গরমে পুড়ছে চার মহাদেশের অনেক দেশ, তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা
উত্তর গোলার্ধে শুরু হয়েছে গ্রীষ্মকাল। তবে গরমের আঁচ শুধু উত্তরেই সীমিত নেই। তাপপ্রবাহ যেন জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে বিশ্বের চারটি মহাদেশের বিভিন্ন শহরে। এই গরমের কারণে ঘুরেফিরে আসছে জলবায়ু পরিবর্তনের কথা।
আশঙ্কা—জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে এবারের তাপমাত্রা আগের বছরকে ছাড়িয়ে যাবে। গত বছরে গ্রীষ্মকালের তাপমাত্রা ছিল ২ হাজার বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
গত কয়েক দিনে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের তাপমাত্রা রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। চলতি সপ্তাহে সৌদি আরবে প্রায় ২০ লাখ মুসলমান পবিত্র হজ পালন করেছেন। তখন মক্কা ও মদিনায় তাপমাত্রা ছিল ৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। গরমে প্রায় এক হাজার হজযাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার মিসরের কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, এবার হজে অংশ নেওয়া দেশটির অন্তত ৫৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এখনো নিখোঁজ ৪০ জন।
গরমে পুড়ছে ভূমধ্যসাগর অঞ্চলও। তাপপ্রবাহের কারণে সেখানে দাবানল সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দাবানলের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে পর্তুগাল থেকে গ্রিস পর্যন্ত। আলজেরিয়ায় আফ্রিকার উত্তর উপকূলও জ্বলছে দাবানলের আগুনে।
আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, চলতি সপ্তাহে সার্বিয়ায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে থাকতে পারে। গরমের কারণে সেখানে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। মানুষকে ঘরের বাইরে থাকতে মানা করা হচ্ছে। রাজধানী বেলগ্রেডের জরুরি সেবা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অসুস্থ হয়ে বুধবার রাতে ১০৯ বার চিকিৎসকের কাছে সহায়তা চেয়েছে মানুষ। প্রতিবেশী দেশ মন্টেনেগ্রোর অবস্থাও ভয়াবহ।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের পর্যটকদের কাছে একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য ইউরোপ। তবে ভয়াবহ গরমের কারণে এ বছর সেখানে বহু পর্যটকের মৃত্যু ও নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। গ্রিসের মাথরাখি দ্বীপে ৫৫ বছর বয়সী একজন মার্কিনের মৃত্যু হয়েছে বলে গত সোমবার জানিয়েছে স্থানীয় পুলিশ। তাঁকে নিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে দ্বীপটিতে তিন পর্যটকের মৃত্যু হলো।
যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্ব ও মধ্য পশ্চিম অঞ্চলের কিছু কিছু এলাকায় তীব্র গরমের কারণে আজ সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছিল। জরুরি ব্যবস্থার আওতায় নিউইয়র্কে চলতি বছরে প্রথমবারের মতো ‘কুলিং সেন্টারগুলো’ (গরমের মধ্যে বিশ্রামের জন্য শীতাতপনিয়ন্ত্রিত স্থান) খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া অফিসগুলো অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে তীব্র তাপপ্রবাহের সতর্কতা জারি করেছে। সেখানে তাপমাত্রা ৪৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ভারতে সাধারণত মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত গ্রীষ্মকাল চলে। এরপর আসে বর্ষাকাল। তখন ধীরে ধীরে গরম কমতে শুরু করে। তবে গতকাল বুধবার রাজধানী নয়াদিল্লিতে ৫৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ রাত রেকর্ড করা হয়েছে। এ সময় শহরটিতে তাপমাত্রা ছিল ৩৫ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে রাতের তাপমাত্রা বাড়ছে। আর বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে দিনের তুলনায় রাত দ্রুত উষ্ণ হয়ে পড়ছে।
ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, গত ১৪ মে থেকে টানা ৩৮ দিন ধরে নয়াদিল্লির তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি বা এর বেশি রয়েছে। গতকাল দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পয়লা মার্চ থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত শহরটিতে ৪০ হাজারের বেশি মানুষ হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ সময় গরমের কারণে অন্তত ১১০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাপপ্রবাহের হার বাড়ছে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলেও।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) বলছে, চলতি বছরের পরের মাসগুলোতে তাপমাত্রা ২০২৩ সালের রেকর্ড তাপমাত্রাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ৮৬ শতাংশ। এতে করে এ বছর সর্বোচ্চ তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড হবে। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনে কাজ করছে জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘন ঘন তাপপ্রবাহ দেখা দিচ্ছে। সেগুলো আরও দীর্ঘস্থায়ী ও তীব্র হচ্ছে।
আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশনের (ডব্লিউডব্লিউএ) আশঙ্কা—শিল্পায়ন-পূর্ব সময়ে প্রতি ১০ বছরে যে তাপপ্রবাহ গড়ে একবার দেখা দিত, তা এখন ২ দশমিক ৮ বার দেখা যাবে। আর এখনকার তাপপ্রবাহগুলো ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি উষ্ণ হবে।
মানুষ যত জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়াবে ততই এই তাপপ্রবাহ তীব্র হবে বলে সতর্ক করছেন বিজ্ঞানীরা। ডব্লিউডব্লিউএর হিসাবে—বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায়, তাহলে প্রতি ১০ বছরে গড়ে ৫ দশমিক ৬ বার তাপপ্রবাহ দেখা দেবে। আর সেগুলোর তাপমাত্রা হবে আগের তুলনায় ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি বেশি।