২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

সুখ না ‘ভণ্ডামি’, কী তথ্য পাওয়া যাচ্ছে সূচক থেকে?

ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে বাংলাদেশ ৯৪তম
ছবি: সংগৃহীত

সুখ নিয়ে ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস সূচক আসলে আমাদের কী তথ্য দিচ্ছে? গত সপ্তাহান্তে ২০২২ সালের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস প্রতিবেদনটিতে কী দেখা গেল?  ইউক্রেন থেকে ইয়েমেন—যুদ্ধে সৃষ্ট মানবিক দুর্দশা থেকে একটু মুক্তি পাওয়ার আশায় ছিল মানুষ। কিন্তু যা দেখ গেল, তা বেশ হাস্যকর এবং একেবারেই হতাশাজনক।

রাশিয়া ও পশ্চিমাদের মধ্যে ‘বাফার স্টেট’ (অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্র) ফিনল্যান্ড টানা পঞ্চমবারের মতো এবারও বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের মুকুট জিতে নিয়েছে। হয়তো এটা ইউক্রেনীয় কিংবা বাকি বিশ্বের মানুষকে দেওয়া যেতে পারত। সুখী দেশের তালিকায় ৯৮তম থাকা ইউক্রেন মূলত রাশিয়ার হামলার শিকার হয়েছে ‘বাফার স্টেট’-এর মর্যাদা ও অন্যান্য দাবি প্রত্যাখ্যান করায়।

সুইজার‍ল্যান্ড ও অস্ট্রিয়া যথাক্রমে চতুর্থ ও একাদশতম অবস্থানে রয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধ শুরুর পর থেকে তারাও নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। শান্তি সূচকের প্রতিবেদনের ফলাফল নিয়ে আলোচনা করার আগে এর শুরুর দিকটা দেখে নেওয়া যাক।

সুখী দেশের তালিকা যেভাবে

লেখকদের মতে, ক্ষুদ্র হিমালয়ান রাজতন্ত্র ভুটানেরও ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট’ এবং ‘সুখের প্রতি ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক আগ্রহ’-এর জন্য ধন্যবাদ পাওয়া উচিত। তবে তেমনটা হচ্ছে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত দুর্দশার ওপর থাকা বাকি বিশ্বের বেশির ভাগ আগ্রহে ভুটান হস্তক্ষেপ করে। কিন্তু সমৃদ্ধ আধুনিকতা প্রমাণ করেছে, সুখের কোনো নিশ্চয়তা নেই এবং তা আরও বড় অসুখী অবস্থারও কারণ হতে পারে—এই বিবেচনায় এটি ভুল সূচকের ওপরও জোর দিয়ে থাকতে পারে।

২০০৮ সালে ভুটান যখন পুরোপুরি রাজতন্ত্র থেকে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে পদার্পণ করে, দেশটি তখন গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস (জিএনএই) ব্যবহার করতে থাকে, যা জনগণের ‘সামষ্টিক কল্যাণ’কে মূল্যায়ন করে। টেকসই উন্নয়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ, সাংস্কৃতিক সুরক্ষা ও সুশাসনের ভিত্তিতে এই মূল্যায়ন করা হয়। উন্নয়নের মূল সূচক হিসেবে তারা ‘সেকেলে’ গ্রস ন্যাশনাল প্রোডাক্ট (জিএনপি) মানদণ্ড থেকে বেরিয়ে আসে। জনকল্যাণের বিষয়টি হিসাব করার জন্য সেন্টার ফর ভুটানিজ স্টাডিজ দৈবচয়নের ভিত্তিতে প্রায় আট হাজার পরিবারের ওপর জরিপ চালিয়ে থাকে। দুই শতাধিক প্রশ্নের এক প্রশ্নপত্র তৈরি করে এই জরিপে তাদের ব্যক্তিগত জীবন ও অনুভূতি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। এটা অবশ্যই একধরনের নির্যাতন।

২০১১ সালে এই ‘কিংডম অব হ্যাপিনেস’ জাতিসংঘের একটা প্রস্তাব স্পনসর করে। প্রস্তাবে ‘সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন ও মূল্যায়ন কীভাবে করা যেতে পারে, সে জন্য সুখ ও কল্যাণের ওপর আরও বেশি গুরুত্ব দিতে’ অন্য সরকারগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।

পরবর্তী বছরে ভুটান নতুন তৈরি তার এই ‘হ্যাপিনেস ইন্ডাস্ট্রি’র কয়েকজন উৎসাহী একাডেমিককে নিয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ‘সুখের নতুন বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ’ উপস্থাপন করে। এতে ২০ মার্চকে বিশ্ব সুখ দিবস ঘোষণায় জাতিসংঘের পথ উন্মুক্ত হয়।

মানব সাধনার চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে প্রাচীন গ্রিক ও রোমানরা নৈতিক উৎকর্ষ ও ন্যায়বিচারের মাধ্যমে, অথবা নিখাদ আনন্দ লাভের জন্য সুখের পুরো বিষয়টিকে বিচক্ষণভাবে দেখত। কিন্তু সেটাকে পরাজিত করে পাওয়া গেল ‘সুখ দিবস’ এবং কল্পিত ‘সুখ বিজ্ঞান’।

