আগ্নেয়াস্ত্রের সঙ্গে প্রাণনাশী ‘ভালোবাসার বন্ধন’ যাঁদের
দক্ষিণ আফ্রিকার বাসিন্দা পেনসন মতসোয়া একজন কনটেন্ট নির্মাতা। ছয় বছর ধরে নিজের কাছে একটি বন্দুক রাখছেন তিনি। জোহানেসবার্গ শহরের যেখানেই যান না কেন, এটি তাঁর সঙ্গেই থাকে।
দোকান, রেস্তোরাঁ, এমনকি জিমে (ব্যায়ামাগার) যেতেও বন্দুকটি সঙ্গে নিতে তিনি ভোলেন না।
বন্দুকটি মতসোয়ার নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠার কারণ, তাঁর দেশের সহিংসতা। দক্ষিণ আফ্রিকাবাসী কয়েক বছর ধরেই রেকর্ড মাত্রার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছেন।
ইউটিউবের জন্য কনটেন্ট নির্মাতা মতসোয়া বিবিসিকে বলছিলেন, ‘আমি কোনো ভাগ্য গণনাকারী নই। আমি কখন যে হামলার শিকার হই, তা জানি না।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মতসোয়া বলছিলেন, ‘দুঃখজনক হলো, নিজেকে রক্ষায় আমার বন্দুকটি আমাকে কয়েকবার ব্যবহার করতে হয়েছে।’ উদাহরণ হিসেবে এক রাতে নৈশভোজের পর একজন ছিনতাইকারী কীভাবে ছুরি ধরে তাঁর মানিব্যাগটা চাইছিলেন, সেই ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি।
ঘটনার সময় মতসোয়া বন্দুকটি বের করেন ও তাঁর হাতে ছুরি তুলে দিতে ছিনতাইকারীকে বাধ্য করেন। পরে ছুরিটা একটা গর্তে ফেলে দেন। তবে ওই সময় কোনো গুলি ছোড়েননি তিনি।
নিজের সুরক্ষায় তিনি কয়টা বন্দুক কাছে রাখেন, তা প্রকাশ করেননি পেনসন মতসোয়া। তবে বলেন, যে কাজটা পুলিশ ও সরকারের করার কথা ছিল, হতাশাজনক হলেও তারা সেটি করতে ব্যর্থ হয়েছে।
জোহানেসবার্গের বাসিন্দা লিনেট অক্সলেও এ কথার সঙ্গে একমত পোষণ করেন ও বলেন, এ ধরনের বিপদ অবশ্যই মোকাবিলা করতে হবে।
আগ্নেয়াস্ত্র সঙ্গে রেখে কীভাবে নিজেদের রক্ষা করতে হবে, সে ব্যাপারে নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার এক উদ্যোগ নিয়েছেন লিনেট।
আমি কোনো ভাগ্য গণনাকারী নই। আমি কখন যে হামলার শিকার হই, তা জানি না।
১২টি আগ্নেয়াস্ত্রের মালিক ৫৭ বছর বয়সী এই নারী বিবিসিকে বলছিলেন, ‘আমি এক জোড়া জুতা কেনার চেয়ে একটা নতুন বন্দুক কেনাই পছন্দ করি।’
মূলত ধর্ষণ, হামলা, ডাকাতি বা অন্য কোনো ধরনের সহিংসতার শিকার হওয়া নারীদের সহায়তা করতে কাজ করছে লিনেটের সংগঠন ‘গার্লস অন ফায়ার’। দক্ষিণ আফ্রিকায় যৌন সহিংসতার হার বিশ্বে সর্বোচ্চ।
‘গার্লস অন ফায়ার’-এ যোগ দেওয়া নারীদের মধ্যে এমন একজন আছেন, যাঁর সামনে তাঁর স্বামীকে গুলি করেছিল ডাকাতেরা। এক দিন বাড়িতে ডাকাতির সময় ঘটনাটি ঘটে। তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন তিনি। ডাকাতিকালে বাড়িতে ছয় বছরের এক সন্তানও ছিল তাঁর। এমন খারাপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়ার পরই সংগঠনটিতে যোগ দেন তিনি।
মিস অক্সলে আগ্নেয়াস্ত্রের একজন প্রশিক্ষক। তিনি বলেন, ‘লোকজন বুঝতে শুরু করেছেন, আমাদের নিরাপত্তার জন্য এখন শুধু আমরাই আছি। দক্ষিণ আফ্রিকায় যে অস্ত্রের সংস্কৃতি, তা আত্মরক্ষামূলক ও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে।’
দক্ষিণ আফ্রিকার আইনেও বলা আছে, বন্দুকের লাইসেন্সধারী অধিকাংশ মানুষ গোপনে আগ্নেয়াস্ত্র বহন করতে পারবেন।
