ফিরে দেখা
যে প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর বলি হয়েছিল ৮ লাখ মানুষ
আজ রুয়ান্ডার গণহত্যা দিবস। এর সূচনা হয়েছিল এক দিন আগে, ১৯৯৪ সালের ৬ এপ্রিল। ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে নিহত হয়েছিলেন উড়োজাহাজে থাকা রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট জুভেনাল হাবিয়ারিমানা ও প্রতিবেশী দেশ বুরুন্ডির প্রেসিডেন্ট সাইপ্রিয়েন এনতারিয়ামিরা। প্রেসিডেন্ট জুভেনাল হাবিয়ারিমানা মৃত্যুর পর মাত্র ১০০ দিনে রুয়ান্ডায় হত্যা করা হয় প্রায় আট লাখ মানুষকে। তবে এই গণহত্যার পেছনে ছিল আরও অনেক কারণ। আজ থাকছে রুয়ান্ডার গণহত্যা নিয়ে বিশেষ লেখা
সময়টা ঠিক ৩০ বছর আগের। তারিখ ১৯৯৪ সালের ৬ এপ্রিল। আফ্রিকার সবুজঘেরা ছোট্ট দেশ রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালি বিমানবন্দরের দিকে যাচ্ছিল একটি উড়োজাহাজ। হঠাৎ হামলা। ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে নিমেষেই মাটিতে আছড়ে পড়ে উড়োজাহাজটি।
ওই উড়োজাহাজে ছিলেন রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট জুভেনাল হাবিয়ারিমানা ও প্রতিবেশী দেশ বুরুন্ডির প্রেসিডেন্ট সাইপ্রিয়েন এনতারিয়ামিরা। রুয়ান্ডায় দীর্ঘদিন ধরে চলা জাতিগত দ্বন্দ্ব নিরসনে শান্তি আলোচনা শেষে কিগালি ফিরছিলেন তাঁরা। দুজনের কেউই বেঁচে ফেরেননি। প্রাণ হারিয়েছিলেন উড়োজাহাজে থাকা বাকিরাও।
একই হামলায় দুই দেশের প্রেসিডেন্টের নিহত হওয়ার ঘটনা ইতিহাসে এই একটিই। আর এই হত্যাকাণ্ডের জেরে যে নৃশংস ঘটনা ঘটেছিল, তা-ও যুগের পর যুগ ঘৃণার সঙ্গে স্মরণ করে আসছে মানুষ। প্রেসিডেন্ট জুভেনাল হাবিয়ারিমানা মৃত্যুর পর মাত্র ১০০ দিনে রুয়ান্ডায় হত্যা করা হয় প্রায় আট লাখ মানুষকে।
১৯৯৪ সালের এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত চলা ওই নৃশংসতা পরিচিত ‘রুয়ান্ডা গণহত্যা’ নামে। এ সময় নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই ছিলেন দেশটির তুতসি সম্প্রদায়ের মানুষ। আর গণহত্যাটা চালিয়েছিল মূলত হুতু সম্প্রদায়। তারা মনে করত প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিমানাকে হত্যার পেছনে তুতসিদের হাত রয়েছে। হাবিয়ারিমানাও ছিলেন হুতু সম্প্রদায়ের।
তবে প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিমানার মৃত্যুকে রুয়ান্ডা গণহত্যার একমাত্র কারণ বললে ভুল হবে। এটি আসলে ছিল কফিনের শেষ পেরেকের মতো। রুয়ান্ডায় হুতু আর তুতসি সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব বহু পুরোনো। সে ইতিহাস জানতে হলে ফিরতে হবে বেশ কিছুটা পেছনে।
সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের ইতিহাস
রুয়ান্ডা বহু আগে থেকেই বসবাস করে আসছে হুতু ও তুতসি সম্প্রদায়ের মানুষ। সংখ্যার দিক দিয়ে হুতুরা দেশটিতে এগিয়ে—প্রায় ৮৫ শতাংশ। তুতসিরা সংখ্যালঘু। শারীরিক গড়নের দিক দিয়েও রয়েছে ভিন্নতা। হুতুদের চেয়ে তুতসিরা কিছুটা লম্বা ও হালকা–পাতলা। অনেকেই বলে থাকেন, তুতসিদের আদি নিবাস ইথিওপিয়ায়। তবে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলটাই বেশি। যেমন তারা একই ভাষায় কথা বলে, একই এলাকায় বসবাস করে। খাদ্যাভ্যাস ও সংস্কৃতিটাও একই।
