হানিয়াকে হামাসের তুলনামূলক মধ্যপন্থী নেতা ভাবা হতো

গতকাল মঙ্গলবার তেহরানে পার্লামেন্টে ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অতিথিদের সারিতে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া (প্রথম সারিতে ডান থেকে প্রথম)। পরদিনই দেশটিতে তাঁর নিহত হওয়ার খবর আসে। ৩০ জুলাই, ২০২৪ছবি: রয়টার্স

গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আন্তর্জাতিক নানা আলোচনায় কড়া ভাষায় কথা বলতে দেখা গেছে ইরানে নিহত হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াকে। যদিও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে অনেকে হামাসের অন্যান্য কট্টরপন্থী নেতাদের তুলনায় তাঁকে অধিক মধ্যপন্থী বলে মনে করতেন।

আজ বুধবার ইরানে একটি হামলায় হানিয়া নিহত হওয়ার খবর আসে। গাজায় ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে হানিয়ার নিহত হওয়ার খবর জানানো হয়।

২০১৭ সালে ইসমাইল হানিয়া হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান নির্বাচিত হন। অবরুদ্ধ গাজায় ভ্রমণ নিয়ে নানা বিধিনিষেধ এড়াতে তখন থেকে তিনি মূলত তুরস্ক এবং কাতারের দোহায় অবস্থান করা শুরু করেন। সেখান থেকেই তিনি ওই অঞ্চলে ভ্রমণ করতেন। গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যুদ্ধবিরতি নিয়ে নানা পক্ষের সঙ্গে আলোচনা অথবা হামাস মিত্র ইরানের সঙ্গে আলোচনায় তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল।

গত ৭ অক্টোবর গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন পর কাতারের মধ্যস্থতায় সেখানে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি জন্য আলোচনা শুরু হয়। যে আলোচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল হানিয়ার।

বিমানহামলায় ছেলেদের মৃত্যু:

১০ এপ্রিল গাজায় ইসরায়েলের একটি বিমান হামলায় ইসমাইল হানিয়ার তিন ছেলে হাজেম, আমির ও মোহাম্মদ নিহত হন। সে সময় তাঁরা একটি গাড়িতে ছিলেন। তাঁদের গাড়ি লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। হামলায় তিন ছেলে ছাড়াও হানিয়ের চার নাতি–নাতনি নিহত হয়।

ইসরায়েল দাবি করেছিল, হানিয়ার ছেলেরা হামাসের যোদ্ধা ছিলেন, যা অস্বীকার করেন হানিয়া। এমন একটি সময় হানিয়ার ছেলেদের হত্যা করা হয়, যখন গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা চলছিল।

ওই হামলার পর হানিয়াকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ইসরায়েলের হামলায় তাঁর ছেলে ও নাতি–নাতনিদের নিহত হওয়ার ঘটনা যুদ্ধবিরতি আলোচনায় কোনো প্রভাব ফেলবে কি না। জবাবে হানিয়া বলেছিলেন, তাঁর কাছে ‘ফিলিস্তিনি জনগণের স্বার্থ বাকি সব কিছুর ঊর্ধ্বে’।

হানিয়া জনসম্মুক্ষে কড়া ভাষায় কথা বললেও আরব দেশগুলোর কূটনীতিক এবং কর্মকর্তাদের চোখে গাজার ভেতরে হামাসের অন্যান্য নেতাদের তুলনায় হানিয়া অপেক্ষাকৃত বাস্তববাদী ছিলেন।

কাতারের মধ্যস্থতায় গাজা যুদ্ধ অবসানের যে আলোচনা শুরু হয়েছে তার পক্ষে কাজ করছিলেন হানিয়া। তিনি এবং তাঁর পূর্বসূরি হামাস নেতা খালেদ মেশাল সম্ভাব্য চুক্তি নিয়ে হামাসের অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য ওই অঞ্চলজুড়ে ভ্রমণ করেছেন। ওই যুদ্ধবিরতি আলোচনায় ইসরায়েলের কারাগার থেকে আরও ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তির পাশাপাশি গাজার জন্য আরও ত্রাণের ব্যবস্থা করার কথা বলা আছে।

ইসরায়েলের কাছে অবশ্য হানিয়াসহ হামাসের সব নেতাই সন্ত্রাসী। তাঁদের অভিযোগ, হানিয়া, মেশাল এবং অন্যান্যরা  ‘সন্ত্রাসী সংগঠন হামাসকে চালিত করছে’।

যদিও হানিয়া গাজা থেকে ইসরায়েলে হামাসের হামলার বিষয়ে আগে থেকে কতটুকু জানতেন তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। হামাসের সামরিক কাউন্সিল ওই হামলার পরিকল্পনা ও নেতৃত্ব দিয়েছিল। হামাসের এই শাখা অত্যন্ত গোপনীয়তা বজায় রাখে। যে কারণে ৭ অক্টোবরের হামলা এবং তার ব্যাপকতা কয়েকজন হামাস নেতাকেও অবাক করেছিল।

হানিয়া একজন সুন্নি মুসলমান ছিলেন। হামাসের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি ইরানের শিয়া নেতৃত্বের সঙ্গে সব সময় সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন। ইরান খোলাখুলি হামাসের প্রতি তাঁদের সমর্থনের কথা জানিয়েছে।

শাটল ডিপ্লোমেসি বা ঝটিকা কূটনীতি

২০১৭ সালে গাজা ছাড়েন হানিয়া। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন কট্টর হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার। ইয়াহিয়া দুই দশকের বেশি সময় ইসরায়েলের কারাগারে বন্দী ছিলেন এবং ২০১১ সালে বন্দিবিনিময় চুক্তিতে তিনি গাজায় ফিরে আসেন। হানিয়াই তাঁকে স্বাগত জানান।

আরব দেশগুলোর সরকারের সঙ্গে হামাসের হয়ে রাজনৈতিক যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন হানিয়া। এমনটাই বলেছেন কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলিস্তিনি সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আদিব জিয়াদেহ। এদিকে, হামাসের সামরিক শাখার কট্টরপন্থী নেতাদের সঙ্গেও তাঁর সুসম্পর্ক ছিল।

জিয়াদেহ বলেন, ‘হানিয়া হামাসের রাজনৈতিক ও কূটনীতিক ফন্ট ছিলেন।’