অভিমত
মিয়ানমার কি ভেঙে যাবে
সশস্ত্র বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনায় সামরিক জান্তার ব্যাপক অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু এবারের গৃহযুদ্ধের চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা।
ব্রিটিশ বার্মার স্বাধীনতা লাভের কিছু সময় আগে স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতা অং সান সংখ্যালঘু অ-বামার জাতিগোষ্ঠীগুলোর সক্রিয় সমর্থন চেয়েছিলেন। বিনিময়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, স্বাধীনতা লাভের পর তাদের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে। কেউ চাইলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারবে—এমন আশ্বাসও নাকি দেওয়া হয়েছিল।
এ সমর্থন আদায়ে শান রাজ্যের একজন রাজকুমার তাঁকে সহায়তা দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার আট মাস আগে অং সান তাঁর কয়েকজন কাউন্সিল সদস্যসহ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। স্বাধীন বার্মার সরকারগুলো প্রতিশ্রুত স্বায়ত্তশাসন দিতে অস্বীকার করে। এ কারণে স্বাধীনতা-পরবর্তী ৭৫ বছর ধরে বিভিন্ন বিদ্রোহী পক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাত চালিয়ে যাচ্ছে।
১৯৬২ সাল থেকে দেশটি শাসন করছে সামরিক জান্তা এবং তারা সামরিক শক্তি ব্যবহার করে এই বিদ্রোহী তৎপরতাকে একধরনের নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে। মাঝেমধ্যে তারা এক বা একাধিক পক্ষের সঙ্গে অস্ত্রসংবরণ চুক্তি করে অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নিয়েছে। কালক্রমে এমন সশস্ত্র সংঘাত মিয়ানমারের রাষ্ট্রজীবনের একটি স্বাভাবিক অংশে পরিণত হয় এবং একে কখনোই রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি।
সামরিক জান্তার নিরবচ্ছিন্ন মানবাধিকারবিরোধী কার্যকলাপের কারণে মিয়ানমার অনেকটা একঘরে হয়ে পড়ে এবং পশ্চিমকে সন্তুষ্ট করতে একসময় জান্তা একটি মেকি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনে রাজি হয়। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দৃশ্যত ক্ষমতায় আসেন অং সান সু চি এবং তাঁর দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)।
তবে ক্ষমতার নাটাই রয়ে যায় সেনাবাহিনীর হাতেই। ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত পরবর্তী নির্বাচনে এনএলডি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে সেনানায়কেরা তাঁদের ক্ষমতা হুমকির সম্মুখীন বিবেচনা করেন এবং ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের ফল বাতিল করে পূর্ণ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। দেশজুড়ে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হলে তা কঠোর হাতে মোকাবিলা করা হয় এবং তাতে সহস্রাধিক তরুণ প্রাণ হারান।
এ পর্যায়ে তরুণদের একাংশ জান্তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হন এবং শুরু হয় মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ, যা তিন বছর ধরে চলমান। ২০২১ সালের এপ্রিলে এনএলডির নেতৃত্বে নির্বাচিত সদস্যরা জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনইউজি) গঠন করেন, তাতে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এনইউজি ঘোষণা করে, সামরিক জান্তাকে পরাজিত করে দেশে একটি ‘ফেডারেল ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন’ গঠন করা হবে এবং সেই লক্ষ্যে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস’ সংগঠিত হয়। প্রায় এক ডজন বিদ্রোহী পক্ষ, যাদের সশস্ত্র সংগ্রামের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে, তারা এই প্রয়াসে যোগ দেয়।
