বিশ্বের শীর্ষ ১০ উঁচু পর্বতশৃঙ্গ কোনগুলো

মেঘ ভেদ করা পর্বতের চূড়াগুলোকে একসময় ভাবা হতো দেবতা আর দানবদের আস্তানা। তবে এসব উঁচু উঁচু পর্বত এখন দুঃসাহসের প্রতীক হয়ে উঠেছে। কষ্টকর ও দুঃসাহসী অভিযান চালিয়ে পর্বতপ্রেমীরা এসব পর্বত জয় করছেন।

ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাসে প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ১০ পর্বতশৃঙ্গ হলো মাউন্ট এভারেস্ট, কে টু, কাঞ্চনজঙ্ঘা, লোৎসে, মাকালু, চো ওয়ু, ধৌলাগিরি, মানাসলু, নানগা পর্বত ও অন্নপূর্ণা। এ ১০টি পর্বতশৃঙ্গের অবস্থান হিমালয় ও কারাকোরাম অঞ্চলে। ১০ পর্বতের সব কটিরই উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আট হাজার মিটারের বেশি।

ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বের উঁচু চূড়াগুলো সম্পর্কে জেনে নিন।

মাউন্ট এভারেস্ট

পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট
ফাইল ছবি: রয়টার্স

নেপাল ও তিব্বত সীমান্তে হিমালয় পর্বত অঞ্চলে মাউন্ট এভারেস্টের অবস্থান। এটি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গ। পর্বতটি ৮ হাজার ৮৪৯ মিটার বা ২৯ হাজার ৩২ ফুট উঁচু। এটি বিভিন্ন নামে পরিচিত। তিব্বতীয়রা একে চোমোলুংমা নামে ডেকে থাকে, যার অর্থ ‘বিশ্বের দেবী মা’। নেপালিদের কাছে এটি আবার সাগারমাথা নামে পরিচিত। তবে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, মাউন্ট এভারেস্ট যে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গ, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু তা–ই নয়, টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের কারণে ক্রমাগত এর উচ্চতা বাড়ছে। প্রতিবছর এর উচ্চতা প্রায় দুই ইঞ্চি করে বাড়ছে। ১৯৫৩ সালে তেনজিং নোরগে ও এডমন্ড হিলারি প্রথম মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেন। অবশ্য প্রথম বিজেতা হিসেবে ম্যালরি ও আরভিংয়ের নামও শোনা যায়; তাঁদের সালটা ১৯২৪।

কে টু

বিশ্বের দ্বিতীয় উঁচু পর্বত কে টু
ছবি: এএফপি ফাইল ছবি

বিশ্বের দ্বিতীয় উঁচু পর্বত কে টু। এর উচ্চতা ৮ হাজার ৬১১ মিটার বা ২৮ হাজার ২৫১ ফুট। শুধু উঁচুই নয়, এটি একই সঙ্গে প্রাণঘাতী পর্বতগুলোরও একটি। এ পর্বতের চূড়ায় ওঠার চেষ্টাকালে পর্বতারোহীদের মৃত্যুহার প্রায় ২৩ শতাংশ। পাকিস্তান, চীন ও ভারত সীমান্ত–সংলগ্ন গুরুত্বপূর্ণ পর্বত এলাকা কারাকোরামে কে টুর অবস্থান। ১৯৫৪ সালে ইতালীয় ও স্থানীয় পর্বতারোহী দলকে সঙ্গে নিয়ে প্রথম কে টু পর্বতের চূড়ায় উঠতে সক্ষম হন আর্দিতো দেসিও।

কাঞ্চনজঙ্ঘা

কাঞ্চনজঙ্ঘা
ছবি: এএনআই ফাইল ছবি

বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বত কাঞ্চনজঙ্ঘা সম্পর্কে জানতে আমাদের আবারও হিমালয় অঞ্চলের দিকে ফিরে যেতে হবে। এর অবস্থান পূর্ব নেপাল ও ভারতের একেবারে উত্তর-পূর্ব (সিকিম) সীমান্তে। এই অঞ্চলের হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে এ পর্বতটি তাৎপর্যপূর্ণ। কাঞ্চনজঙ্ঘার অর্থ ‘তুষারের পাঁচ ঐশ্বর্য’। ব্রিটিশ পর্বতারোহী জো ব্রাউন ও জর্জ ব্যান্ড ১৯৫৫ সালে প্রথম কাঞ্চনজঙ্ঘা জয় করেন।

রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি তাদের জরিপ করা পর্বতগুলোর জন্য বিদ্যমান আদি নামগুলোই ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। যদিও তালিকায় নাম থাকা প্রথম দুটি সর্বোচ্চ শৃঙ্গের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম দেখা গেছে।

লোৎসে

লোৎসে পর্বত
ছবি: এএনআই ফাইল ছবি

বিশ্বের উঁচু পর্বতশৃঙ্গগুলোর তালিকায় মাউন্ট এভারেস্ট, কে টু ও কাঞ্চনজঙ্ঘার পরেই রয়েছে লোৎসে পর্বতের নাম। অর্থাৎ এটি বিশ্বের চতুর্থ উঁচু পর্বত। এর উচ্চতা ৮ হাজার ৫১৬ মিটার বা ২৭ হাজার ৯৪০ ফুট। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় নেপাল ও চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল তিব্বতের মধ্যবর্তী সীমান্তে লোৎসে পর্বতের অবস্থান। ১৯৫৬ সালে সুইজারল্যান্ডের একটি পর্বতারোহী দল প্রথম এ পর্বতে আরোহণ করে।

মাকালু

বিশ্বে সবচেয়ে উঁচু পর্বতগুলোর মধ্যে পঞ্চম অবস্থানে আছে মাকালু
ছবি: এএফপি ফাইল ছবি

তালিকায় ৫ নম্বরে আছে মাকালু পর্বতশৃঙ্গ। এর উচ্চতা ৮ হাজার ৪৮৫ মিটার বা ২৭ হাজার ৭৬৫ ফুট। এভারেস্ট থেকে সামান্য পূর্ব দিকে (২৩ কিলোমিটার) খুম্বু অঞ্চল নামে পরিচিত একটি এলাকায় এ পর্বতের অবস্থান। এই হিমালয় শৃঙ্গের মূল অংশটি প্রাকৃতিকভাবেই একটি চার-পার্শ্বযুক্ত পিরামিডের ভাস্কর্যের মতো দেখায়। এ পর্বতটি একাই দাঁড়িয়ে আছে। এর আশপাশে কোনো পর্বত নেই। মাকালু-বরুণ ন্যাশনাল পার্ক অ্যান্ড কনজারভেশন এরিয়ার মধ্যমণি এই মাকালু পর্বত। সংস্কৃত শব্দ ‘মহাকাল’ থেকে এর এই নামকরণ করা হয়েছে। ১৯৫৫ সালে ফরাসি পর্বতারোহীদের একটি দল প্রথম এর চূড়ায় ওঠে।

চো ওয়ু

এটিও বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গগুলোর একটি। তালিকায় ষষ্ঠ অবস্থানে থাকা এই শৃঙ্গের উচ্চতা ৮ হাজার ১৮৮ মিটার বা ২৬ হাজার ৮৬৪ ফুট। তিব্বতীয় ভাষায় এই পর্বতশৃঙ্গটির নামকরণ হয়েছে, যার অর্থ ‘ফিরোজা দেবী’। তুষার ও বরফে ঢাকা এই পর্বতের ওপর উজ্জ্বল নীল আকাশ প্রতিফলিত হয়। ১৯৫৪ সালে শেরপাদের সহযোগিতায় অস্ট্রিয়ার পর্বতারোহীদের একটি দল চো ওয়ু পর্বতের চূড়ায় উঠতে সক্ষম হয়। বর্তমান সময়ে চো ওয়ু পর্বতে ওঠার চেষ্টায় সাফল্যের হার প্রায় ৪৫ শতাংশ।

