কোনো দেশের প্রতি চরম অসন্তোষ প্রকাশের প্রথম ও সবচেয়ে সাংঘাতিক পদক্ষেপ হচ্ছে নিজ দেশ থেকে ওই দেশের কূটনীতিককে বহিষ্কার করা। কিন্তু এই অসন্তোষের উত্তাপ অনেক সময় দুই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
গত সপ্তাহে অটোয়া ও নয়াদিল্লির পাল্টাপাল্টি কূটনীতিক বহিষ্কারের ঘোষণার পর ভারত গত বুধবার তার দেশের নাগরিকদের কানাডা ভ্রমণের বিষয়ে সতর্কতা জারি করেছে। কানাডায় ‘ক্রমবর্ধমান ভারতবিরোধী তৎপরতা’ এবং ‘ঘৃণ্য অপরাধ ও সহিংস পরিস্থিতির’ কথা বলে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের সতর্কভাবে চলাচলের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আবার কানাডার নাগরিকদের জন্য ভারতের ভিসা সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যদিকে কানাডার প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে বৃহস্পতিবার আবারও বলেছেন, হরদীপ হত্যাকাণ্ডে ভারতের এজেন্টদের জড়িত থাকার ‘বিশ্বাসযোগ্য কারণ’ রয়েছে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ভারতের বিরুদ্ধে আগের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি এখনো অনড় রয়েছেন।
এরই মধ্যে সুখদুল সিং নামের খালিস্তান আন্দোলনের আরেক নেতা খুন হয়েছেন। তিনি সুখা দুনেক নামেও পরিচিত। সব মিলিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে একধরনের সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
কানাডার সাবেক কূটনীতিক প্যাট্রিসিয়া ফর্টিয়ার ভারত-কানাডার মধ্যে চলমান ঘটনাকে ‘হতভম্বকর’ উল্লেখ করে বলেন, কোনো দেশ থেকে আরেক দেশের কূটনীতিককে সরিয়ে দেওয়া কোনো হালকা বিষয় নয়। দুই দেশ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা নিয়ে কোনো সমাধানে আসতে না পারলে কেবল এমন কাজ করে থাকে।
ওয়াশিংটনে কানাডার দূতাবাসে কাউন্সেলর এবং বলিভিয়া, ডমিনিকান প্রজাতন্ত্র ও পেরুতে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন প্যাট্রিসিয়া। তিনি বলছিলেন, কূটনীতিক জগতে এটি খুবই কঠিন পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এক দেশ আরেক দেশকে তার তীব্র অসন্তোষের বার্তা দিতে চায়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার এই নিজ্জর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকলে নিঃসন্দেহে সেটা ‘বড় ঘটনা’প্যাট্রিসিয়া ফর্টিয়ার, কানাডার সাবেক কূটনীতিক
এই কূটনীতিক বলেন, ‘বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা বড় পদক্ষেপ। কোনো ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়াও বড় পদক্ষেপ। আপনি সেদিকে যাচ্ছেন না। কারণ, সেসব পদক্ষেপ হচ্ছে শত্রুতার শেষ পদক্ষেপ। ভারত বা কানাডা কেউই এমন কাজ করেনি। আমি আশা করি, এমন কিছু হবে না।’
কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো সম্প্রতি শিখ সম্প্রদায়ের খালিস্তান আন্দোলনের নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে ভারতের বিরুদ্ধে ‘বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ’ তোলার পর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। তিনি পার্লামেন্টে এক বিবৃতিতে অভিযোগ তোলেন, নিজ্জরের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ভারতের এজেন্টরা জড়িত ছিল।
কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশের নাগরিক নিজ্জর ভারতের শিখদের স্বাধীন রাষ্ট্র আন্দোলনের সংগঠন খালিস্তানের নেতা হিসেবে পরিচিত। ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সারে গুরুদুয়ারার বাইরে গত ১৮ জুন আততায়ীর গুলিতে তিনি নিহত হন। তিনি ওই শিখ মন্দিরের সভাপতি ছিলেন।
রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ (আরসিএমপি) ওই গুলির ঘটনা এখনো তদন্ত করছে। ওই অভিযোগের বিষয়ে কানাডার সরকার এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু প্রকাশ করেনি।
প্যাট্রিসিয়া বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার এই নিজ্জর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকলে নিঃসন্দেহে সেটা ‘বড় ঘটনা’। তিনি অবশ্য বলেন, গোয়েন্দা তথ্য ছাড়া কোনো দেশের বিরুদ্ধে আরেকটি দেশের এমন মন্তব্যের চড়া মূল্য দিতে হবে। দুই দেশের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গিয়ে তলানিতে ঠেকবে।
এই কানাডীয় কূটনীতিক বলেন, কূটনৈতিক রীতিনীতির কথা চিন্তা করলে সাধারণ ছোটখাটো ঘটনায় প্রতিপক্ষ দেশের সরকারের কাছে কূটনৈতিক চ্যানেলে নোট পাঠানো হয়ে থাকে। আরেকটি পদক্ষেপ হতে পারে, রাষ্ট্রদূতকে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো। এসব পদক্ষেপে কাজ না হলে তখন দূতাবাসের কূটনীতিকদের তলব করা হয়।
প্যাট্রিসিয়া বলেন, রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি হতে পারে সংশ্লিষ্ট দেশে ভ্রমণের বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া। এ ধরনের পদক্ষেপ সচরাচর দেখা যায়।
কানাডিয়ান গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স ইনস্টিটিউটের কনস্যুলার সার্ভিসের বিশেষজ্ঞ প্যাট্রিসিয়া বলেন, প্রতিপক্ষ দেশকে এ ধরনের বার্তা দেওয়া একধরনের সংকেত। তিনি বলেন, ‘চীন ও ভারত তাদের অনেক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীকে কানাডায় পাঠিয়ে থাকে। সুতরাং একটি বার্তা হতে পারে, আমরা কানাডায় আর কোনো শিক্ষার্থী পাঠাব না। এত বিপুল অর্থ খরচ করে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা করতে আমরা অন্য কোনো দেশে পাঠাব।’
পরিস্থিতি ইতিমধ্যে অনেক দূর চলে গেছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য আলোচনা স্থগিত করা হয়েছে। কানাডার একটি প্রতিনিধিদল আগামী অক্টোবরে ভারতে যাওয়ার কথা ছিল।
প্যাট্রিসিয়া বলেন, বাণিজ্য আলোচনা স্থগিত হলেও এর প্রভাব নিয়ে কানাডা খুব বেশি চিন্তিত নয়। কারণ, এটি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ। দুই দেশের মধ্যে বিতর্ক শেষ হয়ে গেলে বাণিজ্য আলোচনা আবার এগিয়ে নেওয়া যাবে।
দিল্লির যেকোনো ধরনের শাস্তিমূলক পদক্ষেপ কানাডা থেকে ভারতের কৃষিপণ্য আমদানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবেজেফ নানকিভেল, এশিয়া-প্যাসিফিক ফাউন্ডেশন অব কানাডার সিইও
এই কূটনীতিক বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে দুই দেশের উত্তেজনা নিয়ে খুব হিসাব-নিকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে। অন্যান্য দেশ বলছে, ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তারা উদ্বিগ্ন। যুক্তরাজ্য বলেছে, ‘আমরা ভারতের সঙ্গে আমাদের মুক্তবাণিজ্য আলোচনা চালিয়ে যাব।’
প্যাট্রিসিয়া বলেন, ‘ভূরাজনৈতিক, রাজনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কৌশলগত অংশীদার কানাডা। কিন্তু ভারত না থাকলে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে কোনো কৌশল ঠিক করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।’
অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের অধ্যাপক রোল্যান্ড প্যারিস বলছিলেন, ভারতের সঙ্গে শীতল সম্পর্কের শুরু হলো মাত্র। এই সম্পর্ক ভালোর দিকে যাবে, নাকি খারাপ হবে, সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। নিজ্জর হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।
রোল্যান্ড বলেন, দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের উত্তেজনার খুব প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। ভারত সরকার প্রকাশ্যে নিশ্চয় তার পায়ে কুড়াল মারবে না। এখন পর্যন্ত তারা অভিযোগ অস্বীকার করে যাচ্ছে।
ট্রুডো সরকারের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা রোল্যান্ড বলেন, ভারত সরকার কানাডার বিরুদ্ধে বাণিজ্য বন্ধ বা স্থায়ী ভিসা নিষেধাজ্ঞার মতো পাল্টা আর কোনো পদক্ষেপ নেবে কি না, সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। সেটা হলে অটোয়াও একই ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে।
এই অধ্যাপক বলেন, মনে হচ্ছে, কূটনৈতিক উপায়ে পর্দার পেছনে এবং কানাডার মিত্রদের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে সরাসরি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানের পথ খোঁজা হয়েছিল। কিন্তু সেটা কাজ করেনি।
তবে রোল্যান্ড বলছেন, ‘শিখদের আন্দোলন নিয়ে দীর্ঘদিনের উত্তেজনা সত্ত্বেও ভারত ও কানাডা নিজেদের বন্ধু মনে করে। আরও তথ্য প্রকাশ্যে আসার আগে দুই দেশের সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
এশিয়া-প্যাসিফিক ফাউন্ডেশন অব কানাডার সিইও জেফ নানকিভেল বলছিলেন, ভারত হচ্ছে কানাডার দশম বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। দিল্লির যেকোনো ধরনের শাস্তিমূলক পদক্ষেপ কানাডা থেকে ভারতের কৃষিপণ্য আমদানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
জেফ বলেন, এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ শক্তি ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক টালমাটাল হতে যাচ্ছে। তবে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের কানাডায় পড়তে আসা এখনই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে হয় না। ২০২২ সালে ৩ লাখ ২০ হাজার ভারতীয় শিক্ষার্থী কানাডায় এসেছিল।
জেফ কানাডার পররাষ্ট্র সার্ভিসে প্রায় ৩৩ বছর কাজ করেছেন। তিনি হংকং ও ম্যাকাওয়ে কানাডার কনসাল জেনারেল ছিলেন। তাঁর মতে, ‘ভারতে কানাডার উচ্চ ডিগ্রির অনেক চাহিদা। আমি মনে করি, শিক্ষা খাতে শিগগিরই কোনো প্রভাব পড়বে না।’
এই সাবেক কূটনীতিক বলেন, ‘নিজ্জর হত্যাকাণ্ড বেশ গুরুতর অপরাধ। এটি বিচারের বিষয়। একই সঙ্গে এটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিষয়ও বটে। ভারত ও কানাডার মানুষের মধ্যে সম্পর্ক দারুণ আবার জটিলও। তারপরও আমি মনে করি, দুই দেশের মধ্যে দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে।’
জেফ বলেন, ‘আমরা কানাডা ও চীনের সম্পর্কে অনেক জটিলতা দেখেছি। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়ছে। চীনে কানাডার রপ্তানি বাড়ছে। মানুষে মানুষে সম্পর্ক দারুণ শক্তিশালী। আমি মনে করি, ভারতের সঙ্গেও সম্পর্কটা এমনই হবে।’