আরাকান আর্মি ঐতিহ্যগতভাবে রোহিঙ্গাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে আসছে। তবে সাম্প্রতিক কালে তাদের কিছু বক্তব্যে আরাকান প্রশাসনে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব আছে। আরাকান ও আরাকানে রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে আরাকান আর্মি মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। পক্ষান্তরে এনইউজি তাদের সংগ্রামে যোগ দিতে আহ্বান জানিয়েছিল রোহিঙ্গাদের প্রতি। বাংলাদেশের উচিত ছিল তা ফ্যাসিলিটেট করা, কিন্তু জানামতে তা করা হয়নি।
সশস্ত্র বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনায় সামরিক জান্তার ব্যাপক অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু এবারের গৃহযুদ্ধের চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। বিবিধ অসন্তোষ সত্ত্বেও সংখ্যাগরিষ্ঠ বামাররা কখনো সেনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেননি। যুদ্ধে সাফল্য পাচ্ছে প্রধানত দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ গোষ্ঠীভিত্তিক দলগুলোই, কিন্তু বামার তরুণদের অংশগ্রহণে প্রথমবারের মতো এ লড়াই অনেকটা জনযুদ্ধের রূপ নিয়েছে। তা ছাড়া এই প্রথম জান্তাকে সারা দেশে সশস্ত্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
যুদ্ধের বিবরণে না গিয়ে এটুকু বলাই যথেষ্ট হবে যে সম্প্রতি দেশের উত্তর-পূর্ব অংশে চীনের সঙ্গে সীমান্তবর্তী বেশ কটি সেনাচৌকি বিদ্রোহীদের দখলে গেছে। কয়েকটি শহর তারা ছিনিয়ে নিয়েছে সেনাদের কাছ থেকে এবং কিছুসংখ্যক জান্তা সেনা আত্মসমর্পণ করেছে বিদ্রোহীদের কাছে। প্রশ্ন উঠছে, এথনিক বিদ্রোহীদের বিজয় অর্জনের মাধ্যমে কি ভেঙে যাবে মিয়ানমার?
রয়টার্সের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জান্তা নিযুক্ত প্রেসিডেন্ট মিন্ট সুয়ে পর্যন্ত আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন, চীনের সঙ্গে সীমান্ত অঞ্চলে যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে, সরকার যদি তা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়, তাহলে মিয়ানমার ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যেতে পারে।
মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ একদিন শেষ হবে এবং যখন শেষ হবে, দেশটি তখন পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে, তেমন সম্ভাবনা নেই। সম্ভাব্য দুটি বিকল্প পথে শেষ হতে পারে এই সংঘাত। এক, সামরিক জান্তার পরিপূর্ণ পরাজয়ের মাধ্যমে দেশটির সম্পূর্ণ ‘বলকানাইজেশন’। সে ক্ষেত্রে বামার সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরাবতী অববাহিকা থাকবে মিয়ানমার বা বার্মা হিসেবে।
অন্যান্য জাতিসত্তাভিত্তিক সাতটি ‘রাজ্য’ প্রতিটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হবে। দুই, একটি প্রকৃত ফেডারেল-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ বামার জনগোষ্ঠী কেন্দ্রীয় সরকার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করবে, তবে সেনাবাহিনীর সর্বাধিপত্য থাকবে না। সংখ্যালঘু জাতিসত্তাভিত্তিক রাজ্যগুলো এ ব্যবস্থায় তাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত স্বায়ত্তশাসন অর্জন করবে।
প্রথম বিকল্পটির সম্ভাবনা বেশ কম বলে আমি মনে করি। এথনিক যেসব দল লড়াই করছে, তারা এতে খুশি হতে পারে। কিন্তু আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক যে খেলোয়াড়েরা এখানে তৎপর, এ ক্ষেত্রে তাদের চাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। যুক্তরাষ্ট্রের এতে আপত্তি থাকার কথা নয়; বরং আঞ্চলিক বাস্তবতায় মিয়ানমারের মূলধারার সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক গড়ে তোলা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সহজতর হবে।
কিন্তু মিয়ানমার ভেঙে অনেকগুলো রাষ্ট্রের উদ্ভব বৃহৎ প্রতিবেশী চীন বা ভারত কারোই কাম্য হবে না। ভারত চাইবে না উত্তর-পূর্বের অস্থির রাজ্যগুলোর পাশে এমন একটি নজির সৃষ্টি হোক।