দক্ষিণ আফ্রিকায় সাধারণ মানুষ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামার পর দৃশ্যত দেশটিতে পুলিশের ভূমিকা হ্রাস পাচ্ছে। দেশটিতে এখন খুনখারাবির হার গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর মানুষের কাছেও বন্দুক হয়ে উঠছে পছন্দের অস্ত্র হিসেবে।
গান ফ্রি সাউথ আফ্রিকা (জিএফএসএ) নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ২০২১ সালের জরিপ অনুযায়ী, দক্ষিণ আফ্রিকায় ২৭ লাখের বেশি বৈধ অস্ত্রধারী রয়েছেন। এটি দেশটির বয়স্ক জনগোষ্ঠীর প্রায় ৮ শতাংশ।
দক্ষিণ আফ্রিকায় সাধারণ মানুষ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামার পর দৃশ্যত দেশটিতে পুলিশের ভূমিকা হ্রাস পাচ্ছে। দেশটিতে এখন খুনখারাবির হার গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর মানুষের কাছেও বন্দুক হয়ে উঠছে পছন্দের অস্ত্র হিসেবে।
জিএফএসএর পরিচালক অ্যাডেল কার্স্টেন বিবিসিকে তাঁর উদ্বেগের কথা জানান এভাবে, দক্ষিণ আফ্রিকায় যে শুধু সন্ত্রাসই বাড়ছে, তা নয়; বরং আগ্নেয়াস্ত্রজনিত সহিংসতার রূপও বদলাচ্ছে। ব্যাপকভাবে গুলিবর্ষণের ঘটনা ও হত্যাকাণ্ড এ দেশের ‘বৈশিষ্ট্য’ হয়ে উঠছে।
গত বছর পিটারমারিজবার্গ শহরের কাছে গুলির একটি ঘটনা ভীষণভাবে নাড়া দেয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে। ওই সময় একটি বাড়িতে বন্দুক হামলায় এক পরিবারের ১০ সদস্য নিহত হন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট সদস্যের বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর।
এমন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অনেকগুলোই ঘটছে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহারে। দক্ষিণ আফ্রিকায় এমন অস্ত্রের সংখ্যা সাড়ে ২৩ লাখের মতো। এ তথ্য জিএফএসএর।
দক্ষিণ আফ্রিকায় বেসামরিক মানুষকে রক্ষায় যেসব অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে, সেগুলোর অন্যতম জোগানদাতা স্বয়ং পুলিশ বাহিনী। সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ক্রিস্টিয়ান প্রিন্সলুর একটি ঘটনায় এটি ভালোভাবে বোঝা যায়।
২০০৭ থেকে ২০১৫ সাল—এ আট বছরেই ক্রিস্টিয়ান প্রিন্সলু বিভিন্ন গ্যাংয়ের কাছে বিক্রি করেছেন প্রায় দুই হাজার বন্দুক। হাজারের বেশি খুন ও ৮৯টি শিশুর মৃত্যুর ঘটনার পেছনে রয়েছে এসব আগ্নেয়াস্ত্র।
নিরাপত্তার এমন শূন্যতায় আগের চেয়ে আরও বেশি মানুষ নিজেদের নিরাপত্তায় হাতে অস্ত্র তুলে নিচ্ছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকায় বন্দুক রাখার অনুমতি বা লাইসেন্স পেতে একজন ব্যক্তিকে ২১ বছরের বেশি বয়সী হতে হয়। এ ছাড়া প্রয়োজন হয় নিবিড় প্রশিক্ষণ গ্রহণের, একাধিক পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়ার ও মানসিক দক্ষতা প্রদর্শনের। এটি একটি দীর্ঘ ও বিরক্তিকর প্রক্রিয়া।
এরপরও গত দশকজুড়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় বন্দুক রাখার অনুমতির আবেদন বেড়েছে চার গুণ, বলছে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম নিউজ টোয়েন্টিফোর। এটি জিএফএসএর পরিচালক অ্যাডেল কার্স্টেনের জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ। কেননা, তিনি চান সড়কে এ ধরনের অস্ত্র যেন কম দেখা যায়। তিনি বলেন, ‘যখন আপনি বন্দুকের সহজলভ্যতা কমাতে পারবেন, তখন বন্দুকের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনাও কমাতে পারবেন।’