১৭৫ বছরের জেল নাকি মুক্ত জীবন, কী আছে অ্যাসাঞ্জের ভাগ্যে
এক দশকের বেশি সময়ের বন্দিজীবন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের। এ সময়ের বেশির ভাগ বিদেশি দূতাবাসে গৃহবন্দী, বাকিটা জেলবন্দী কেটেছে তাঁর। বিয়েও করেছেন বন্দী অবস্থায়, হয়েছে সন্তানও। তবে মুক্তি মেলেনি। যখন স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তান নিয়ে সুখের সংসারজীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখার কথা, তখন অ্যাসাঞ্জ জীবন নিয়ে সংশয়ে ভুগছেন।
অ্যাসাঞ্জের বয়স বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে অসুস্থতা। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে অ্যাসাঞ্জকে তুলে দেওয়ার ভয় জেঁকে বসেছে। সেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে চরম সংকট, অনিশ্চয়তা। যুক্তরাষ্ট্র তাঁর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনেছে, সেসব প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ১৭৫ বছরের জেল হতে পারে অ্যাসাঞ্জের। অধরা রয়ে যেতে পারে মুক্ত জীবনের প্রত্যাশা।
সময়টা ২০০৬ সাল, উইকিলিকস প্রতিষ্ঠা করেন অ্যাসাঞ্জ। তবে তাঁর এই প্ল্যাটফর্ম আলোচনায় আসে ২০১০ সালে। ওই বছর আড়াই লাখ মার্কিন কূটনৈতিক তারবার্তা ও পাঁচ লাখ সামরিক গোপন নথি ফাঁস করে হইচই ফেলে দিয়েছিল উইকিলিকস। এর মধ্যে আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধ নিয়ে লাখ লাখ গোপন নথি ছিল। সেই থেকে অ্যাসাঞ্জের ভোগান্তির শুরু। ২০১০ সালেই তাঁর নামে সুইডেনে ধর্ষণের মামলা হয়। আইনি লড়াইয়ে হেরে যান তিনি।
২০১২ সালে অ্যাসাঞ্জ ছিলেন যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। সাজা ভোগের জন্য যুক্তরাজ্য সরকার তাঁকে সুইডেনের কাছে তুলে দেবে, এমন ভয় থেকে লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে আশ্রয় নেন অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক অ্যাসাঞ্জ। এরপর বছর গড়িয়েছে, টেমস নদীতে বয়ে গেছে পানি, কিন্তু দূতাবাসে কার্যত বন্দিজীবন কেটেছে অ্যাসাঞ্জের। এর মধ্যে ইকুয়েডর তাঁকে রাজনৈতিক আশ্রয়, পরে নাগরিকত্ব দিয়েছে। তবে একের পর এক আইনি ঝামেলা তাঁর পিছু ছাড়েনি। দূতাবাসে থেকেই যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে আইনি লড়াই চালিয়ে গেছেন, যাচ্ছেন তিনি।
অ্যাসাঞ্জের মুক্তির সঙ্গে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মর্যাদার বিষয়টি জড়িত। যদি আমরা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য ন্যায়বিচার ও ইনসাফ রেখে যেতে চাই, তাহলে সাংবাদিকদের ওপর আমরা যে সীমাবদ্ধতার দেয়াল তুলে দিয়েছি, তা সরিয়ে নিতে হবে এবং তাঁদের কাজের প্রতি আমাদের সম্মান দেখাতে হবে।আনোয়ার ইব্রাহিম, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী
অ্যাসাঞ্জকে গ্রেপ্তারে দীর্ঘ সাত বছর যুক্তরাজ্যের পুলিশকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। অবশেষে ২০১৯ সালে জামিনের শর্ত ভঙ্গ করার অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন থেকে লন্ডনের উচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থাসম্পন্ন বেলমার্শ কারাগারে বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন তিনি। যদিও যুক্তরাজ্যে তিনি কোনো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হননি।
গত বছরের মার্চে বিয়ে করেছেন অ্যাসাঞ্জ। স্ত্রী স্টেলা মরিস অ্যাসাঞ্জের আইনজীবী দলের সদস্য। ২০১১ সাল থেকে মরিস অ্যাসাঞ্জের হয়ে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। অ্যাসাঞ্জের সঙ্গে ২০১১ সালে তাঁর প্রথম দেখা হয়। এরপর প্রায় প্রতিদিন ইকুয়েডর দূতাবাসে গিয়ে অ্যাসাঞ্জের সঙ্গে দেখা করতেন। এভাবেই তাঁদের মধ্যে বোঝাপড়া তৈরি হয়। পরে তা গড়ায় প্রণয়ে। ২০১৭ সালে তাঁদের বাগদান হয়। ইকুয়েডর দূতাবাসে থাকাকালেই গর্ভধারণ করেন মরিস। গত বছর কারাগারে এই যুগলের বিয়ে হয়। তত দিনে অ্যাসাঞ্জ–মরিসের ঘরে দুই সন্তান এসেছে।
অ্যাসাঞ্জের বয়স এখন ৫১ বছর। শরীরটাও খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। গত বছরের ডিসেম্বরে মরিস সংবাদমাধ্যমকে জানান, অক্টোবরে অ্যাসাঞ্জ বেলমার্শ কারাগারে স্ট্রোকে (মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ) আক্রান্ত হয়েছেন। স্ট্রোক করায় তাঁর ডান চোখের পাতায় সমস্যার পাশাপাশি স্মৃতিশক্তির সমস্যা এবং স্নায়বিক ক্ষতি হয়েছে। নতুন করে আবার স্ট্রোকের আশঙ্কাও রয়েছে তাঁর।
মরিসের অভিযোগ, অ্যাসাঞ্জকে দীর্ঘ সময়ের জন্য কক্ষে আটকে রাখার পাশাপাশি বাতাস, সূর্যের আলো, পর্যাপ্ত খাদ্য ও প্রয়োজনীয় উদ্দীপনার ব্যবস্থা করা হয়নি। পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের উচ্চ আদালতে অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে গুপ্তচরবৃত্তি মামলার রায় বিপক্ষে গেছে, যা অ্যাসাঞ্জের জন্য একটি বড় ধাক্কা। অন্যদিকে অ্যাসাঞ্জের মতে, তাঁর বিরুদ্ধে চলমান মার্কিন আদালতের পদক্ষেপের চাপের কারণে ছোট ওই স্ট্রোকের ঘটনা ঘটে।
অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণে ওয়াশিংটনের অনুরোধে রাজি যুক্তরাজ্য সরকার। মাঝে বাদ সেধেছিলেন যুক্তরাজ্যের আদালত। কিন্তু দেশটির সর্বোচ্চ আদালত প্রত্যর্পণের পক্ষে। এরপর গত ১৭ জুন যুক্তরাজ্যের তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেল গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তুলে দেওয়ার আদেশে সই করেছেন। এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল আবেদন করেছেন অ্যাসাঞ্জের আইনজীবীরা।
অ্যাসাঞ্জের বয়স বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে অসুস্থতা। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে অ্যাসাঞ্জকে তুলে দেওয়ার ভয় জেঁকে বসেছে। সেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে চরম সংকট, অনিশ্চয়তা। ওয়াশিংটন তাঁর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনেছে, সেসব প্রমাণিত হলে ১৭৫ বছরের জেল হতে পারে অ্যাসাঞ্জের। অধরা রয়ে যেতে পারে মুক্ত জীবনের প্রত্যাশা।
বিশ্লেষকদের মতে, প্রীতি প্যাটেল যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করতে পারতেন। এর আগে প্যাটেলের পূর্বসূরি থেরেসা মে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের ওয়েবসাইট হ্যাক করা গ্যারি ম্যাককিননের প্রত্যর্পণের প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তা না করে প্রীতি প্যাটেল যুক্তরাষ্ট্রের আবদারের কাছে নতি স্বীকার করেছেন। স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের ওপর আঘাত হেনেছেন। এখন যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেছে। দেখার বিষয় প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের সরকার এ বিষয়ে কোন অবস্থান নেয়।
অ্যাসাঞ্জকে নিয়ে ২০২১ সালের নভেম্বরে এশিয়া টাইমসে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন মালয়েশিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। নিবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‘ভুয়া খবর ও ষড়যন্ত্রতত্ত্বের যুগে যাঁরা বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে গোপন নথি প্রকাশ করে প্রকারান্তরে সত্য প্রকাশে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো উচিত। এ মুহূর্তে জবাবদিহির শূন্যতায় উইকিলিকস যে পথ দেখিয়েছে, তাকে আরও এগিয়ে নিতে আমাদের আরও অনেক সাহসী ও নীতিনিষ্ঠ সাংবাদিক দরকার।’
অ্যাসাঞ্জের বিষয়ে আনোয়ার ইব্রাহিমের মত, ‘অ্যাসাঞ্জের মুক্তির সঙ্গে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মর্যাদার বিষয়টি জড়িত। যদি আমরা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য ন্যায়বিচার ও ইনসাফ রেখে যেতে চাই, তাহলে সাংবাদিকদের ওপর আমরা যে সীমাবদ্ধতার দেয়াল তুলে দিয়েছি, তা সরিয়ে নিতে হবে এবং তাঁদের কাজের প্রতি আমাদের সম্মান দেখাতে হবে।’
সংবাদমাধ্যমসহ বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন মহল থেকে অ্যাসাঞ্জের মুক্তির দাবি তোলা হয়েছে। এখন দেখার বিষয়, দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত অ্যাসাঞ্জের মুক্ত জীবনের স্বপ্ন বাস্তব হয় কি না। তাঁর এ স্বপ্নপূরণে মানবাধিকারের প্রতি সর্বদা সোচ্চার যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সরকার কতটা ন্যায়বিচার ও ইনসাফ দেখাতে পারে।
দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি, এশিয়া টাইমস ও এএফপি অবলম্বনে লিখেছেন অনিন্দ্য সাইমুম ইমন।