যেভাবেই হোক, প্রথম বার্ষিক ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট ২০১২ সালে আলোর মুখ দেখে জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায়। যে সংগঠনটি বিশ্বের সবচেয়ে ‘অচল ও দুর্দশাগ্রস্ত’ একটি সংগঠন।

প্রতিবেদনটিকে শূন্য মনে হতে পারে

কৌতুক না করে বলতে গেলে, সুখের সম্ভাব্য দুটি উৎসের নিরিখে রিপোর্টটিকে শূন্য মনে হতে পারে। যেমন সংস্কৃতি, সম্প্রদায় ও পরিবেশ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগত অনুভূতি (সাবজেক্টিভ প্রিফারেন্স) এবং সম্পদ, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও শিক্ষা ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট বস্তুগত বিষয়ের (অবজেক্টিভ প্রিফারেন্স) নিরিখে। সন্দেহ হয়, শেষের সার্বিক সূচকগুলোই রিপোর্টের তালিকা করার ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে; সাংস্কৃতিকভাবে অন্তর্মুখী এবং অনেকটাই নিজেদের গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করা নরডিক ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলো কেন অব্যাহতভাবে সুখ সূচকে তালিকার শীর্ষস্থান দখল করে আছে, সে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে অনেক কাঠখড় পোড়ানো হয়েছে।

দুঃখজনকভাবে ‘কিংডম অব হ্যাপিনেস’-এর (ভুটান) র‍্যাঙ্কিং বিগত বছরগুলোতে ক্রমেই নিচ থেকে নিচে নেমেছে। দেশটির র‍্যাঙ্কিং অবনমন হয়ে ৭৯ থেকে ৯৭তে গিয়ে ঠেকেছে। ভুটানের বাইরের আরেকটি দেশ সুখের সঙ্গে সম্পৃক্ততার জন্য সুপরিচিত, ‘হ্যাপি ইয়েমেন’ ওই বছর সুস্পষ্টভাবে কোনো স্মারক পায়নি। কারণ, দেশটি গৃহযুদ্ধ এবং সহিংসতার মধ্যে তখন নিপতিত। আর এর একপর্যায়ে সৌদি আরব ও আমিরাত নেতৃত্বাধীন সামরিক হস্তক্ষেপে দেশটিতে এখন একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে।

বিপরীত দিকে, এই যুদ্ধ যখন দ্বিতীয় বছরে গড়ায়, সংযুক্ত আরব আমিরাত সুখ ও সহনশীলতার জন্য দুটি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে। নৈতিকতাকে রাষ্ট্র ও সমাজের মৌলিক মূল্যবোধ হিসেবে নির্ধারণ করা হয় এবং দেশটিতে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা ইস্যু আরও কঠোর করা হয়।

গত ২০১৬ সালে সুখ সূচকে দেশটি ২৮তম স্থানে অবনমন হলেও পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিকভাবে উদার অতিধনী আমিরাত নিজের আরব সঙ্গীদের চেয়ে টানা চার বছর এগিয়ে ছিল। যাহোক, এই বছর সংযুক্ত আরব আমিরাতকে পাশ কাটিয়ে তুলনামূলকভাবে গরিব উপসাগরীয় রাজতন্ত্র বাহরাইন এগিয়ে গেছে। বৈশ্বিক সূচকে ২০২২ সালে বাহরাইনের অবস্থান ২১তম। আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের অবস্থান ২৪তম।

অথচ ১১ বছর আগে আরব বসন্তের উত্তাল বিক্ষোভে প্রায় অচল হয়ে পড়ে বাহরাইন, শেষ পর্যন্ত সেই গণবিক্ষোভ ঠেকাতে সৌদি আরবকে সামরিক হস্তক্ষেপে যেতে হয়। এর পর থেকেই দেশটির নাগরিকেরা কঠিন রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে বসবাস করছেন।

তাই এতে প্রশ্ন ওঠে, তালিকায় যথাক্রমে ২৯তম ও ৩১তম অবস্থানে থাকা স্পেন ও ইতালিকে টপকে বাহরাইন কীভাবে সামনে এল। এমনকি ফ্রান্সকেও প্রায় টপকে যাচ্ছিল দেশটি, যদিও সুখসহ যেকোনো কিছু, সবকিছুর সমালোচনা করার জন্য ফরাসিরা বিখ্যাত।

বাহরাইন বেশ কিছুদিন আগে ইসরায়েলের সঙ্গে ‘শান্তি চুক্তি’ সই করেছে। আর এই চুক্তি বাহরাইনিদের জীবনে খুব বেশি উচ্ছ্বাস বয়ে এনেছে কি না, তাতে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণ, তাদের অধিকাংশই ‘ইহুদিবাদী শত্রুর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার’ বিপক্ষে।

এ আলোচনায় ইসরায়েল প্রসঙ্গে আসার কারণ, দেশটি সুখ সূচকে এবার শীর্ষ দশের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। এ বছর সুখ সূচকে তাদের অবস্থান নবম, দেশটির সহিংস জাতিবিদ্বেষ সত্ত্বেও। এই জাতিবিদ্বেষের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলে আসছে বরাবর। যত মারাত্মক জাতিবিদ্বেষ, সুখ সূচকে তত বেশি ওপরের দিকে!