ধৌলাগিরি

বিশ্বের সপ্তম উঁচু পর্বত ধৌলাগিরির অবস্থান নেপালে
ছবি: এএনআই ফাইল ছবি

বিশ্বের সপ্তম উঁচু পর্বত ধৌলাগিরির অবস্থান নেপালে। এর উচ্চতা ৮ হাজার ১৬৭ মিটার বা ২৬ হাজার ৭৯৫ ফুট। সংস্কৃত শব্দ ধৌয়ালা ও গিরি থেকে এর নামকরণ করা হয়েছে ধৌলাগিরি। এর অর্থ ‘সুন্দর পর্বত’। সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ার পর্বতারোহী এবং নেপালি শেরপাদের একটি দল প্রথম ১৯৬০ সালে ধৌলাগিরি পর্বত জয় করে। এই পর্বত ও আরেক উঁচু পর্বত অন্নপূর্ণাকে বিচ্ছিন্ন করেছে একটি নদী। কালিগন্ডকি নামের নদীটি এই দুই পর্বতের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে। আর এতে বিশ্বের গভীরতম কালিগন্ডকি গিরিখাত গড়ে উঠেছে।

মানাসলু

মানাসলুর একটি বেজক্যাম্প।
ছবি: এএফপি ফাইল ছবি

নেপালের হিমালয়ে অবস্থিত এই পর্বতশৃঙ্গ বিশ্বের অষ্টম উঁচু পর্বতশৃঙ্গ। এর উচ্চতা ৮ হাজার ১৬৩ মিটার বা ২৬ হাজার ৭৮১ ফুট। সংস্কৃত শব্দ মানাসা থেকে এই পর্বতের নামকরণ করা হয়েছে, যার অর্থ ‘আত্মার পর্বত’। ১৯৫৬ সালে জাপানি পর্বতারোহীদের একটি দল মানাসলু পর্বতের চূড়ায় উঠতে সক্ষম হয়। এরপর ১৫ বছর আর কোনো পর্বতারোহী সেখানে পৌঁছাতে পারেননি। ১৯৭১ সালে আবারও জাপানি পর্বতারোহীদের দল মানাসলু পর্বত জয় করে। ১৯৯৭ সালে মার্কিন পর্বতারোহীরা মানাসলুর চূড়ায় উঠতে সক্ষম হন। বিশ্বের প্রাণঘাতী পর্বতগুলোর মধ্যে এর অবস্থান চতুর্থ।

নানগা পর্বতশৃঙ্গ

বিশ্বের নবম উঁচু পর্বত নানগার অবস্থান পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে
ছবি: এএনআই ফাইল ছবি

বিশ্বের নবম উঁচু পর্বতশৃঙ্গ নানগার অবস্থান পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে। এর উচ্চতা ৮ হাজার ১২৬ মিটার বা ২৬ হাজার ৬৬০ ফুট। কে টু পর্বতের নিকটবর্তী হলেও নানগা শৃঙ্গের অবস্থান কারাকোরামে নয়; বরং এটি একেবারে পশ্চিমে হিমালয় অঞ্চলের অংশ। নানগা পর্বতের অর্থ ‘নগ্ন পর্বত’। এ পর্বতে ওঠাকে কঠিন বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ঝুঁকির দিক থেকে কে টু পর্বতের পরেই এর অবস্থান। ১৯৫৩ সালে প্রথম জার্মান পর্বতারোহী হারমান বুহল এ পর্বত জয় করেন। জার্মান ও অস্ট্রীয় পর্বতারোহীদের একটি দল ওই অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিল।

১০

অন্নপূর্ণা

অন্নপূর্ণা
ছবি: এএনআই ফাইল ছবি

বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পর্বতের তালিকায় দশম অবস্থানে আছে অন্নপূর্ণা। এর অবস্থান নেপালে। উচ্চতা ৮ হাজার ৯১ মিটার বা ২৬ হাজার ৫৪৫ ফুট। উচ্চতার দিক থেকে তালিকায় নিচের দিকে থাকলেও এটি বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী পর্বতগুলোর একটি। ধৌলাগিরি পর্বতের পূর্ব দিকে অবস্থিত এ পর্বতটি আরোহণ করতে গিয়ে ১৯৯৯ সালের হেমন্তে ৫০ শতাংশের মৃত্যু হয়েছিল। আর ২০১৪ সালে শুধু এক তুষারঝড়েই ৪০ পর্বতারোহীর মৃত্যু হয়। প্রথম ১৯৫০ সালে ফরাসি পর্বতারোহী মরিস হার্জগ ও লুইস লাচেনাল এর সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ করেন। এরপর ১৯৭০ সাল পর্যন্ত আর কেউ এ পর্বত জয় করতে পারেননি।