছে, আরএসএফের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে সুদানের বিমানবাহিনী। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সম্প্রচারিত ফুটেজে খার্তুমের আকাশে একটি সামরিক উড়োজাহাজ উড়তে দেখা গেছে। তবে বিষয়টি নিরপেক্ষভাবে যাচাই করতে পারেনি রয়টার্স।
রাজধানী খার্তুমের বিভিন্ন অংশে গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে। আশপাশের শহরগুলো থেকেও গোলাগুলির খবর দিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। রয়টার্সের একজন সাংবাদিক খার্তুমের সড়কে কামান ও সাঁজোয়া যান মোতায়েন করতে দেখেছেন। সেনাবাহিনী ও আরএসএফ উভয়ের সদর দপ্তরের কাছে ভারী অস্ত্র ব্যবহারেরও শব্দ শুনেছেন তিনি।
সেনাবাহিনী ও আরএসএফের মধ্যে কয়েক দিন ধরে চলা উত্তেজনা এখন সংঘাতে রূপ নিয়েছে। এতে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও সামরিক অভ্যুত্থানের পর সুদানে বেসামরিক শাসনে ফেরার দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা ব্যাহত হতে পারে।
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, আবাসিক এলাকায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে। এতে বেসামরিক লোকজন হতাহত হয়েছেন। সেনাবাহিনী ও শক্তিশালী আধা সামরিক বাহিনীর মধ্যে চলমান সংঘর্ষে তিনজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে ডক্টরস কমিটির বরাত দিয়ে আল-জাজিরা জানিয়েছে।
সুদানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের সদর দপ্তরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও সংঘর্ষ চলছে। একজন উপস্থাপক অল্প সময়ের জন্য টেলিভিশনের পর্দায় হাজির হয়ে এ কথা জানান।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
সুদানে সংঘর্ষের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে প্রভাবশালী আরব দেশ মিসর। সব পক্ষকে সংযম প্রদর্শনেরও আহ্বান জানিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতও লড়াই বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে বলে আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
সুদানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জন গডফ্রে বলেছেন, উত্তেজনা বেড়ে সরাসরি সংঘাতে রূপ নেওয়া ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’। সংঘাত বন্ধে জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। গডফ্রে বলেছেন, তিনি ও তাঁর দূতাবাসের কর্মীরা নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছেন।
সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনীর মধ্যকার সহিংস সংঘাত অবিলম্বে বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। লড়াইয়ের খবরে ‘অত্যন্ত উদ্বিগ্ন’ বলেও জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের এই শীর্ষ কূটনীতিক। আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, ভিয়েতনামে সফররত ব্লিঙ্কেন এক টুইটে আলোচনার মাধ্যমে বিবদমান বিষয়গুলো সমাধানেরও আহ্বান জানিয়েছেন।
সুদানে জাতিসংঘ মিশনের প্রধান ফলকার পার্থেস সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনীর মধ্যকার লড়াই অবিলম্বে বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। এক বিবৃতিতে উইনিটামস-এর প্রধান সুদানে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ারও তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। সংঘর্ষ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে সুদানে অবস্থিত রুশ দূতাবাসও।
পরস্পরকে দোষারোপ
হামলার জন্য পরস্পরকে দোষারোপ করছে সেনবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনী। সেনাবাহিনী বলেছে, কয়েকটি অবস্থানে সেনাদের ওপর হামলার চেষ্টা চালিয়েছে আরএসএফ। এর আগে দেশটির বিভিন্ন অংশে ব্যাপক গোলাগুলি শুরু হওয়ার কথা জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। চলমান এই লড়াই শেষ পর্যন্ত সর্বাত্মক সংঘাতে রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আরএসএফ এক লাখের মতো সদস্যের একটি শক্তিশালী বাহিনী। সেনাবাহিনীই আগে তাদের ওপর হামলা চালিয়েছিল বলে আধা সামরিক বাহিনীটি দাবি করেছে। এর আগে আরএসএফের প্রধান সাবেক মিলিশিয়া নেতা জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো বলেন, সেনাবাহিনী তাঁদের একটি ঘাঁটি ঘিরে ফেলে এবং ভারী অস্ত্র থেকে গুলিবর্ষণ করে। হামদান দাগালো অবশ্য হেমেদতি হিসেবেই বেশি পরিচিত।
দারফুর সংঘাতে হেমেদতির আরএসএফের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করার অভিযোগ রয়েছে। ২০১৯ সালের জুনে আরএসএফের নেতৃত্বে নিরাপত্তা বাহিনী খার্তুমে গণতন্ত্রপন্থীদের একটি শিবিরে অভিযান চালায়। এতে ১৩০ জন নিহত হন বলে ডক্টরস কমিটি জানিয়েছে।
নেপথ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি
বিশাল দেশটি ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ও উপজাতি সংঘাত মোকাবিলা করছে। সেনাবাহিনী ও আরএসএফের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি সংঘাত সুদানের নিরাপত্তা পরিস্থিতির বড় ধরনের অবনতি ঘটাতে পারে।
সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহানের নেতৃত্বে সার্বভৌম পর্ষদ ২০১৯ সাল থেকে সুদানে ক্ষমতায় রয়েছে। ক্ষমতাসীন এই পর্ষদে উপনেতা হিসেবে রয়েছেন হেমেদতি। সেনাবাহিনী ও আরএসএফের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রাথমিক চুক্তি সই করেছে বেসামরিক রাজনৈতিক দলগুলো। উভয় পক্ষকে সংঘাত অবসানের আহ্বান জানিয়েছে তারা।
সেনাবাহিনী ও আরএসএফের মধ্যে কয়েক দিন ধরে চলা উত্তেজনা এখন সংঘাতে রূপ নিয়েছে। এতে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও সামরিক অভ্যুত্থানের পর সুদানে বেসামরিক শাসনে ফেরার দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা ব্যাহত হতে পারে।
দারফুরের একসময়কার সবচেয়ে ভয়ংকর ও নির্দয় মিলিশিয়া নেতা হেমেদতি গণতন্ত্রে ফেরার এই পরিকল্পনায় নিজেকে সম্মুখভাগে রেখেছেন। এ নিয়ে তিনি সহকর্মী সামরিক শাসকদের সঙ্গে বিরোধে জড়ান। এর জের ধরেই রাজধানীতে সেনা মোতায়েন করা হয়।
দুই বাহিনীর এই দ্বন্দ্ব গত বৃহস্পতিবার প্রকাশ্যে আসে, বিশেষ করে মেরোবিতে আরএসএফ মোতায়েনকে যখন বেআইনি আখ্যা দেয় সেনাবাহিনী। গতকাল মেরোবিতে ব্যাপক গোলাগুলি হয় বলে রয়টার্সকে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে আরএসএফ ২০১৯ সালে সুদানের দীর্ঘদিনের শাসক ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করে। নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত মাসে আধা সামরিক এই বাহিনীকে সেনাবাহিনীতে একীভূত করার বিষয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যেই খার্তুমে আরএসএফ সদস্যদের আবার মোতায়েন শুরু হয়।