শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সমুদ্র উপকূল মানুষকে আকর্ষণ করে আসছে। মানুষকে স্থল ও সমুদ্রের মিলনস্থলে টেনে নিয়ে গেছে। এর মধ্যে কিছু কিছু দেশের উপকূলরেখা অনেক বিস্তৃত। বিশ্বের যে ১০টি দেশে দীর্ঘতম উপকূলরেখা আছে তার একটি তালিকা করেছে ওয়ার্ল্ড এটলাস। তালিকায় আছে কানাডা, নরওয়ে, ইন্দোনেশিয়া, রাশিয়া, ফিলিপাইন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড ও চীন।
আয়তনে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ কানাডায় ১০টি প্রদেশ এবং তিনটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আছে। বিশ্বের দীর্ঘতম উপকূলরেখার অবস্থানও এখানে। দেশটির ২ লাখ ২ হাজার ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলরেখাটি পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর, পূর্বে আটলান্টিক মহাসাগর এবং উত্তরে উত্তর মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। আলবার্টা ও সাসকেচওয়ান ছাড়া কানাডার বেশির ভাগ প্রদেশ ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলোর নিজস্ব উপকূলরেখা আছে।
নরওয়ের বেশির ভাগটারই অবস্থান স্ক্যান্ডিনেভিয়ান উপদ্বীপের পশ্চিমাঞ্চলীয় অংশে। নরওয়ের মূল ভূখণ্ডটি পূর্বে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগর এবং উত্তরে ব্যারেন্টস সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। নরওয়ের মানুষের একটা বড় অংশেরই বসবাস উপকূলীয় এলাকায়। নরওয়ের উপকূলরেখা জনপ্রিয় পর্যটন এলাকাও। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে দর্শনার্থীরা উপকূলরেখার মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে আসেন। দর্শনার্থীরা দেশের উত্তর উপকূল বরাবর নর্দার্ন লাইটসের (উত্তরের আলো) ঝলকও দেখতে পান।
সবচেয়ে বেশি আয়তনের দশ দেশের তালিকায় না থাকলেও বিপুলসংখ্যক দ্বীপ থাকায় ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম উপকূলরেখার দেশ হিসেবে তালিকায় স্থান পেয়েছে। দেশটির উপকূলরেখা প্রায় ৯৯ হাজার ৮৩ কিলোমিটার দীর্ঘ। কালিমান্তান, পাপুয়া এবং উত্তর-পূর্ব সুমাত্রার উপকূল বরাবর ম্যানগ্রোভ বন বিস্তৃত হয়েছে।
উত্তরাঞ্চলীয় জাভা ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সুলাওয়েসির উপকূলে সাধারণত চিংড়ির চাষ হয়ে থাকে। পূর্ব ইন্দোনেশিয়ার ছোট দ্বীপপুঞ্জ, জাভা দ্বীপের দক্ষিণ অংশ এবং সুমাত্রা দ্বীপ বরাবর অবস্থিত উপকূলরেখা হলো ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে মনোরম উপকূলীয় অঞ্চল। এগুলো দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রও।
রাশিয়ায় ৩৭ হাজার ৬৫৩ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলরেখা আছে। রাশিয়ার উপকূলরেখা পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর, পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর, উত্তরে আর্কটিক মহাসাগর এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে বাল্টিক সাগর, কৃষ্ণসাগর, কাস্পিয়ান সাগর এবং আজভ সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। দেশটির জনসংখ্যার একটা বড় অংশই সেন্ট পিটার্সবার্গ, ভ্লাদিভস্তক, ইয়ালতা, মাগাদান, কালিনিনগ্রাদ, বালতিয়িস্কসহ উপকূলবর্তী শহরগুলোতে বসবাস করে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে দ্বীপ রাষ্ট্র ফিলিপাইনের অবস্থান। এখানে ৭ হাজার ৬৪১টি দ্বীপ আছে। দেশটির উপকূলরেখা ৩৬ হাজার ২৮৯ কিলোমিটার দীর্ঘ। ফিলিপাইনের উপকূলরেখাটি অসংখ্য দ্বীপ ও উপসাগর দিয়ে বেষ্টিত। ফিলিপাইনের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ। দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশই উপকূলবর্তী এলাকাগুলোতে থাকে। ফিলিপাইনের বেশির ভাগ বড় শহরের অবস্থান দেশের উপকূলরেখা বরাবর। ফিলিপাইনের মানুষদের একটা বড় অংশই উপকূলে মাছ ধরার মধ্য দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। ফিলিপাইনের উপকূলীয় সৌন্দর্য অনেক পর্যটককে আকর্ষণ করে। এতে দেশটি অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হয়।
জাপান হলো পূর্ব এশিয়ার উপকূলে অবস্থিত একটি জনবহুল এবং প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত দ্বীপরাষ্ট্র। জাপান সাগরের পূর্বে এবং উত্তরে ওখোটস্ক সাগর ও দক্ষিণে পূর্ব চীন সাগরের মধ্যবর্তী জায়গায় এর অবস্থান। দেশটির উপকূলরেখা ২৯ হাজার ৭৫১ কিলোমিটার দীর্ঘ। এ উপকূলরেখাটি ফিলিপাইনের ৬ হাজার ৮৫২টি দ্বীপের জন্য সীমারেখা তৈরি করেছে। হোক্কাইডো, হনশু, শিকোকু এবং কিয়ুশু হলো জাপানের সবচেয়ে বড় এবং অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ।
হনশুর উত্তর ও পশ্চিম উপকূল এবং হোক্কাইডোর উপকূলরেখা আকৃতির দিক থেকে বেশ সোজা। আবার জোয়ার-ভাটা এবং ঝড়ের কারণে কিয়ুশু এবং পূর্ব হনশুর উপকূলরেখায় উল্লেখযোগ্য ভিন্নতা দেখা যায়।
জাপানের বেশির ভাগ নগরকেন্দ্র গড়ে উঠেছে দেশটির উপকূলরেখাজুড়ে। কিছু বড় বড় আন্তর্জাতিক বন্দরের অবস্থানও এখানে। জাপানের উপকূলরেখা বরাবর বসবাসকারী মানুষেরা মাছ ধরা ও তিমি শিকারের মতো কিছু কাজের মধ্য দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
ওশেনিয়ার দ্বীপ রাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়ার উপকূলরেখাটি ২৫ হাজার ৭৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ। প্রশান্ত মহাসাগর, ভারত মহাসাগর এবং দক্ষিণ মহাসাগরের সঙ্গে এর উপকূলরেখা আছে। অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যার একটা বড় অংশই উপকূলবর্তী এলাকাগুলোয় বসবাস করে। অস্ট্রেলিয়ায় ১০ হাজার ৬৮৫টি সমুদ্রসৈকত আছে। দেশটি উপকূলবর্তী এলাকায় অসংখ্য গুহা ও খাদ আছে। এর অনেকগুলোই পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়। অস্ট্রেলিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রবাল প্রাচীরের অবস্থান। এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাকৃতিক আশ্চর্যগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশগুলোর একটি যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে ৫০টি অঙ্গরাজ্য আছে। এখানকার উপকূলরেখা প্রায় ১৯ হাজার ৯২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ। এর মধ্যে ২৩টি অঙ্গরাজ্যে নিজস্ব বলে দাবি করার মতো উপকূলরেখা আছে। পূর্বে আটলান্টিক মহাসাগর, পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর, আলাস্কার উত্তরে আর্কটিক মহাসাগর এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে মেক্সিকো উপসাগরের সঙ্গে দেশটির উপকূলরেখা আছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে আলাস্কার উপকূলরেখাটি সবচেয়ে দীর্ঘতম (৬ হাজার ৬৪০ মাইল)। প্রশান্ত মহাসাগর ও উত্তর মহাসাগরের সঙ্গে এর সীমানা আছে। যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে দীর্ঘতম উপকূলরেখার দিক থেকে ফ্লোরিডা এবং ক্যালিফোর্নিয়ার স্থান যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয়। ফ্লোরিডার উপকূলরেখাটি ১ হাজার ৩৫০ মাইল এবং ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলরেখাটি ৮৪০ মাইল দীর্ঘ।
বিশ্বের দীর্ঘতম উপকূলরেখার তালিকায় নিউজিল্যান্ডের অবস্থান নবম। প্রশান্ত মহাসাগর ও তাসমান সাগর সংলগ্ন উপকূলরেখাটি ১৫ হাজার ১৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ। উপকূলরেখাটি বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম। কোথাও বালুময় সৈকত, কোথাও রুক্ষ ভূমি আবার কোথাও খাড়া পাহাড়। নিউজিল্যান্ডের উপকূলীয় অঞ্চল বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ এবং প্রাণীর আবাসস্থলও। এসব উদ্ভিদ এবং প্রাণী উপকূলীয় অঞ্চলে এবং এর আশপাশে স্থাপিত সংরক্ষিত অঞ্চলে সুরক্ষিত থাকে।
চীনে বিশ্বের দশম দীর্ঘতম উপকূলরেখাটির অবস্থান। এটি ১৪ হাজার ৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ। দক্ষিণ চীন সাগর, পূর্ব চীন সাগর এবং পীতসাগরের সঙ্গে এর উপকূলরেখা আছে। উপকূলরেখাটি দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে টনকিন উপসাগর থেকে বোহাই উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। চীনের উপকূলরেখার দক্ষিণ অংশটি উত্তর অংশের চেয়ে অনেক বেশি আলাদা। উত্তর অংশের বেশির ভাগটারই অবস্থান নিম্নাঞ্চলে। তবে নির্দিষ্ট কিছু অংশ পাহাড়ি এলাকা। দক্ষিণ অংশটি নদীর বদ্বীপ, পাহাড় এবং পাথুরে এলাকায় বিস্তৃত।