অন্যদিকে চীনের জন্যও তাদের যে বৃহত্তর স্বার্থ, বঙ্গোপসাগরে প্রবেশপথ, সে লক্ষ্যে একক মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা অনেক বেশি সুবিধাজনক। বস্তুত, মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সীমান্ত পুরোটাই কাচিন ও শান রাজ্যের সঙ্গে। আবার বঙ্গোপসাগর-তীরবর্তী রাখাইন রাজ্য মূল মিয়ানমার পার হয়ে। এভাবে তিন-চারটি রাষ্ট্র পেরিয়ে এই সংযোগ বজায় রাখা চীনের জন্য সমস্যাসংকুল হতে পারে।
উল্লেখ্য, জান্তার ঘনিষ্ঠ সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও চীন বিদ্রোহী পক্ষগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর আঞ্চলিক সংগঠন আসিয়ানও মিয়ানমারের অখণ্ডতাই চাইবে বলে ধরে নেওয়া যায়। সু চির দল এনএলডি বা তাদের নেতৃত্বে বর্তমান জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনইউজি) অবশ্যই চাইবে মিয়ানমারের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করতে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক বিপত্তি সত্ত্বেও জান্তার সেনাবাহিনী শিগগিরই পরাজিত হবে—এমনটি মনে করাও ঠিক হবে না।
আমি মনে করি, মিয়ানমারে পরিবর্তন সামরিক জান্তার সম্পূর্ণ পরাজয়ের মাধ্যমে আসবে না। কোনো একপর্যায়ে, যখন হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি রাজ্য থেকে তারা পরাজয়ের মুখে সরে যেতে বাধ্য হবে বা জান্তার সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে অনীহা দেখা দেবে, তখন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বা কারও মধ্যস্থতায় যুযুধান দুই পক্ষ আলোচনার টেবিলে বসবে।
এ পর্যায়ে জান্তার শীর্ষ নেতৃত্বে কিছু পরিবর্তন ঘটাও অসম্ভব নয়। তাই যদি হয়, তাহলে দ্বিতীয় বিকল্প, অর্থাৎ সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী-অধ্যুষিত রাজ্যগুলোকে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে মিয়ানমারে একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ৭৫ বছর ধরে দেশটি জুড়ে যে আঞ্চলিক বিদ্রোহ চলছে, তারও লক্ষ্য ছিল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। আর একমাত্র স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার মধ্য দিয়েই নিষ্পত্তি হতে পারে এই দীর্ঘ সংঘাতের।
কী হবে সেই স্বায়ত্তশাসনের স্বরূপ, এটি একটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। স্বায়ত্তশাসনের কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। আসামের করবি-আংলং ও উত্তর কাছার জেলা একরকম স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে, যার আওতায় জেলা পরিষদ অল্প কিছু বিষয়ে কিছু কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করতে পারে। আবার এর সম্পূর্ণ অন্য প্রান্তে আছে মিয়ানমারের শান রাজ্যের ওয়া স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল, যারা নিজেদের ‘ওয়া স্টেট’ বলে ঘোষণা করেছে।
চীন সীমান্তে অবস্থিত ওয়া স্টেট মিয়ানমারের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে, কিন্তু এর বাইরে তাদের বাকি আচরণ স্বাধীন রাষ্ট্রের মতোই। তাদের প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট আছে, সেনাবাহিনী আছে, একদলীয় শাসনব্যবস্থা আছে। এমনকি মিয়ানমারের মুদ্রা সেখানে অচল। ওয়া স্টেট দুটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চল নিয়ে গঠিত। তার একটিতে স্বীকৃত মুদ্রা চীনা ইউয়ান, অন্যটিতে থাই বাথ। লক্ষণীয়, ওয়া জাতিগোষ্ঠী হান চীনাদের জ্ঞাতি।
এথনিক স্টেটগুলোর জন্য ওয়া স্টেট মডেল খুব আকর্ষণীয় হতে পারে, কিন্তু দেশের বেশির ভাগ এলাকা বাস্তবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, এটা বামার সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হবে না। সম্ভাবনা বেশি, এমন একটি ব্যবস্থার যেখানে কিছু বিষয় থাকবে ফেডারেল সরকারের হাতে, বাকি সব বিষয়ে রাজ্যগুলো পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে। মিয়ানমারের রাজ্যগুলো প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হবে দর-কষাকষির মূল বিষয়।