সুখকে আবার সামরিক দখলদারির সঙ্গেও মিলিয়ে দেখা যায়। বিশেষ করে লস অ্যাঞ্জেলেসে হলিউডের এ লিস্টে যখন অতিথিদের মধ্যে ফ্রেন্ডস অব ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সসের (এআইডিএফ) নির্লজ্জ বন্ধুদের দেখা যায়। যখন দেখা যায় একদল নির্লজ্জ অতিথির উদ্দেশে ফারেল উইলিয়ামস নির্লজ্জভাবে ‘হ্যাপি’ গানটি গাইছেন। আর তিনি যখন তা গাইছেন, তখন ইসরায়েল নির্লজ্জভাবে গাজা উপত্যকায় বোমাবর্ষণ করে চলেছে।

গাজায় ফিলিস্তিনিদের বসতিতে ইসরায়েলের বোমা হামলার এই চিত্র গত বছরের
ফাইল ছবি: রয়টার্স

টাইম ম্যাগাজিন একবার কাভার স্টোরিতে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিল ‘ইসরায়েল শান্তির বিষয়টি আদৌ পরোয়া করে না। খুব ভালো কথা। কারণ, তারা এটা ছাড়াই সুখী। ফিলিস্তিন ও আরব নেতৃত্বের করুণ ব্যর্থতার প্রতি ধন্যবাদ জানানো ছোট বিষয় নয়, যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশগুলো র‍্যাঙ্কে খুবই খারাপ স্কোর করেছে।

বস্তুত এটা খুবই লক্ষণীয় যে গোটা একটা জাতিকে দশকের পর দশক দেশছাড়া করে, দখল করে, নির্যাতন করে, কারাগারে পুরে এবং অপদস্থ করে এভাবে একটা দেশ অদ্ভুতভাবে সুখী হতে পারে। এটা কি বিভ্রম, নির্বিকার, মানসিক বিকার, বর্ণবাদ অথবা কী?

‘থান্ডার ড্রাগনের ভূমি’ ভুটান দেখিয়েছে, দেশটি হতে পারে নানা বিষয়ের ভান্ডার। যেসব বছরগুলোতে সুখের প্রতি দেশটির ঘোর প্রবল ছিল, সে সময় ভুটান সামরিক বাহিনী এক লাখ নেপালি ভাষাভাষী মানুষকে বহিষ্কার করেছে। এদের অধিকাংশই দেশটির দারিদ্র্যপীড়িত দক্ষিণাঞ্চলে বসবাস করত। এতে রাজতন্ত্রের ‘এক দেশ এক জাতি’ ভিশন বাস্তবায়নের পথ উন্মুক্ত হয়। রাজা জিগমে সিংহে ওয়াংচুকের আরেকটি ভিশন ছিল—চার বোনকে বিয়ে করা, যেটি তিনি ১৯৮৮ সালে সুখী মনে এবং উৎসবের সঙ্গেই সম্পন্ন করেছেন।

রাজার সরে দাঁড়ানোর পর দেশটি গণতন্ত্রে ফিরলেও জাতিগত নিধনের ঘটনা সংশোধন, ক্ষতিপূরণ কিংবা বাস্তুচ্যুত হওয়াদের ফেরাতে সরকার সামান্যই করেছে। যদিও এক যুগ আগে আল-জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি অস্বীকার করেছেন, এর পক্ষে সাফাই গেছেন এবং সুখের সঙ্গেই বিষয়টি গ্রহণ করেছেন, ইতস্ততবোধ ছাড়াই।

কিন্তু সমস্যাটি ইসরায়েল, ভুটান ও বাহরাইনের চেয়ে বড় অথবা এ বিষয়ের ক্ষেত্রে রাশিয়া, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও। এটা হলো সুখ নিয়ে বিরাজমান আন্তর্জাতিক ভণ্ডামি—নৈতিকতার প্রচারের বিপরীতে সহিংসতা ছড়ানো, শান্তির কথা বলা আর যুদ্ধ বাধানো, ভালোবাসার কথা বলা আর ঘৃণা ছড়ানো, গাছকে জড়িয়ে ধরা আর বাতাসকে দূষিত করা।

কল্যাণ অর্জিত হতে পারে ‘জীবন, স্বাধীনতা এবং সুখ সাধনার মাধ্যম’–এ, পরস্পরে মিলে। অন্য ব্যক্তি, জাতি, বর্ণ অথবা লৈঙ্গিক গোষ্ঠী কিংবা প্রজন্মের ‘জীবন, স্বাধীনতা ও সুখ সাধনা’র বিনিময়ে নয়।