হুতু-তুতসিদের মধ্যে দ্বন্দ্বের আগুন মূলত উসকে ওঠে ঔপনিবেশিক আমল থেকে। ১৯১৬ সালে দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেয় বেলজিয়াম। তখন থেকে রুয়ান্ডায় বিশেষ একটি নিয়ম চালু করা হয়। হুতু-তুতসিসহ দেশটির সব সম্প্রদায়ের মানুষের আলাদা পরিচয়পত্র দেয় সরকার। রাষ্ট্রীয়ভাবে শুরু করা হয় জাতপাতের ভেদাভেদ।
হত্যাকাণ্ডে বেসামরিক লোকজনকে অংশ নেওয়ার জন্যও উসকে দেয় সামরিক বাহিনী। তুতসিদের হত্যার বিনিময়ে বেসামরিক হুতুদের খাবার ও অর্থও দেওয়া হয়েছিল। এ কথাও বলা হয়েছিল যে তুতসিদের হত্যা করে তাদের জমি দখলে নিতে পারবে হুতুরা।
এ ছাড়া হুতুদের চেয়ে তুতসিদের সবদিক দিয়ে বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন মনে করত বেলজিয়াম সরকার। এর সুবিধাও পেয়েছিল তারা। পরবর্তী ২০ বছরে চাকরি ও শিক্ষার ক্ষেত্রে হুতুদের চেয়ে বহুগুণ এগিয়ে যায় সংখ্যালঘু তুতসিরা। এতে ধীরে ধীরে হুতুদের মধ্যে জমা হতে থাকে ক্ষোভ। সেই ক্ষোভের উদ্গিরণ ঘটে ১৯৫৯ সালে। বেশ কয়েকটি দাঙ্গায় সে বছর ২০ হাজারের বেশি তুতসিকে হত্যা করা হয়। রুয়ান্ডা ছেড়ে পালিয়ে যান ৩ লাখ ৩০ হাজার জন। দেশটিতে আরও সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে তুতসিরা।
হাবিয়ারিমানার হাতে ক্ষমতা
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হামলার মধ্যে ১৯৬২ সালে রুয়ান্ডার শাসনক্ষমতা ছেড়ে দেয় বেলজিয়াম। স্বাধীনতার স্বাদ পায় দেশটি। তবে থামেনি সহিংসতা। পরে ১৯৭৩ সালে রুয়ান্ডার সামরিক বাহিনীর একটি দল সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জুভেনাল হাবিয়ারিমানাকে ক্ষমতায় বসায়। এরপর ন্যাশনাল রেভল্যুশনারি মুভমেন্ট ফর ডেভেলপমেন্ট (এনআরএমডি) নামের একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন তিনি। ওই দলের হাত ধরেই টানা তিনবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
ক্ষমতায় বসার পর বেশ জনপ্রিয়তা পান হাবিয়ারিমানা। তবে শাসনামলের শেষ দিকটা ভালো যায়নি তাঁর। দিনকে দিন খারাপ হতে থাকে রুয়ান্ডার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। জনপ্রিয়তা কমতে থাকে হাবিয়ারিমানার। সময়টার নব্বইয়ের দশকের। ঠিক একই সময়ে উগান্ডার শরণার্থী তুতসিরা রুয়ান্ডা প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট (আরপিএফ) নামের একটি দল গড়ে তোলেন। তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন রুয়ান্ডার বর্তমান প্রেসিডেন্ট তুতসি সম্প্রদায়ের পল কাগামে। এই দলটিকে সমর্থন দিয়েছিলেন অনেক মধ্যপন্থী হুতু।
হুতু-তুতসিদের মধ্যে দ্বন্দ্বের আগুন মূলত উসকে ওঠে ঔপনিবেশিক আমল থেকে। ১৯১৬ সালে দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেয় বেলজিয়াম।
আরপিএফের মূল লক্ষ্য ছিল হাবিয়ারিমানাকে ক্ষমতা থেকে হটানো, আর রুয়ান্ডা ছেড়ে যাওয়া তুতসিদের দেশের ফেরার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৯০ সালে আরপিএফ সদস্যরা উগান্ডা থেকে রুয়ান্ডায় হামলা চালান। এতে নড়েচড়ে বসেন হাবিয়ারিমানা। অভিযোগ তোলেন রুয়ান্ডার তুতসিরাও আরপিএফের সঙ্গে জড়িত। শুরু হয় নিপীড়ন-গ্রেপ্তার। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত শত শত তুতসিকে হত্যা করে হাবিয়ারিমানা সরকার।
সংকটময় এই পরিস্থিতির মধ্যে অস্ত্রবিরতিতে রাজি হয় আরপিএফ ও রুয়ান্ডা সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৩ সালের আগস্টে তানজানিয়ার আরুশা শহরে একটি শান্তি চুক্তি হয় দুই পক্ষের মধ্যে। ওই চুক্তি অনুযায়ী আরপিএফকে নিয়ে রুয়ান্ডায় একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছিল। তবে এই সিদ্ধান্তে নাখোশ ছিলেন অনেক উগ্রপন্থী হুতু।
হত্যাযজ্ঞ শুরু
এরপর এলো ১৯৯৪ সালের ৬ এপ্রিল। উড়োজাহাজে হামলায় নিহত হলেন প্রেসিডেন্ট জুভেনাল হাবিয়ারিমানা। অনেকে এর দায় চাপালেন আরপিএফ প্রধান পল কাগমার ওপর। সন্দেহের তির গেল উগ্রপন্থী হুতুদের দিকেও। তবে হাবিয়ারিমানা হত্যার পেছনে কার হাত ছিল, তা এখনো জানা যায়নি।
হত্যাকারী যে–ই হোক কেন, এর চরম মূল্যটা দিতে হয়েছিল তুতসিদের। হাবিয়ারিমানার মৃত্যুর পরপরই রাজধানী কিগালি থেকে হত্যাযজ্ঞ শুরু করেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। শিকার হন রাজনৈতিক বিরোধীপক্ষের নেতা, তুতসি ও মধ্যপন্থী হুতুরা। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। সেনাবাহিনী ও সরকারপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা রাস্তা আটকে তুতসি সম্প্রদায়ের মানুষজনকে হত্যা চালাতে থাকে। পুড়িয়ে দেওয়া হয় গির্জার ভেতরে আশ্রয় নেওয়া তুতসিদেরও।
এই হত্যাকাণ্ডে বেসামরিক লোকজনকে অংশ নেওয়ার জন্যও উসকে দেয় সামরিক বাহিনী। তুতসিদের হত্যার বিনিময়ে বেসামরিক হুতুদের খাবার ও অর্থও দেওয়া হয়েছিল। এ কথাও বলা হয়েছিল যে তুতসিদের হত্যা করে তাদের জমি দখলে নিতে পারবে হুতুরা। এভাবে রুয়ান্ডাজুড়ে মাত্র ১০০ দিনের মধ্যে হত্যা করা হয় প্রায় আট লাখ মানুষকে।
ওই হত্যাযজ্ঞের সময়ও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল আরপিএফ। ১৯৯৪ সালের জুলাই নাগাদ রুয়ান্ডার বেশির ভাগ এলাকা দখলে নেন দলটির যোদ্ধারা। শেষ পর্যন্ত রাজধানী কিগালি দখল করেন তাঁরা। আরপিএফের কিগালি বিজয়ের পর আরুশা শান্তি চুক্তি অনুযায়ী হুতু সম্প্রদায়ের পাস্তুর বিজিমুংগুকে করা হয় প্রেসিডেন্ট। ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী হন আরপিএফ নেতা পল কাগামে। তবে পরে জাতিগত সহিংসতা ছড়ানোর দায়ে কারাগারে পাঠানো হয় বিজিমুংগুকে। এক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন প্রেসিডেন্ট হন কাগামে।
গণহত্যার বিচার
১৯৯৪ সালের অক্টোবরে রুয়ান্ডার গণহত্যার জন্য তানজানিয়ায় গঠন করা হয় ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনাল ফর রুয়ান্ডা (আইসিটিআর)। ১৯৯৫ সালে গণহত্যায় জড়িত সন্দেহে রুয়ান্ডার বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তিকে অভিযুক্ত করে আইসিটিআর। তবে এই বিচারপ্রক্রিয়া ছিল বেশ জটিল। কারণ, হত্যাকাণ্ডের জড়িত অনেকের সম্পর্ক বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল না। এরপর প্রায় ১৫ বছর ধরে গণহত্যার বিচারকাজ চলে। শেষ পর্যন্ত ২০০৮ সালে রুয়ান্ডার সাবেক তিন প্রতিরক্ষা ও সেনা কর্মকর্তাকে গণহত্যার জন্য দোষী সাব্যস্ত করার মধ্য দিয়ে বিচার শেষ হয়।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, হিস্ট্রি চ্যানেল, আল-জাজিরা