কী হবে রাখাইন রাজ্যে
মিয়ানমারের জনসংখ্যার কমবেশি দুই-তৃতীয়াংশ বামার, বাকিরা ১৩৫টি স্বীকৃত এথনিক গ্রুপে বিভক্ত (যার মধ্যে রোহিঙ্গারা নেই)। সবচেয়ে বড় পক্ষ শান, যারা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮ শতাংশ। এরপর আছে কারেন। রোহিঙ্গাসহ ধরলে লোকসংখ্যায় এরপর আসে রাখাইন রাজ্য।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, রাখাইন এথনিক গ্রুপের সদস্যদের দ্বারা গঠিত আরাকান আর্মি জান্তাবিরোধী যুদ্ধরত পক্ষগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। প্রায় ২০ হাজার সুপ্রশিক্ষিত সৈন্য আছেন আরাকান আর্মিতে এবং তাঁরা শুধু রাখাইনে নয়, দূরবর্তী কাচিন রাজ্য এবং কারেন এলাকায়ও বিভিন্ন সংঘর্ষে অংশ নিচ্ছেন। যুদ্ধে বা আলোচনার টেবিলে, সমাধান যেখানেই আসুক না কেন, স্বায়ত্তশাসিত রাখাইনে ক্ষমতা লাভ করবে আরাকান আর্মি এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান।
ভূরাজনীতির বিষয়াদি ছাড়াও মিয়ানমার ও রাখাইনে কী ঘটে, তাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে আগ্রহের বিষয় হচ্ছে রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। আমরা জানি যে ২০২১ সালের ৩ জুন জাতীয় ঐক্যের সরকার ‘পলিসি পজিশন অন দ্য রোহিঙ্গা ইন রাখাইন স্টেট’ নামে একটি অবস্থানপত্র প্রকাশ করেছে। এ অবস্থানপত্র প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গাদের ‘রোহিঙ্গা’ নামে সম্বোধন করেছে।
এনইউজি তাদের প্রস্তাবিত ‘ফেডারেল ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন’-এ নৃতাত্ত্বিক পরিচয়-নির্বিশেষে সব জাতিগোষ্ঠীর মৌলিক মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার রক্ষার অঙ্গীকার করেছে এবং বলেছে, এসব নীতি রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা-সংক্রান্ত বিষয়াদি নিষ্পত্তিতে ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।
রোহিঙ্গাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিতকারী ‘ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড’ বাতিল এবং ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনে পরিবর্তন আনার কথাও বলা হয়েছে, যে আইনে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যায়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিনে এনইউজি কী করবে বা কতটুকু করতে সমর্থ হবে, তা নিয়ে অবশ্য অনিশ্চয়তা থেকেই যায়।
আরাকান আর্মি ঐতিহ্যগতভাবে রোহিঙ্গাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে আসছে। তবে সাম্প্রতিক কালে তাদের কিছু বক্তব্যে আরাকান প্রশাসনে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব আছে। আরাকান ও আরাকানে রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে আরাকান আর্মি মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। পক্ষান্তরে এনইউজি তাদের সংগ্রামে যোগ দিতে আহ্বান জানিয়েছিল রোহিঙ্গাদের প্রতি। বাংলাদেশের উচিত ছিল তা ফ্যাসিলিটেট করা, কিন্তু জানামতে তা করা হয়নি।
এমতাবস্থায় সামরিক জান্তার সঙ্গে নিষ্ফল আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি এনইউজি ও আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রাখা দরকার বাংলাদেশের নিজের স্বার্থে। একটি বিষয় বাংলাদেশকে বিবেচনায় রাখতে হবে, আর তা হচ্ছে, এনইউজির প্রতিশ্রুতি ও আরাকান আর্মির শুভেচ্ছার ওপরই নির্ভর করবে গৃহযুদ্ধ-উত্তর মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা।
মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব